জীবনযুদ্ধে সফল নারী নাটোরের রুবিনা রহমান

 

নাটোর প্রতিনিধি: হাঁস-মুরগি, মাছ আর কৃষি উদ্যান তৈরি করে সফলতা পেয়েছেন নাটোর সদর উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের নারী উদ্যোক্তা রুবিনা রহমান । মাত্র চার বছরেই মিলেছে একাধিক স্বীকৃতি। সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নাটোর মহিলাবিষয়ক অধিদফতর রুবিনাকে দিয়েছে জয়িতা পদক।

ইউনিলিভার থেকে পেয়েছেন তোমার স্বপ্ন কর সত্যি ক্যাটেগরিতে দুই লাখ টাকার প্রাইজমানি। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের আয়োজনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছ থেকে ‘কৃষি উন্নয়নে নারীপদক পেয়েছেন রুবিনা। এখন কাজ করছেন নারী উদ্যোক্তার ক্ষেত্র সম্প্রসারণে। তবে এই পথ পাড়ি দিতে বহু বাধা পেরোতে হয়েছে রুবিনাকে।

নাটোর সদরের চাঁদপুর গ্রামের রুবিনা রহমান অভাব-অনটনের সংসারে বেড়ে উঠেছেন। ২০০৭ সালে বিএসএস শেষ বর্ষের পরীক্ষার্থী ছিলেন। ২০০৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বাবা আবদুর রহমানের মৃত্যুর পর অভাবে বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া। কৃষির ওপর জ্ঞান না থাকায় বাবার প্রায় ১০ বিঘা জমি ছিল অনাবাদি। বাধ্য হয়ে মায়ের সঙ্গে সেলাইয়ের কাজে যোগ দেন।

মা ও রুবিনার আয়ে কোনো রকমে সংসারের খরচ ও ছোট দুই ভাইবোনের লেখাপড়া চলতে থাকে। এরই মধ্যে ২০১১ সালের ২৯ এপ্রিল নোয়াখালীর সৌদি প্রবাসী হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে বিয়ে হয় রুবিনার। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি । শরীরের রঙ কালো হওয়ায় শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নির্যাতন সইতে হয়। বিয়ের ৩৪ দিনের মাথায় শ্বশুরবাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়।

আবার মায়ের সঙ্গে সেলাইয়ের কাজে যোগ দেন। তবে অভাব পিছু ছাড়ছিল না। সেলাই কাজ থেকে শুরু করে সংগৃহীত অর্থসহ অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানের ঋণে বাড়ির আঙিনায় শুরু করেন ব্রয়লার মুরগির খামার। সেখানেও দুর্ভাগ্য। মুরগি বিক্রি করে লোকসানে পড়েন। কিন্তু হার মানার নন রুবিনা। তার ভাষায়, ব্যবসায়ের লোকসানের মধ্যে লুকিয়ে থাকে মুনাফা।

নতুন উদ্যোমে শুরু করেন খামারের কার্যক্রম। শুধু মুরগির খামারই নয়, বাড়িসংলগ্ন পুকুরে শুরু করেন মাছ চাষ। সঙ্গে চালু করেন হাঁসের খামার । অসুস্থতা নিয়েও অফুরান জীবনী শক্তির অধিকারী রুবিনা। পর্যায়ক্রমে জমি ইজারা নিয়ে ফলের ছয়টি বাগান তৈরি করেন। এসব বাগানে ফলছে আম, লেবু, পেয়ারা, কলা, কুল, পেঁপে, মরিচ প্রভৃতি।

আমের তালিকায় আছে অপ্রচলিত গৌরমতি, ব্যানানা ম্যাঙ্গো। নাটোর হর্টিকালচার সেন্টার ড্রাগন ফলের ৪০টি খুঁটিতে ১২০টি ড্রাগনের প্রদর্শনী খামার স্থাপন করে দিয়েছে রুবিনাকে। ড্রাগনের বাগানে সাথী ফসল হিসেবে রুবিনা চাষ করেছেন টমেটো, কফি, শিম ও মরিচ।উপকরণের কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে রুবিনা প্রমাণ করেছেন, কোনো কিছুই অপ্রয়োজনীয় নয়।

