টার্গেট বাণিজ্য মেলা: এক লাখের জাল নোট ১৫ হাজারে বিক্রি চক্রের ০৩ সদস্য আটক! 

বিশেষ প্রতিনিধি: র‍্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই দেশের সার্বিক আইন শৃংখলা পরিস্থিতিকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সব ধরণের অপরাধীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। র‍্যাব নিয়মিত ভাবে সফলতার সহিত জঙ্গী, সস্ত্রাসী, সংঘবদ্ধ অপরাধী, মাদক, অস্ত্রধারী অপরাধী, ভেজাল পণ্য, ছিনতাইকারী, পর্নোগ্রাফি’সহ প্রতারক ও হ্যাকারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আসছে।
এরই ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালায় র‍্যাবের একটি চৌকস ইউনিট। ওই সময় বাণিজ্য মেলা উপলক্ষে কোটি টাকার বেশি জাল নোট বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতির চালায় ঢাকার মিরপুর পল্লবীর একটি বাড়িতে। ঘরে বসে কম্পিউটারে প্রিন্ট করে এসব টাকা বানাচ্ছিলেন ছগির হোসেন ও তার দলের সদস্যরা। গত দশ বছর ধরে এমন জাল টাকা তৈরি করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন তারা।
এরপরে কয়েক হাত ঘুরে ভোক্তা পর্যায়ে এসব জাল নোট ছড়িয়ে দিতে দেশজুড়ে ছিল ডিলার। পুরো এক লাখ টাকার জাল নোট তৈরিতে খরচ হতো চার হাজার টাকা। এরমধ্যে একহাজার টাকার এক লাখের বান্ডিল ১৫ হাজার টাকা এবং পাঁচশ টাকার একলাখের বান্ডিল ১০ হাজার টাকা বিক্রি করা হতো।
গতকাল সোমবার (০২ জানুয়ারী) ২০২২ ইং রাতে রাজধানীর পল্লবীতে অভিযান চালিয়ে চক্রের মূলহোতা ছগির হোসেনসহ তিন’জনকে গ্রেপ্তার করে এলিট ফোর্স র‌্যাব। এসময় তাদের হেফাজত হতে যথাক্রমে, (ক) ০১ কোটি ২০ লাখ টাকা সমমানের জাল নোট, (খ) পাঁচটি মোবাইল ফোন, (গ) ০২ টি ল্যাপটপ, (ঘ) ০১ টি সিপিইউ, (ঙ) ০৩ টি প্রিন্টারসহ জাল নোট তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তাররা হলো- ১/ ছগির হোসেন, ২/ মোছাঃ সেলিনা আক্তার পাখি ৩/ রুহুল আমিন।
আজ মঙ্গলবার (০৪ জানুয়ারী) ২০২২ ইং রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান, বাহিনীটি মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা জানিয়েছেন, তারা পরষ্পর যোগসাজশে দীর্ঘদিন যাবৎ ঢাকা ও বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় এই জাল নোট তৈরি করে বিভিন্ন লোকদের কাছে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করে আসছিল। চক্রটির মূলহোতা গ্রেপ্তার ছগির হোসেন এবং অন্যান্যরা তার সহযোগী। চক্রের সঙ্গে ১৫-২০ জন সদস্য জড়িত রয়েছে। হোটেল বয় থেকে জাল টাকা কারবারে জড়ানো ছগির গ্রেপ্তার ছগির হোসেন ১৯৮৭ সালে বরগুনা থেকে ঢাকায় আসেন। প্রথমে একটি হোটেল বয়ের কাজ নেন।
পরবর্তীকে ভ্যানে ফেরি করে গার্মেন্টস পণ্য বিক্রি শুরু করেন। গার্মেন্টস পণ্য বিক্রির সময়েই ছগিরের সঙ্গে ইদ্রিস নামক এক জাল টাকা কারবারির পরিচয় হয়। পরিচয়ের সুবাদে তাদের মধ্যে সু-সম্পর্ক ও জাল নোট তৈরির হাতেখড়ি হয়। ছগির প্রথমে জাল নোট বিক্রি ও পরবর্তীতে সেসব তৈরির বিষয় রপ্ত করেন। ২০১৭ সালে জাল নোটসহ ইদ্রিস ও ছগির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। বছরখানেক জেল খেটে পুনরায় সে ২০১৮ সাল হতে জাল নোট তৈরি শুরু করেন। তৈরি করা জাল নোটগুলো তার চক্রে থাকা অন্যান্য সহাযোগী রুহুল আমিন, সেলিনা ও অন্যান্য ৭/৮ জনের মাধ্যমে বিক্রি করে আসছিল।
