চোখের জলে নাটোর থেকে এক কর্মবীরের বিদায়

বিশেষ (নাটোর) প্রতিনিধি: নাটোর জেলার মানবিক ও জনবান্ধব জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ এর শেষ কার্যদিবস ছিল আজ। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, আগামী দু-একদিনের মধ্যেই তিনি আগামী কর্মস্থল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগে উপসচিব হিসাবে যোগদান করবেন।
২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর নাটোরের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করে বিগত দিনগুলোতে বিভিন্ন সময়োপযোগী কার্যক্রমের ফলে পাল্টে গেছে জেলার সার্বিক চিত্র।
যোগদান করে প্রথমেই তিনি গুরুত্ব দিলেন সরকারি দপ্তর সমূহের মধ্যে সমন্বয় ও গতিশীলতা বৃদ্ধির দিকে। নজর দিলেন প্রশাসনিক কাজে স্বচ্ছতা আর সহকর্মীদের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায়। নাগরিকদের কাংখিত সেবা প্রাপ্তির পরিবেশ সৃষ্টিতে জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে তুলতে জোড়ালো ভূমিকা রাখলেন।
তার কার্যালয়ে সেবা প্রত্যাশিদের সহজ প্রবেশাধিকার জনতুষ্ঠির অন্যতম একটি দিক।পদক্ষেপ নিলেন সরকারি অর্থের অপচয় রোধ ও আর্থিক শৃংখলার প্রতি।
জেলার সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নজর রাখা, বর্তমান পরিস্থিতিতে চলমান করোনা প্রতিরোধে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালে করোনা ইউনিট চালু, সদর হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিয়মিত চিকিৎসা প্রদান করার তদারকি, জেলার গরীব ও দুঃখী মানুষের জন্য জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে প্রতি বুধবার গণশুনানিতে আর্থিক সহায়তা, সেলাই মেশিন প্রদান, করোনা কালীন সময়ে জেলার ৭ উপজেলায় সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সরকারি ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান, শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে স্কুল-কলেজগুলোতে আকষ্মিক পরিদর্শন, বঙ্গবন্ধু জীবনী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রকাশনা, সরকারী বালক বালিকা স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠু সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা, প্রতিটি অফিসে সেবার মান বৃদ্ধি এবং ভোগান্তি কমানো, মুজিব বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে মাসব্যাপী সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও আলোচনা সভা, জেলায় গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাদের ও প্রকৃত গৃহহীনদের মধ্যে গৃহ প্রদান, সরকারি বিভিন্ন চলমান প্রকল্প অগ্রগতি পর্যালোচনা, সার্কিট হাউস থেকে অক্ট্রয় মোড় পর্যন্ত হযরত শাহজালাল রোড স্থাপন করা হয়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদ গুলোর কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, জেলার অধিকাংশ জায়গায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, প্রকৃত কৃষকের মধ্যে উপকরণ বিতরণ, বৃক্ষরোপণ অভিযান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মিড ডে মিল চালু, প্রকৃত হতদরিদ্রদের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়া, প্রতি সপ্তাহে ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা, হাট বাজারগুলো আধুনিক করা, স্থানীয় সরকার বিভাগের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা বজায় রাখা, প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে খাস জমি বন্টন, ভিক্ষুকমুক্ত করণে ডাটাবেজ তৈরি, পর্যটন কেন্দ্র চালু করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের আগের চিত্র পরিবর্তন করে নতুন সাজে রূপান্তরিত করেন। ভূমি সেবাকে সহযোগীকরন, বাল্য বিবাহের হার প্রায় শূন্যতে আনেন প্রভৃতি কাজের জন্য পাল্টে গেছে পুরো জেলার চিত্র।
বিশেষ করে আদিবাসী ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রশংসনীয় কাজ করেছেন ‘ নিজে উপস্থিত থেকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হলেও সরকারি বিভিন্ন আদেশে অভিযান পরিচালনা করছেন।
