জাপানের বাঙালি বধু হরিপ্রভা তাকেদা ও আন্তর্জাতিক বিবাহসুত্র


অর্ণব পাল সন্তু: শতবর্ষে বিস্মৃত নাম হরিপ্রভা তাকেদা (১৮৯০-১৯৭২)।  প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে তিনিই প্রথম জাপান যাত্রা করেন, বৈবাহিক সুত্রে।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি জাপানে বসবাস কালে টোকিও রেডিওতে  আজাদ হিন্দ ফৌজের সংবাদ পাঠিকার দায়িত্ব পালন করেন। সে হিসেবে নেতাজী সুভাষ বোসের একজন কর্মীও বটে।

যুদ্ধের পর তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে বসবাস করতে থাকেন।

তার শৈশবের কথা খুব বেশি জানা যায় না। তবে শোনা যায় তিনি ইডেন স্কুলে মেট্রিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। কিন্তু চৌকষ মেধাবী  সুলেখিকা সেই যুগেই  ১৯১৫ সালেই  তার ভ্রমণ কাহিনী ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’ লিখে রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। তখনও বিশ্বকবির ‘জাপানযাত্রী’ প্রকাশিত হয়নি।

হরিপ্রভার জন্ম ১৮৯০ সালে, ঢাকার খিলগাঁও এ, তখন এলাকাটি ছিল একটি প্রত্যন্ত  গ্রাম।

হরিপ্রভার প্রথম জাপান যাত্রার শতবর্ষে বাংলাদেশী চিত্রপরিচালক তানভীর মোকাম্মেল জাপান ফাউন্ডেশনের সহায়তায় হরিপ্রভার জীবনের উপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন।

তথ্যচিত্র থেকে জানা যায়,তাঁদের আদি বাড়ি ছিল শান্তিপুর।  সরকারি চাকরি নিয়ে ঢাকায় যান এবং সেখানেই নাগেন্দ্রবালাকে বিয়ে করেন।  শশিভূষণের ব্রাহ্ম হওয়ার পেছনে আরেকটি ছোট গল্প আছে। একদিন তিনি শহরের অদূরে জঙ্গলে একটি শিশুকে কুড়িয়ে পেয়ে ঘরে নিয়ে আসেন এবং তাঁকে পালন করবেন বলে স্থির করেন। এই ঘটনায় তাঁকে হিন্দুসমাজ থেকে পতিত হতে হয় এবং তিনি ধর্ম পরিবর্তন করে ব্রাহ্ম হন।  শুধু তাই নয়, তিনি ঢাকায় এই ধরণের অনাথ শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন উদ্ধারাশ্রম, পরে যার নাম হয় ‘মাতৃ নিকেতন’।

দেশের উন্নতির জন্য শশীভূষণ বিভিন্ন ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।  এর মধ্যে একটি হলো হলো দেশীয় পুঁজির ভিত্তিতে দেশীয় শিল্প গড়ে তোলা।  এই চিন্তা থেকে তিনি ঢাকায় একটি সাবান কারখানা স্থাপন করেন ।

শশিভূষণের আরেকটি বিশ্বাস ছিল যে ভারতকে যদি উন্নতি করতে হয়, তবে দেশের মানুষের মধ্যে  আন্তর্জাতিক চেতনা গড়ে তুলতে হবে এবং সেই চেতনাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য আরও বেশি করে আন্তর্জাতিক নাগরিকদের মধ্যে বিবাহের উৎসাহ দেওয়া উচিত।

এই দ্বিতীয় ধারণাটির থেকেই মনে হয় বড় মেয়ে হরিপ্রভার সঙ্গে উয়েমন তাকেদার বিয়ের প্রস্তাব করেন তিনি। হরিপ্রভার সঙ্গে উয়েমনের বিয়ে হয় ১৯০৪ সালে, পরিবারের ব্যবস্থাপনায় এবং হরিপ্রভার সম্মতিতে ।  হরিপ্রভা মল্লিক হয়ে উঠেন হরিপ্রভা তাকেদা।  প্রায় ৮ বছর ঢাকায় কাটিয়ে তাকেদা দম্পতি প্রথমবার জাপান যাত্রা করেন ১৯১২ সালে।

ছোটবেলা থেকেই মায়ের সাথে মাতৃনিকেতন দেখাশোনা করতেন হরিপ্রভা। এখানেই হরিপ্রভার সাথে পরিচয় হয় ঢাকার বুলবুল সোপ ফ্যাক্টরির প্রধান রসায়নবিদ ওয়েমন তাকেদার। সম্পর্ক ক্রমেই প্রণয়ে পরিনত হয়।

