চীনের নতুন ‘সমুদ্র দানব’ নৌবাহিনী

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: লেভিয়াথান। পৌরাণিক উপাখ্যানের এক অতিকায় প্রাণী। বাংলায় যাকে ‘সমুদ্র দানব’ বলা যেতে পারে। বাইবেল অনুসারে, তিমি ও কুমিরের মতোই প্রাণীটি এক সময় সাগরে-মহাসাগরে দেখা যেত। চীনের নতুন নৌবাহিনীকে সেই লেভিয়াথানের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। একাধিক অত্যাধুনিক বিমানবাহী রণতরী আর শত শত যুদ্ধজাহাজ নিয়ে চীনা নৌবাহিনী প্রকৃত অর্থেই এক সমুদ্র দানব হয়ে উঠেছে!
২০১৮ সালের এপ্রিল মাস। বিতর্কিত ও উত্তেজনাপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগরে পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) নৌবাহিনীর একটি সামরিক মহড়ায় সরাসরি অংশ নেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সামরিক পোশাক পরেই উঠে পড়েন ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধজাহাজে। ওই মহড়ায় একসঙ্গে ৪৮টি যুদ্ধজাহাজ, অর্ধশত যুদ্ধবিমান ও ১০ হাজারের বেশি সেনা সাগরে নামানো হয়। কমিউনিস্ট শাসিত দেশটির ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম বৃহৎ কোনো নৌবহরের প্রদর্শনী।
আধুনিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুংয়ের পর চীনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতা মনে করা হয় শি জিনপিংকে। ওই সামরিক মহড়ার মধ্য দিয়েই চীনা নৌবাহিনীকে নিয়ে তার বিশাল পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেন তিনি। সেদিন তিনি এমন একটি নৌবহর গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন যেটা চীনের ‘বড়ত্ব’ প্রকাশ করবে। এবং সেই বাহিনী শুধু দক্ষিণ চীন সাগরে নয়, বিশ্বজুড়ে সাত মহাসাগরেই নিজের দাপট দেখাবে।
জিনপিংয়ের ওই নির্দেশনার পরই চীনা নৌবাহিনীর ব্যাপক আধুনিকায়ন ও বিস্তার শুরু হয়। গত শুক্রবার (১৭ জুন) ‘ফুজিয়ান’ নামে নিজেদের তৃতীয় ও সবচেয়ে উন্নত সবশেষ বিমানবাহী রণতরীটি সাগরে নামায় চীন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনা নৌবাহিনী কত দূর চলে গেছে এবং কতটা দ্রুত পৌঁছেছে- সবশেষ বিমানবাহী রণতরীটি তারই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। শুধু তাই নয়, বেইজিংয়ের এ সামরিক প্রযুক্তির উন্নতি এ মুহূর্তে তাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও প্রতিপত্তিকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
চীনা নৌবাহিনীই বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনী। যা খোদ যুক্তরাষ্ট্রই ইতোমধ্যে স্বীকার করেছে। গত বছরের (২০২১) নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের এক রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৫ সালে চীনের ২৫৫টি যুদ্ধ জাহাজ ছিল। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ সেই সংখ্যা ৩৬০ এ দাঁড়ায়। অর্থাৎ এখন থেকে দুই বছর আগেই যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ৬০টি বেশি যুদ্ধজাহাজ ছিল চীনের।
ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ২০২৫ সালের মধ্যে চীনের যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা ৪২০-এ উন্নীত হবে। মার্কিন প্রতিবেদন মতে, চীনের নৌবাহিনীর আকার মাত্র দুই দশকে তিনগুণ বড় হয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নৌবাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছে চীন।
চীনা নৌবাহিনীর কাছে বর্তমানে অত্যাধুনিক সাবমেরিন, বিমানবাহী রণতরী, যুদ্ধবিমান, হামলাকারী উভচর যুদ্ধজাহাজ, ব্যালিস্টিক পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রবাহী সাবমেরিন, বৃহৎ উপকূলরক্ষী বাহিনী ও দ্রুত গতির আইসব্রেকার রয়েছে।
বিমানবাহী রণতরীর সংখ্যার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার দিক থেকে কোনো অংশেই কম নয় চীন। সবশেষ রণতরী ফুজিয়ান দিয়ে পিএলএ’র মোট রণতরী এখন তিনটি। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিমানবাহী রণতরী রয়েছে ১১টি।
চীনা নৌবাহিনীর প্রথম দুটি বিমানবাহী রণতরীর নাম লিয়াওনিং ও শানডং। এগুলো সাবেক সোভিয়েত আমলের নকশায় প্রস্তুত। লিয়াওনিংকে মূলত কেনা হয়েছিল ১৯৯৮ সালে ইউক্রেন থেকে ভাঙাড়ি হিসেবে। এরপর সেটাকে মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করা হয়। রণতরী দুটি এখনও পুরোদমে সাগর-মহাসাগর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। নতুন প্রজন্মের নৌসেনা ও পাইলটদের প্রশিক্ষণের জন্যও রণতরী দুটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