ক্রিড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে উজ্জিবীত করে যুবসমাজ ও সামাজিক সংগঠন সমূহকে ব্যাপকভাবে সামাজিক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করার প্রয়াস বিশেষভাবে লক্ষণীয়। শুধু পৃষ্ঠপোষকতাই নয় নিজে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে তিনি ইতিমধ্যে যুবসমাজের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন।
জেলা প্রশাসক মোঃ শাহরিয়াজ স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোরীদের জন্য যেন একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক। বিশেষ করে বাল্য বিবাহ থেকে কিশোরীদের রক্ষা করতে তার রয়েছে জোড়ালো পদক্ষেপ। গভীর রাত্রেও তার মুঠোফোনে কল আসে কোন অপ্রাপ্ত বয়সী কিশোরীর কাছ থেকে, অপরিণত বয়সে বিয়ের হাত থেকে উদ্ধার করতে। রাতেই তিনি ছুটে যান প্রত্যন্ত গ্রামে দায়িত্ব পালনে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করে এরই মধ্যে তিনি বাল্যবিবাহমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় তার বরাদ্দের সঠিক বন্টনে যথাযথ নীতিমালা অনুসরণ করে তিনি প্রকৃত সেবা গ্রহীতাদের আস্থা অর্জনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। স্থানীয় সরকার কাঠামোকে শক্তিশালী করে সেবার মান বাড়াতে তার উদ্যোগ লক্ষনীয়। ভিজিএফ, ভিজিডি, ওএমএস, কাবিখা, কাবিটাসহ সরকারের সকল বরাদ্দের সুষ্ঠু বন্টনের তিনি নজির স্থাপন করেছেন।
সাম্প্রতিককালে মরণব্যাধি করোনাভাইরাস রোধে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে কাজ করেছেন কখনও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, কখনো প্রতিরোধে প্রচারণা, কখনো আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাসায় থাকার জন্য হোম কোয়ারেন্টেইন দেখাশোনা করা, রোগীদের নিয়মিত খোঁজ রাখা, রোগীর বাসায় গিয়ে খাদ্য সামগ্রী প্রদান, বিভিন্ন ইউনিয়নে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ দেখভাল কাজ করায় জেলা বাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। করোনার শুরুতে নিম্নবিত্তদের কথা ভেবে কিস্তি বন্ধ করে প্রশংসিত হোন । করোনার এই দীর্ঘ সময়ে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জেলা প্রশাসক মোঃ শাহরিয়াজ যে অবদান রেখেছেন তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ।
এমন করেই মোঃ শাহরিয়াজ নাটোরের সকলের কাছে হয়ে উঠেছিলেন আস্থাভাজন জেলা প্রশাসক আর জনবান্ধব মাঠ প্রশাসনের অনন্য প্রতীক। একজন ‘মানবিক জেলা প্রশাসক’ হিসাবে পরিচিতি নিয়েই বিদায় নিলেন । তিনি সবচেয়ে বেশি মানুষের হৃদয়ে স্থান পেয়েছেন।
এরকম জনবান্ধব জেলা প্রশাসকের বিদায়ে অনেকেই ব্যথিত হয়েছেন। কেউ কেউ তাকে আবারও নাটোরে ফিরে পাওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন। আপনার কর্ম এবং সেবার মাধ্যমে আপনি সবার মাঝে ভাস্বর হয়ে থাকবেন। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন স্যার।“ করোনার এই খারাপ সময়ে আপনাকে নাটোরবাসী খুব মিস করবো স্যার। নিজের খেয়াল রাখবেন।
বিদায় অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতায় আর হাটে-মাঠে-ঘাটে ও উপজেলার প্রতিটি প্রান্তরে তাঁকে নিয়ে সাধারণ মানুষের যে আলাপচারিতা তাতেই বোঝা যায় তিনি কতটা জনপ্রিয় অফিসার ছিলেন সকলের কাছে।
জেলার কয়েকজন সচেতন লোকের সাথে কথা বলে জানা যায়, তার ফলেই অফিসগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতি ও ভোগান্তি কমেছে এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। যা না বললে নয় তিনি যে সৎ, যোগ্য, কর্মঠ দক্ষতার বলিয়ান তা তার কাজ প্রমাণ করে। “নাটোরবাসী আপনাকে অনেক মিস করবে স্যার। দোয়া, ভালোবাসা ও অভিনন্দন। ”নাটোর জেলাবাসী আপনাকে আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ (নাটোর) প্রতিনিধি মো. নাসিম উদ্দিন নাসিম। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.