ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ, এ দায় কার?

রাবি প্রতিনিধি: ৫২,৬২,৬৬,৬৯,৭০,৭১’র মুক্তিযুদ্ধ থেকে নব্বইয়ের পূর্ব পর্যন্ত সময় গুলিতে শিক্ষার্থীরাই দেশের অন্যায় অবিচার রুখতে নিজেদের অধিকার আদায়ে রাজপথে দাড়িয়েছে এককাতারে। কিন্তু নব্বইয়ের পরবর্তী সময়ে যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তখন সে সরকারের দলীয় লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতির চর্চার কারনে ছাত্রসংগঠন গুলো হুমকির পথে প্রবাহিত হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি শিক্ষকদের সরাসরি রাজনীতি করার নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশে নেই। তারপরও দলীয় প্রভাব থেকে বের হতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা যাচ্ছে দুর্নীতি অনিয়মের মত নানা কর্মকান্ড। তাহলে এ দায় কার? রাজনীতির নাকি ছাত্র রাজনীতির?
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যায় ঘটনায় ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়েছে দেশবাসীকে। এ ঘটনায় প্রশ্নের মুখে ফেলেছে দেশের রাজনীতি সংস্কৃতিকে। এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করেছে বুয়েট প্রশাসন। এ নিয়ে নিন্দা জানিয়েছে অধিকাংশ ছাত্র সংগঠন।
রাজনীতির দোড়ঝাঁপে কি পাচ্ছে বর্তমান ছাত্র রাজনীতি বা কী হারাচ্ছে ছাত্ররাজনীতি। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ, এটা কী আদৌও সম্ভব! এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক। গোলাম ফারুক সরকার টুকু। সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়। আমিরুল ইসলাম কনক। সহকারী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এম আব্দুল আলীম বাবু। সহকারী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
আমিরুল ইসলাম কনক
সহকারী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দায় কার? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একটু পেছনে যেতে হবে। নব্বইয়ের দশকের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির অধ্যায় অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। তখন ছাত্র রাজনীতি ছিল মূল রাজনীতির অগ্রণী চিন্তার পাওয়ার হাউস। ভাষার অধিকার, জাতীয়তাবাদ, অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি, স্বাধিকার, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র পুণরুদ্ধার, সামরিক স্বৈরাচার পতন প্রভৃতি আন্দোলনের বাতিঘর ছিল ছাত্র রাজনীতি। নব্বইয়ের গণ আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থার প্রচলন ঘটলেও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ৭৫ পরবর্তী সামরিক-স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার যে বৈধতা দেওয়া হয় তা ছিল আত্মঘাতী।
এর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনকে দলীয় রাজনীতির স্বৈরাচারী শাসনে পরিণত করা হয়। কার্যত সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলোকে লেজুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে শাসকদলের আজ্ঞাবহ করে রাখা হয়। এর ফলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলের পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হয় সরকার সমর্থিত ছাত্রসংগঠনগুলো। সকল প্রকার সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অপরাধ করেও যখন রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে, তখন অপরাধপ্রবণ সংগঠনগুলো অধিকতর বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
ছাত্রনেতাদের দাপট এবং আধিপত্যমূলক মনোভাবের কারণে সংগঠন হয়ে ওঠে বেপরোয়া ও অপ্রতিরোধ্য। ভিন্নমতকে দমন ও ক্ষমতাচর্চার মাধ্যমে দুর্নীতির হাতেখড়িও হয় এখান থেকেই। শিক্ষাঙ্গণে ছড়িয়ে পড়ে ত্রাসের রাজত্ব। চাঁদাবাজি, খুণ, হত্যা, ধর্ষণের মতো ঘটনা হয়ে ওঠে নৈমিত্তিক। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির প্রকৃত ছাত্র রাজনীতি তখন হয়ে পড়ে অসহায়। দাবি ওঠে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার। কাজেই, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দায় বর্তায় বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন মূল রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরেই।
গোলাম ফারুক সরকার টুকু
সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
পচন ধরেছে রাজনীতিতে, সেটার দায় ছাত্ররাজনীতিকে দিয়ে খালাস পাওয়া যাবে না। কিশোর ছাত্রদের রাজনীতির বোধ কতটা প্রখর তা নাড়া দিয়েছিল সড়ক আন্দোলনের সময়। বড়দের সেই বোধ তো ভাষা আন্দোলন থেকে এখনও লক্ষ্যণীয়। রাজনীতিতে যে দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে সেটার ক্ষমতা কেন্দ্রিক আস্ফালনের সংস্কৃতিকে যদি আমরা ‘ছাত্ররাজনীতি’ বলে ছাত্রদের রাজনীতিকে থামিয়ে দেই তাহলে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক বৈষম্য প্রতিরোধে কে দাঁড়াবে? যেসকল ছাত্ররা প্রতিরোধের রাজনীতি নিয়ে এগিয়ে যায় তাদের তো থামিয়ে দেয়াটা আরও সহজ হয়ে উঠবে। কারণ, ‘তোমাদের এসব করা তো বারণ’ এই অজুহাত সামনে আনা হবে। তখন হবেটা কী?