সেই আমলে জাপানি সমাজে পৈতৃক সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হতেন বড় ছেলে।  তাই অনেক জাপানি ভাগ্যন্বেষণে পাড়ি দিতেন দূরদূরান্তের দেশে।   ১৯০৩ সালে ২৪ জন জাপানি নাগরিক ভারতে এসেছিলেন কাজের খোঁজে – যার মধ্যে একজন ছিলেন উযেমন তাকেদা ।

১৯০৭ সালে দুই পরিবারের সম্মতিতেই ব্রাহ্মসমাজের নিয়মানুসারেই তাদেরর বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহের পর ওয়েমন তার শ্বশুর শশীভূষণ মল্লিকের সহযোগিতায় ঢাকা সোপ ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেন।

এ প্রতিষ্ঠানের আয়ের কিছু অংশ ব্যায়িত হত মাতৃনিকেতনে।

বছর খানেক পরে ঢাকা সোপ ফ্যাক্টরি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। ওয়েমন তখন ব্যবসার পাট চুকিয়ে সস্ত্রীক জাপানে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন।  এখান থেকেই শুরু হয় হরিপ্রভার জাপান যাত্রা।

হরিপ্রভার জাপান যাত্রার খবর প্রকাশিত হয়েছিল তৎকালীন সংবাদপত্রে। খবর প্রকাশের সাথে দেশে হইচই পড়ে যায়।

দিনাজপুরের মহারাজা ও ঢাকাস্থিত জনৈক জাপানি ব্যবসায়ী কোহারা তাদের জাপান যাত্রার কথা শুনে ২৫ ও ৫০ টাকা উপহার দেন। ঢাকার নববিধান ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে তাদের যাত্রার শুভকামনা করে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।

৩ নভেম্বর ১৯১২ হরিপ্রভা ও ওয়েমান ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টীমারে গোয়ালন্দ। গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে কলকাতা। ৫ নভেম্বর তারা কলকাতা থেকে জাহাজে করে জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তারা জাপানের পোর্ট মোজিতে পৌঁছন ১৩ ডিসেম্বর। হরিপ্রভার জাপানে আগমন সংবাদ জাপানের দু’টি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।

হরিপ্রভা তার প্রথম জাপান সফরে চার মাস কাটান। এই সময়ে তিনি শুধু তার শ্বশুরবাড়িই নয় জাপানের সমাজ ব্যবস্থাকেও খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান।  কল্পনা করুন ১০০  বছর আগের জাপান।

১৮৬৮ সালে জাপানে আধুনিক কালের সূচনালগ্ন হিসেবে গন্য করা হয়। সে বছর এক বিপ্লবী অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে সামুরাই যোদ্ধা সম্প্রদায়ের তোকুগাওয়া শোগুন গোষ্ঠীর আধিপত্যের অবসান ঘটে প্রতিষ্ঠিত হয় সম্রাটের সর্বময় কর্তৃত্ব ।

সেই সময়ের তরুন সম্রাট মুৎসুহিতোকে ঘিরে আধুনিক চিন্তার যেসব মানুষজন সমবেত হয়েছিলেন, মূলত তাদের সক্রিয় প্রচেষ্টাতেই দীর্ঘদিনের স্ব-আরোপিত বিচ্ছিন্নতার বেড়াজাল ছিন্ন করে জাপান বাইরের বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার উদ্যোগ নেয়।

এ প্রবণতার ফলে কেবল শিল্পায়নের পথেই মেইজি যুগের জাপান যাত্রা করেনি, পাশাপাশি রাজনীতি ও সামাজিক আচার আচরণে দেখা যায় পশ্চিমের নানা চিন্তা-মতবাদের প্রবেশ। (বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা- হরিপ্রভা তাকেদা, ভূমিকা: মনজুরুল হক) তিনি জাপানের সামাজিক রীতিনীতির খুঁটিনাটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন ও ভারতীয় সমাজের রীতিনীতির সঙ্গে তা তুলনা করতে থাকেন।

১২ এপ্রিল ১৯১৩ তারা ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

তার লেখায় ফুটে উঠেছে তৎকালীন জাপানের নানা অবস্থা, সংস্কৃতি, পরিবর্তনের কথা। তাকে একনজর দেখার জন্য ভীড় জমে যেত। জাপানি খাবারে অরুচি দেখা দিত, পরে নিজেই বাঙালি খাবার রান্না করতে লাগলেন। পেয়েছেন শ্বশরবাড়ির ভালবাসা।
তিনি লিখেছেন“বিদেশে এমন সরল স্বভাব, স্নেহপরায়না শ্বশুর শ্বাশুড়ি ঠাকুরানীর মার মতো যত্ন-ভালোবাসা পাইয়া ইহার সহিত বাস করিতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু সে সম্ভাবনা কোথায় ? ”