জানা যায়, পুরান ঢাকা থেকে জাল টাকার উপকরণ কিনতেন ছগির। মূলহোতা ছগির নিজেই পুরান ঢাকা হতে জাল নোট তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ টিস্যু পেপার, প্রিন্টার, ল্যাপটপ ও প্রিন্টারের কালি কেনেন। তার ভাড়া বাসায় গোপনে বিশেষ কৌশলে এ-৪ সাইজের ০২ টি টিস্যু পেপার একসাথে আঠা দিয়ে লাগিয়ে রঙ্গিন প্রিন্টারে ডিজাইনকৃত টাকা তৈরি করা হতো। তিনি নিজেই প্রিন্টিং ও কাটিং করতেন। নিরাপত্তার স্বার্থে প্রিন্টিংয়ের কাজে অন্যান্যদের সম্পৃক্ত করা হতো না। জাল নোট তৈরির পর অন্যান্য সহযোগীদেরকে মোবাইলে কল করে তার কাছ থেকে জাল নোট নিয়ে যেতে বলতেন।
১৫ হাজারে ০১ লাখ টাকার জাল নোট বিক্রি করতেন ছগির। প্রতি এক লাখ টাকার জাল নোট তৈরিতে ছগিরের খরচ হতো ৫/৬ হাজার টাকা। আর তিনি লাখ টাকার জাল নোট বিক্রি করতেন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে। তার সহযোগিরা মাঠ পর্যায়ে সরবরাহ ও বিক্রি করতেন। টার্গেট বা চাহিদা অনুযায়ী ছগির প্রতিমাসে তার সহযোগীদেরকে বোনাসও দিতেন। তাদের বাণিজ্যমেলা, শীতকালীন মেলা, জনসমাজগম ছিল মূল টার্গেট।
এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মঈন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে ছগির জানিয়েছে, করোনাকালীন সময়ে মাঝে মাঝে ছগির নিজেও এ জাল নোট স্থানীয় বাজারে ব্যবহার করতো। কয়েকবার সে সাধারণ জনগণের হাতে ধরাও পড়েছিল। সাধারণত কোনো মেলায়, ঈদে পশুর হাটে ও অধিক জন-সমাগম অনুষ্ঠানে তারা জাল নোট বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ব্যবহার করত। সম্প্রতি পূর্বাচলে আয়োজিত বাণিজ্য মেলা ও শীতকালীন প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন উৎসব ও মেলাকে কেন্দ্র করে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা তারা তৈরির পরিকল্পনা করে ছগির। এলক্ষ্যে দীর্ঘ সময় ধরে সে জাল টাকা তৈরি করে আসছিল। ২০১৭ সাল থেকে ১০ কোটি টাকা মূল্যমানের জাল টাকা তৈরি করেছে। ধরা পড়ার আশঙ্কায় অব্যবহৃত অংশ পুড়িয়ে ফেলা হতো
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে ছগির জাল নোট প্রিন্টিংয়ের সময় কাগজের অব্যবহৃত ও নষ্ট অংশগুলো পুড়িয়ে ফেলতেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যাতে তাকে ধরতে না পারে সে জন্য গ্রেপ্তার ছগির ঘন ঘন বাসা পরিবর্তন করতেন।
জাল টাকার কারবারে জড়িয়ে জেলে পাখির স্বামীও গ্রেপ্তার সেলিনা আক্তারের স্বামীও জাল নোট তৈরি চক্রের একজন সক্রিয় সদস্য। বর্তমানে তিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে জেলে আছেন। সেলিনা ঢাকা জেলার কামরাঙ্গীর চরে একটি বিউটি পার্লারের বিউটিশিয়ান। স্বামীর মাধ্যমে এ চক্রের মূলহোতা ছগিরের সাথে তার পরিচয় হয় এবং তিনি নিজেও এ চক্রে জড়িয়ে জাল নোট ব্যবসা শুরু করেন।
লাখ টাকার নোট ১৫ হাজারের বেশি দামে বিক্রি করতেন রুহুল। গ্রেপ্তার রুহুল আমিন চক্রের মূলহোতা ছগিরের অন্যতম সহযোগী। রুহুল আমীনের মাধ্যমে ছগিরের অন্যান্য সহযোগীদের পরিচয় হয়। রুহুল আমিন ও পাখি বিভিন্ন সময় ৫০০ টাকার জাল নোট বিভিন্ন হাসপাতাল ও মেডিকেলসহ ব্যস্ত এলাকায় নিজেরাই বিক্রি ও এক্সচেঞ্জ করেছেন। জাল নোট তৈরি ও বিক্রয়ের মামলায় ইতোপূর্বে ২০১৭ সালে জেলে ছিল এবং বর্তমানে তার নামে মামলা চলমান রয়েছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যে আরও বেশ ক’জন চক্রের সদস্যের নাম জানা গেছে। তাছাড়া স্থানীয় বাজারে জাল টাকার উপকরণ বিক্রেতাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ প্রতিনিধি রুহুল আমীন খন্দকার। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.