মেধাবী সন্তান তো আমরা একজন হারাইনি, সাথে ২২ জন পচনধরা রাজনীতির শিকার হয়ে যে শেষ হতে যাচ্ছে তার দায় কী আমরা এড়িয়ে যাব? ছাত্রদের রাজনীতিতে আনাড়ি ভেবে বড়দের ছলাকলা মার্কা রাজনীতি জায়েজ করা এবং সেই ছলাকলায় ছাত্ররাজনীতি মিশিয়ে ফেলাও হবে আত্মঘাতী। রাজনীতির পচন ঠেকাতে রাজনীতিকে দেশের সমৃদ্ধির পথে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে না পারাটাই চরম ব্যর্থতা। ছাত্রদের রাজনীতি ছাত্রদের স্বাধীন চিন্তা এবং বোধের উপর ছেড়ে দিন। অর্থ, পদের লোভ-লালসায় তাদেরকে পর্যবসিত করবেন না, তাদের রাজনীতিকে বন্ধ করবেন না। যা বন্ধ করলে ছাত্রদের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর হবে সেটাই বন্ধ করুন, প্লিজ।”
এম আব্দুল আলীম বাবু
সহকারী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতি শিক্ষার্থীদের কারো কারো যে একটা অবস্থান দেখা যাচ্ছে তার মূল কারণই হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা মনে করছেন এই রাজনীতি তাদের কোন কাজে আসছে না। এক্ষেত্রে অবশ্য যে সরকার ক্ষমতায় আসে তার সহযোগী সংগঠনের নাম গুলোই আসে। আমি মনে করি, শিক্ষার্থীদের সাথে থেকে তাদের অধিকার আদায়ে কথা না বলা অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতন চালানো, দুর্নীতি, হত্যাকান্ড সহ বিভিন্ন কারণে ছাত্র সংগঠনগুলোর উপর আস্থা কমে আসছে শিক্ষার্থীদের। ছাত্র সংগঠনগুলো বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত হয়েছে এর দায় অবশ্যই দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির, এটি দলের নয়।
ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা কোন সমাধান নয়। শিক্ষার্থীদের অধিকার, দেশের স্বার্থে কথা বলার জন্যই ছাত্র রাজনীতি থাকতে হবে। বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদে যুগে যুগে ফুঁসে উঠেছে ছাত্র সমাজ। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির যে ঐতিহাসিক গতিধারা সেটার বর্তমান ছাত্ররাজনীতিতে বিচ্যুতি ঘটেছে। রাজনীতিতে সবকিছুর নিয়ন্ত্রন এবং সবার উপর আধিপত্য বিস্তার জাতীয় পর্যায় থেকে আসে। সুতরাং পরিবর্তনটা সবার আগে সেখান থেকেই আসতে হবে। তবে অপরপক্ষে শিক্ষকদেরও দলীয় রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে সুস্থ শিক্ষাঙ্গন গড়ার লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করতে হবে  আমি মনে করি।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর রাবি প্রতিনিধি মো: মুজাহিদ হোসেন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.