জলবায়ু পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জ কী? কীভাবে এবং কেন ঘটছে?

বিটিসি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ডেস্ক: ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ বা ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ’ ইদানিং এ বিষয়টি প্রচুর শোনা যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হচ্ছে এটি। এনিয়ে গবেষণা, সম্মেলন, প্রতিবেদন, টক শো বা গোলটেবিল বৈঠক হচ্ছে প্রতিদিনই। শুধু এগুলোই নয়, এ গণ্ডি ছাড়িয়ে এটা এখন মাঠপর্যায়ে আন্দোলনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু বিষয়টি আসলে কী?- তার একটা ধারণা আমাদের সবারই থাকা উচিত। কারণ পৃথিবী ধীরে ধীরে যেদিকে ধাবিত হচ্ছে তাতে সবারই প্রত্যেকের জায়গা থেকে সচেতন হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
জলবায়ু পরিবর্তন কী?
কোনও একটি জায়গায় বছরের পর বছর ধরে আবহাওয়ার যে গড়-পড়তা ধরন, তাকেই বলা হয় জলবায়ু। সেই আবহাওয়ার চেনাজানা ধরন বদলে যাওয়াকেই বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন।
গরমের সময় অতিমাত্রায় গরম এবং শীতের সময় প্রচুর পরিমানে শীত পৃথিবীকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। আবহাওয়ার বহুদিনের চেনাজানা আচরণ এখন অচেনা রূপ ধারণ করেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ুর এই পরিবর্তনে বদলে যাবে আমাদের জীবন যাপন। দেখা দেবে পানির সঙ্কট, কঠিন হয়ে পড়বে খাদ্য উৎপাদন। কোনো কোনো অঞ্চল বিপজ্জনক মাত্রায় গরম হয়ে পড়বে এবং সেই সাথে সমুদ্রের পানি বেড়ে বহু এলাকা প্লাবিত হবে। ফলে সেসব জায়গা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
অতিরিক্ত গরমের পাশাপাশি ভারি বৃষ্টি এবং ঝড়ের প্রকোপ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকবে। ফলে জীবন এবং জীবিকা হুমকিতে পড়বে। গরীব দেশগুলোতে এসব বিপদ মোকাবেলার সক্ষমতা কম বলে তাদের ওপর এই চরম আবহাওয়ার ধাক্কা পড়বে সবচেয়ে বেশি।
তাপমাত্রা বাড়ায় উত্তর মেরুর জমাট বাধা বরফ এবং হিমবাহগুলো দ্রুত গলে যাচ্ছে। ফলে সাগরের উচ্চতা বেড়ে উপকুলের নিচু এলাকাগুলো ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। এছাড়া সাইবেরিয়ার মত অঞ্চলে মাটিতে জমে থাকা বরফ গলতে থাকায় বরফের নিচে আটকে থাকা মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে, মিথেনের মত আরেকটি গ্রিনহাউজ গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে।
পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ার ফলে বন-জঙ্গলে আগুন লাগার ঝুঁকি বাড়বে। অনেক প্রাণী তাদের চির চেনা বসতির আবহাওয়া বদলের জেরে নতুন জায়গায় চলে যাবে বা যাওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু জলবায়ুর এই পরিবর্তন এত দ্রুত হারে ঘটছে যে অনেক প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে বরফ গলতে থাকায় পোলার বিয়ার বা উত্তর মেরুর শ্বেত ভালুকের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি, আটলান্টিক মহাসাগরের স্যামন মাছ বিপন্ন হবে, কারণ যেসব নদীতে ঢুকে তারা ডিম পেড়ে বাচ্চার জন্ম দেয়, সেগুলোর পানি গরম হয়ে যাচ্ছে।
ট্রপিক্যাল অঞ্চলের কোরাল রিফ বা প্রবাল-প্রাচীর উধাও হয়ে যেতে পারে, কারণ বায়ুমণ্ডলের অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড সাগরের পানিতে মিশে পানির অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
কেন এই জলবায়ু পরিবর্তন?
