চীন ও ভারতের সীমান্ত স্থাপনা তৈরিতে ঝুঁকি বাড়ছে হিমালয়ে

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে দিন দিন বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এরজন্য মূলত মানুষই দায়ী। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মানব জাতিই প্রকৃতির ক্ষতি করে চলেছে। যার মাশুলও দিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
তবে তারপরেও প্রকৃতির ক্ষতি করা বাড়ছে বৈ কমছেনা। সম্প্রতি চীন ও ভারত যেভাবে তাদের সীমান্ত স্থাপনা তৈরি করছে তাতে হুমকির মুখে হিমালয় পর্বতমালা।
ভারতের উত্তরাঞ্চলে হিমালয়-ঘেঁষা শহর জোশীমঠের ভূমি এবং আশেপাশের এলাকায় ফাটল দেখা দেয়ার পর বেশ কয়েকদিন ধরেই সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে উঠেছে বিষয়টি। শহরটি ডুবে যাচ্ছে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিজ্ঞানীরা বলছেন, হিমালয় ঘিরে আরও বড় একটি ভয়ের বিষয় আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।
তারা বলছেন, হিমালয় অঞ্চল ঘিরে যে হারে ভারত এবং চীন নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরি করতে শুরু করেছে, তাতে বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
সেই সঙ্গে বৈশ্বিক জলবায়ুর উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণে হিমালয় অঞ্চলের নাজুক ইকো সিস্টেম হুমকির মুখে পড়েছে, বড় বড় হিমবাহগুলো আর স্থায়ী বরফে ঢাকা এলাকাগুলোতে বরফ গলতে শুরু করেছে।
বিশেষ করে ভারত ও চীনের যেসব এলাকায় মহাসড়কগুলো তৈরি করা হচ্ছে, রেলওয়ের লাইন বসানো হয়েছে, টানেল তৈরি করার জন্য পাহাড় খনন করা হচ্ছে, বাঁধ আর বিমানবন্দর তৈরি করা হচ্ছে, উভয় অংশেই এই চিত্র আরও পরিষ্কার হচ্ছে।
‘’আসলে এর মাধ্যমে বিপদকে আরও কাছে ডেকে আনা হচ্ছে,’’ বলছেন অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল এবং জলবিদ্যার অধ্যাপক আন্দ্রেস কাব। ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের চামোলি জেলায় ২০২১ সালে ভয়াবহ তুষার ধ্বসের কারণ নিয়ে যৌথভাবে তিনি একটি বই লিখেছেন।
বিচ্ছিন্ন অনেকগুলো ঘটনা নিয়ে গবেষণা হয়েছে। কিন্তু যখন সেসব ফলাফল একত্রে মিলিয়ে দেখা হয়েছে, তখন দেখা গেছে যে, প্রায় সাড়ে তিন হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিপদের ঝুঁকি বাড়ছে, যে এলাকাটিকে ভারত ও চীন-দুই দেশই তাদের সীমানা বলে মনে করে।
এই সীমানাকে বলা হয় লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল।
ন্যাচারাল হ্যাজার্ড অ্যান্ড আর্থ সিস্টেম সায়েন্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর আর অক্টোবর মাসে ভারতের জাতীয় মহাসড়ক এনএইচ-সেভেনের প্রতি কিলোমিটারে অন্তত একটি করে ভূমিধ্বস হয়েছে। যার ফলে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
অন্য গবেষণাগুলোতেও অনেকটা একই ধরনের বিপদের ঝুঁকি শনাক্ত করা হয়েছে।
ইউরোপীয় জিওসায়েন্স ইউনিয়নে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘’পরিবেশগত অবস্থার পাশাপাশি নতুন নতুন রাস্তা তৈরি করা বা প্রশস্ত করার কর্মকাণ্ড নতুন ভূমিধ্বস তৈরির পেছনে ভূমিকা রেখেছে। এসব ভূমিধ্বস প্রায়ই ছোটখাটো বা অগভীর হয়ে থাকে, কিন্তু তাতেও প্রাণহানি হয়। কারণ এতে যানবাহন চলাচল এবং স্থাপনাগুলোর গুরুতর ক্ষতি হয়ে থাকে।‘’