মুরগির বিষ্ঠা দিয়ে তৈরি করছেন উৎকৃষ্ট জৈব সার-রিং ক¤েপাস্ট। প্রতি মাসে এখান থেকে তিন হাজার টাকা উপার্জন করেন। পাশেই উৎপাদন করছেন আরও একটি জৈব সার-ভার্মি পোস্ট। কারখানার উপরে শোভাবর্ধন করছে বেগুনি রঙের সিমের ফুল। বাড়ির শোভা বাড়িয়ে রেখেছে একঝাঁক কবুতর। এর বাণিজ্যিক দামও কম নয়।

রুবিনার বিশাল এই কর্মযজ্ঞে সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছেন ছোট ভাই রুবেল আর ছোট বোন রিমিকে। চার ুজন নিয়মিত শ্রমিক সহ অনিয়মিত ৩৫ জন রয়েছেন।রুবিনার কর্মযজ্ঞের স্বীকৃতি দিয়েছে সরকারি বিভিন্ন দফতর। তাদের আঙিনায় আইপিএম স্কুল পরিচালনা করে এলাকার ২৫ পরিবারের ৫০ সদস্যকে হাঁস-মুরগি পালন, গরু মোটাতাজাকরণ, সবজি চাষ, বসতবাড়ির বাগান প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও অর্থ সহায়তা দিয়েছে নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ।

রুবিনার নেতৃত্বে গঠিত চাঁদপুর নারী উন্নয়ন সমবায় সমিতির ২৫ সদস্য প্রশিক্ষণ শেষে সবাই সমবায় বিভাগ থেকে গাভী পালনের জন্য ঋণ পাচ্ছেন। রুবিনাকে সভানেত্রী করে মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের নিবন্ধনে গঠিত ইয়ুথ উইম্যান ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি সেলাই কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে।

নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারের অধীন বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পেরআওতায় রুবিনাকে কমিউনিটি হর্টিকালচার প্রোভাইডার মনোনীত করা হয়েছে। মাসে তিন হাজার টাকা সম্মানী ভাতায় কৃষিতে উদ্যোক্তা সৃষ্টির কাজ করছেন রুবিনা। এলাকার আট শতাধিক ব্যক্তিকে হর্টিকালচার সেন্টারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছাড়াও প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন।

ইতোমধ্যে তার হাতে তৈরি নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে সফল হয়েছেন হেনা বেগম, শাকিলাসহ বেশ কয়েকজন। হেনা বেগম বলেন, আমাদের নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছেন রুবিনা। রুবিনা বলেন, আমার পথ চলাতেই আনন্দ। পরিশ্রম করলে জীবনে সফলতা আসে তার বাস্তব প্রমাণ নিজেই।

অনেক দিন দরিদ্রতার কারণে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয়েছে আমার পরিবারকে। জীবনযুদ্ধে আজ আমি একজন সফল নারী হয়েছি পরিশ্রম করে। তিনি বলেন, কৃষি কাজে সদর উপজেলা কৃষি অফিসের সহযোগিতায় এতদূর এগিয়ে আসতে পেরেছি। বর্তমানে আমি প্রতি মাসে ৩৫-৪০হাজার টাকা আয় করতে পারছি। আমার পথ চলা সার্থক হবে, যদি সমাজের অবহেলিত নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে সামনে এগিয়ে নিতে পারি।

নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক মেফতাহুল বারি বলেন, রুবিনাকে কমিউনিটি হর্টিকালচার প্রোভাইডার মনোনীত করা হয়েছে। নতুন উদ্যোক্তা বিশেষত নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে ইতোমধ্যে সে তার কাজ শুরু করেছে।বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প এর পরামর্শক এসএস কামরুজ্জামান বলেন, রুবিনার মেধা আর কৃষি বিভাগের প্রয়োজনীয় সমর্থন ও সহযোগিতায় তিনি এখন সফল উদ্যোক্তা। সারা দেশে রুবিনার মতো উদ্যোক্তা তৈরি হলে দেশ হবে সমৃদ্ধ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.