প্রাকৃতিক কারণে জলবায়ুতে স্বাভাবিকভাবেই কিছু পরিবর্তন হয়। কিন্তু যে মাত্রায় এখন তাপমাত্রা বাড়ছে তার মানুষের কর্মকাণ্ডেই প্রধানত দায়ী। মানুষ যখন থেকে কল-কারখানা এবং যানবাহন চালাতে বা শীতে ঘর গরম রাখতে তেল, গ্যাস এবং কয়লা পোড়াতে শুরু করলো সেই সময়ের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা এখন ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে।
বায়ুমণ্ডলে অন্যতম একটি গ্রিন হাউজ গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ উনবিংশ শতকের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে।। গত দুই দশকে বেড়েছে ১২ শতাংশ।
এছাড়া বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণেও বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে। গাছপালা কার্বন ধরে রাখে। ফলে, সেই গাছ যখন কাটা হয় বা পোড়ানো হয়, সঞ্চিত সেই কার্বন বায়ুমণ্ডলে নিঃসরিত হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভবিষ্যত
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শিল্প বিপ্লব শুরুর আগে বিশ্বের যে তাপমাত্রা ছিল তার থেকে বৃদ্ধির মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা গেলে বড় ধরণের বিপদ এড়ানো যাবে। তা না পারলে বিপজ্জনক হয়ে পড়বে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবন।
অনেক বিজ্ঞানীর আশঙ্কা যে ভয়ঙ্কর এই পরিণতি ঠেকানোর আর কোনো উপায় নেই এবং চলতি শতকের শেষে গিয়ে বিশ্বের তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। আর তা হলে এর প্রভাব বিশ্বের একেক জায়গায় একেক রকম হবে।
একারণে ব্রিটেনে বৃষ্টিপাতের মাত্রা প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গিয়ে ঘনঘন বন্যা হবে। সাগরের উচ্চতা বেড়ে প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ছোট অনেক দ্বীপ বা দ্বীপরাষ্ট্র বিলীন হয়ে যেতে পারে। আফ্রিকার অনেক দেশে খরার প্রকোপ বাড়তে পারে এবং পরিণতিতে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে। অস্ট্রেলিয়ায় অতিরিক্ত গরম পড়তে পারে এবং খরার প্রকোপ দেখা দিতে পারে।
বিজ্ঞানীরা কী করছেন?
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে এবং বিষয়টি সম্পর্কে জ্ঞান বাড়ছে। কোনও একটি জায়গায় আবহাওয়ার চরম আচরণ যেমন অতিবৃষ্টি বা অতিরিক্ত গরমের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের যোগাযোগ খুঁজে পেতে বিজ্ঞানীরা এখন সমর্থ হচ্ছেন। ফলে, এধরনের চরম আবহাওয়ার পূর্বাভাস ভবিষ্যতে সহজতর হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মানুষের করণীয় কী?
বনভূমি বা বৃক্ষ কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ খ্যাত আমাজনের চিরহরিৎ বন থেকে। তার থেকেও বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয় এই বনভূমি। প্রায় ২০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে ৭০ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশাল এই বনাঞ্চল। তাই যত বেশি সম্ভব সবাইকে গাছ রোপন করতে হবে। একইসঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সাইকেল বা জনপরিবহনের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। তাছাড়া বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহারও জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে ভূমিকা রাখতে পারে।
রাষ্ট্রের করণীয় কী?
বিশ্বের সকল দেশকে এক সঙ্গে এ জন্য কাজ করতে হবে। তারা যদি বর্তমান শতকের মাঝামাঝি অর্থাৎ ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারে, অর্থাৎ যেটুকু গ্যাস নিঃসরিত হবে তা অতিরিক্ত গাছ লাগানোর মত ব্যবস্থা নিতে পারে তবে ভারসাম্য রাখা সম্ভব হবে।
দেশগুলো যদি তা করতে পারে তাহলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির দ্রুত গতি কমিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর পরিণতি এড়ানো যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। (সূত্র: বিবিসি বাংলা)। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.