এই এলাকায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমিধ্বস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিনে দিনে খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে। এমনকি গত বছর বর্ষাকালে উত্তরাখণ্ডে নবনির্মিত চারধাম মহাসড়কের কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়েছিল।
চামোলি তুষার ধসের সময় ২০০ জনের বেশি মানুষ নিহত আর দুটি নির্মাণাধীন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
সেই ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করার সময় ভারতের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দেখতে পেয়েছে যে, ভবিষ্যতের দুর্যোগ মোকাবেলা করা নিয়ে পরিকল্পনা করার সময় তাদের কর্মকর্তারা জলবায়ু এবং অবকাঠামো সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলোকে বিবেচনায় নেয়নি।
হিমালয় অঞ্চলের জন্য অবকাঠামো বা স্থাপনাগুলো যে হুমকি তৈরি করছে, এই সম্পর্কিত বিবিসির প্রশ্নের উত্তর দেয়নি ভারতের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি হিমালয়ের ভারতের দিকে যেমনটা রয়েছে, চীনের দিকেও সমান ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে চিরস্থায়ী বরফ এলাকাগুলোয় তৈরি করা অবকাঠামো বরফ গলিয়ে দিতে চরম হুমকি তৈরি করেছে।
গত অক্টোবরে কমিউনিকেশনস আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, চীনের কিংহাই তিব্বত মালভূমিতে প্রায় ৯,৪০০ কিলোমিটার রাস্তা, ৫,৮০ কিলোমিটার রেলপথ আর ২,৬০০ কিলোমিটারেরও বেশি বিদ্যুৎ লাইন এবং হাজার হাজার ভবন এসব চিরস্থায়ী বরফ এলাকায় রয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘’ চিরস্থায়ী বরফ এলাকাগুলো গলতে শুরু করায় ২০৫০ সালের মধ্যে ৩৪ শতাংশ সড়ক, ৩৮ শতাংশ রেলপথ আর ৩৭ শতাংশ বিদ্যুতের লাইন, ২১ শতাংশ স্থাপনা বড় ধরনের হুমকিতে পড়তে পারে।‘’
এসব কারণে চীনের পূর্ব তিব্বত, ভারতের অরুণাচল প্রদেশ এবং সিকিম রাজ্যের উত্তরে ভূখণ্ড শুষ্ক ও কঠিন হয়ে পড়ছে। সেসব এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া নদ-নদীগুলো প্রাকৃতিক পথ থেকে সরে গিয়ে ছড়িয়ে যাওয়ারও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
গত বছর দ্যা ক্রায়োস্ফিয়ার জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সাম্প্রতিক দশকগুলিতে এই অঞ্চল একাধিক উচ্চ মাত্রার বরফ-পাথর তুষার ধস, হিমবাহ সরে যাওয়া এবং হিমবাহের হ্রদ উপচে বন্যার সম্মুখীন হয়েছে।”
এই মাসের শুরুতে, তিব্বতের মেডোগ কাউন্টিতে একটি সুড়ঙ্গ মুখে বিশাল তুষারধসে ২৮ জন নিহত হয়েছে।
তিব্বতের এই বোমি অংশেই ২০০০ সালে একটি বিশাল ভূমিধ্বস হয়ে সব সেতু, সড়ক এবং টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, যেগুলো তৈরি করতে কয়েক দশক সময় লেগেছে।
দ্যা ক্রায়োস্ফিয়ার জার্নালের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এই অঞ্চলটি হচ্ছে উচ্চ গতির ‘সিচুয়ান-তিব্বত রেলপথ’ নির্মাণসহ চীনা সরকারের বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।
চীনা কর্মকর্তারা বলেছেন, এই রেলপথটি ২১টি তুষার ঢাকা পাহাড়ের (সমুদ্রের ৪,০০০ মিটারের বেশি) ওপর দিয়ে যাবে এবং ১৪টি বড় বড় নদী অতিক্রম করবে।