দেশে ফেরার পর তিনি ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’ নামে একটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত লেখেন। সেখানে তিনি তার সমুদ্রযাত্রা, শ্বশুরবাড়ির আতিথেয়তা, ভারতীয়দের নিয়ে জাপানিদের ঔৎসুক্য, জাপানের সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে লেখেন। ১৯১৫ সালে মাতৃনিকেতনের সহায়তায় তার ভ্রমণ বৃত্তান্তটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে।

‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’ ছাড়াও তিনি ‘সাধ্বী জ্ঞানদেবী’ এবং ‘আশানন্দ ব্রহ্মনন্দ কেশবচন্দ্র সেন’ নামে আরও দুটি বই  লিখেছিলেন। ‘জাপানে সন্তান পালন ও নারীশিক্ষা’ শিরোনামে ভারতবর্ষ পত্রিকায় তার একটি নিবন্ধও ছাপা হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জাপান সরকার ভারতে অবস্থানকারী সমস্ত জাপানি নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে নেয়। ১৯৪১ সালে হরিপ্রভা তার স্বামীর সাথে পাকাপাকিভাবে জাপান চলে যান। যুদ্ধকালীন সময়ে জাপানের অর্থনৈতিক সঙ্কট চলছিল।

জাপানে তাদের বাসস্থান বা উপার্জন কিছুই ছিল না। এর মধ্যে ওয়েমন অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময় হরিপ্রভার পাশে দাঁড়ান রাসবিহারী বসু। তার মাধ্যমে হরিপ্রভা নেতাজীর সাথে পরিচিত হন। নেতাজী হরিপ্রভাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন।

রাসবিহারী বসুর মধ্যস্থতায় হরিপ্রভা ১৯৪২ সালে টোকিও রেডিওতে আজাদ হিন্দ ফৌজের হয়ে বাংলায় সংবাদ পাঠিকার চাকরি পান। সেই সময় টোকিও শহরে মিত্রবাহিনীর বোমাবর্ষণ অব্যাহত ছিল। সেই পরিস্থিতে প্রতি রাতে হরিপ্রভা হেলমেট মাথায় দিয়ে টোকিও রেডিও স্টেশনে যেতেন। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের হয়ে বাংলায় সংবাদ পাঠ করেছিলেন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা তিনি লিখে গেছেন তার আত্মকথা “যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানে”-র পাতায়।

নেতাজির সঙ্গে সাক্ষাতের দিনটির বিবরণ পাই আমরা হরিপ্রভার লেখায়।

“২৪শে নভেম্বর নেতাজির নিমন্ত্রনে আমরা ইম্পেরিয়াল হোটেলে যাই। … তথায় পৌঁছনো মাত্র টোকিওতে প্রথম বিমান আক্রমণের সাইরেন বেজে ওঠে। ৩টেয় রেইড বন্ধ হলে হোটেলে ফিরে গিয়ে নেতাজির সঙ্গে আহার করি। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আলাপ আলোচনা হয়।”

যুদ্ধ শেষে ১৯৪৭ সালে হরিপ্রভা তার অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে দেশে ফেরেন। তার জন্মস্থান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তিনি পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে বোনের বাড়িতে ওঠেন। সেখানেই ১৯৪৮ সালে উয়েমেন তাকেদা মারা যান।

উত্তর বঙ্গেই বাকি জীবনটা কাটিয়েছিলেন হরিপ্রভা একজন সাধারণ বিধবার মতো । কোনোদিন নিজের অতীত জীবন নিয়ে জনসমক্ষে আলোচনার উৎসাহ দেখাননি। চাননি টেনে নিতে নিজের দিকে প্রচারের আলো। হাতও পাতেননি কোনো সরকারের কাছে নিজের দেশভক্তির প্রতিদানের জন্য।

১৯৭২ সালে কলকাতার শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সুত্র: তানভীর মোকাম্মেলের ‘জাপানি বধু’ প্রামাণ্যচিত্র ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা- হরিপ্রভা তাকেদা, (ভূমিকা ও সংগ্রহ: মনজুরুল হক), সাহিত্য প্রকাশ , ২য় প্রকাশ ১৯৯৯, ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী – ২য় খন্ড; মুনতাসীর মামুন, ১০৫ বছর আগে ‘বঙ্গ মহিলার জাপান যাত্রা’, একজন ‘সামান্য’ গৃহবধূর সফরনামা , ছন্দক গুহ, বঙ্গদর্শন,  ৮ এপ্রিল ২০২০। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.