চীনা একাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর মাউন্টেন হ্যাজার্ডস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ইন্সটিটিউটের প্রধান প্রকৌশলী ইউ ইয়ং সিনহুয়া নিউজ এজেন্সিকে বলেছেন, “অবশ্য ভূখণ্ডগত সমস্যা ছাড়াও এই রেলওয়ে তুষারধস, ভূমিধ্বস এবং ভূমিকম্পের মতো অন্যান্য বিপদের মুখোমুখি হবে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিংচি এবং শিগাৎসের মতো স্থানে বসতি বৃদ্ধির আরেক অর্থ হলো, ওই এলাকায় সড়ক ও টেলিযোগাযোগসহ অবকাঠামো বেড়ে যাওয়া।
চীনা গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে লন্ডনের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের গবেষণা সহযোগী রবি বার্নেট বলেছেন, ‘’ওই এলাকায় তারা ৬২৪টি নতুন সীমান্ত বসতি তৈরি করেছে।‘’
‘’এগুলোর প্রতিটিতে রাস্তা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পানি সরবরাহ এবং আরও অনেক কিছুর বিস্তৃত অবকাঠামো থাকতে হবে।।‘’
‘’এগুলোর অনেকগুলো অস্বাভাবিক উচ্চতায় তৈরি করা হয়েছে, ৪০০০ মিটারের বেশি উঁচুতে, যেখানে আমাদের জানা মতে এর আগে মানববসতি কখনো হয়নি। সেখানে বসতির জন্য যে হারে নির্মাণ সরঞ্জাম, সরবরাহ এবং আরও অনেক কিছুর দরকার হবে, তাতে সেটা অসম্ভব বলে মনে করা না হলেও, অবাস্তবধর্মী বলে মনে করা হতো,‘’তিনি বলছেন।
চীনের যে এলাকায় নতুন বসতি তৈরি করা হয়েছে, তার দক্ষিণ দিকে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ এবং সিকিমের মতো রাজ্য রয়েছে, যেখানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে।
এগুলো হলো সেইসব রাজ্য, যেগুলোকে ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশন ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে হিমবাহ গলে যাওয়ার কারণে হ্রদ এবং জলাশয়ের উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণের জন্য চিহ্নিত করেছে।
আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের ২০২০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভারতের ২৩টি গুরুত্বপূর্ণ হিমবাহ হ্রদের মধ্যে ১৭টি সিকিমে ছিল। গলিত হিমবাহের কারণে এই হ্রদগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া এবং উপচে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করায় এগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
জলবায়ু আলোচনার সময় চীন এবং ভারত সবসময়েই তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে একত্রে কাজ করেছে, অনেক সময় পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিমালয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ এবং পরিবেশগত অন্যান্য সমস্যা মোকাবেলার প্রসঙ্গ এলে এই অংশীদারিত্ব কাজ করে না।
বরং তার বদলে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং বৈরিতার কারণে এশিয়ার এই দুই বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ হিমালয়ের এই বিপদজ্জনক এলাকায় সামরিকসহ সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জোরদার করেছে।
আমেরিকান ভূ-বিজ্ঞানী জেফরি কার্গেল বলছেন, ‘’এই এলাকায় একটা আন্তর্জাতিক জৈববৈচিত্রের সংরক্ষিত এলাকা বলে চিহ্নিত হওয়া উচিত ছিল, সেখানে কোনরকম ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ডের অনুমতি দেয়া উচিত ছিল না।‘’
‘’কিন্তু আমরা আজ হিমালয়ে যা দেখছি, তাতে বিপদের ঝুঁকি আরও বাড়ছে এবং তার ফলে এই অঞ্চল আরও বেশি নাজুক হয়ে পড়ছে। আমরা এখানে আরও অনেক অনেক বিপর্যয় দেখতে যাচ্ছি,’’ তিনি বলছেন। (সূত্র: বিবিসি বাংলা)। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.