প্রথম ও দ্বিতীয়টি রুশ প্রযুক্তির হলেও তৃতীয় বিমানবাহী রণতরীটি একেবারেই নিজস্ব প্রযুক্তির। অর্থাৎ নকশা ও নির্মাণে বিমানবাহী রণতরী ফুজিয়ানের মধ্যে চীনের নিজস্ব সামরিক সক্ষমতার সন্নিবেশ ঘটেছে। আর সবশেষ রণতরীটি নিশ্চিতভাবেই সমুদ্রযুদ্ধের ক্ষেত্রে চীনের শক্তি অনেক বাড়িয়ে দেবে।
আরও বৃহৎ, আরও শক্তিশালী: আকৃতিতে ফুজিয়ান আসলেই বিশাল। ৩১৬ মিটার তথা ১ হাজার ৩৭ ফুট লম্বা। ওজন প্রায় ১ লাখ টন। এর বিমান উড্ডয়ন ব্যবস্থা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক এয়ারক্রাফট লঞ্চ সিস্টেম (ইএমএএলএস) যুদ্ধবিমানের উড্ডয়নের (টেক অফ) সময় এর গতিকে আরও ত্বরান্বিত করবে। এর ফলে এমন একটা শক্তি বা বল তৈরি হবে যা যুদ্ধবিমানকে আগের চেয়ে বেশি জ্বালানি ও অস্ত্র বহনে সক্ষম করবে। ইএমএএলএস’র ফলে যুদ্ধবিমানগুলো আরও সহজে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারবে।
ইএমএএলএস ব্যবস্থায় একসঙ্গে অধিক যুদ্ধবিমান উড্ডয়ন করতে পারবে। এবং বিমানগুলোর আকাশে ওড়ার গতিও আগের রণতরীগুলোর চেয়ে আরও দ্রুততর হবে। যা শত্রুর যুদ্ধবিমানের আক্রমণ ঠেকিয়ে নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে। বিমানবাহী রণতরীর সবশেষ এ ফিচার তথা বিশেষত্ব ফুজিয়ানকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। এ বৈশিষ্ট্য যুক্তরাষ্ট্রের সবশেষ ফোর্ড-ক্লাস বিমানবাহী রণতরীতে রয়েছে।
ফ্রান্সও আস্তে আস্তে এ ব্যবস্থা উন্নয়নের চেষ্টা করছে। আর সম্প্রতি ভারত এর সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করেছে। তবে চীনের নৌবাহিনী এখনও পরমাণু শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী চালু করেনি। যা গত কয়েক দশক আগেই করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফুজিয়ান বর্তমানে প্রচলিত জ্বালানি ব্যবস্থায় চালিত। তবে পরবর্তী তথা চতুর্থ রণতরীটি পরমাণু শক্তিচালিত হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কূটনীতির অন্য মাধ্যম: চীনা নৌবাহিনীর লক্ষ্য ২০৩৫ সালের মধ্যে অন্তত ছয়টি বিমানবাহী রণতরী নিয়ে ছয়টি আক্রমণভাগ প্রস্তুত করা। এর ফলে চীনের সামরিক ক্ষমতা এমন স্তরে পৌঁছাবে যা দেশটির ইতিহাসে কখনও দেখা যায়নি। বিমানবাহী রণতরী একাকি পরিচালিত হবে না। বরং এটাকে ঘিরে পুরো একটি বহর তৈরি হবে।
আর ওই বহর ভ্রাম্যমাণ বিমানঘাঁটির সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে ব্যাপক গোলাবারুদ সরবরাহের মাধ্যমে সাগর-মহাসাগরে কিম্বা শত কিলোমিটার দূরের কোনো ভূখণ্ডের শত্রুর লক্ষ্যবস্তুতে ধ্বংস করতে সক্ষম হবে।
বহরে বিমানবাহী রণতরীর বিমান বাহিনীর পাশাপাশি থাকবে সাগর থেকে ভূখণ্ডে নিক্ষেপযোগ্য দূরপাল্লার মিসাইলের বড় মজুত। বিমানবাহী রণতরী স্ট্রাইক গ্রুপ তথা আক্রমণভাগের প্রধান কাজ হবে দেশের সীমান্ত পার হয়েও নিজের দাপট দেখানো।
প্রকৃত যুদ্ধশক্তি ব্যবহার করে এটা করা যেতে পারে, বা বল প্রয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়া একটি সংকটপূর্ণ অঞ্চলে বিমানবাহী রণতরীর স্ট্রাইক গ্রুপের উপস্থিতি ওই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে একটি কূটনৈতিক ব্যারোমিটার হিসেবে কাজ করতে পারে। বিমানবাহী রণতরীগুলো কয়েক দশক ধরে রাষ্ট্রীয় শক্তির কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
চীনা নৌবাহিনীর এ বিস্তার শুধুমাত্র যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি নয়। গত এক দশক ধরে ধীরে ধীরে এর অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। নৌবাহিনীর বিস্তারের বিষয়টি মাথায় রেখেই ভারত মহাসাগরজুড়ে বন্দর ও পোতাশ্রয়ের বিশাল এক নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে।
এরই অংশ হিসেবে আফ্রিকা মহাদেশ উপকূলের ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ জিবুতিতে চীনা নৌঘাঁটি গড়ে তোলা হয়েছে। এর জেটির বিস্তার প্রায় ৩৪০ মিটার তথা ১ হাজার ১১৫ ফুট। এবং এটা বিমানবাহী রণতরীর ক্রমবর্ধমান একটি বহরের স্থান সংকুলান করতে সক্ষম। হর্ন অব আফ্রিকার কাছেই অবস্থিত নৌঘাঁটিটি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলপথগুলোতে চলাচল করা চীনা যুদ্ধজাহাজগুলোর প্রধান সহায়তা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
চীনের অর্থনীতি সত্যিকার অর্থে বৈশ্বিক রুপ নিয়েছে। একই সঙ্গে নিজেদের বাণিজ্যপথ সুরক্ষিত রাখতে এর নৌবহরও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনা নৌবাহিনী এখন আটলান্টিক মহাসাগরেও নিজেদের উপস্থিতি বাড়াতে চাইছে। সেই লক্ষ্যে এ অঞ্চলে একটি নৌঘাটি নির্মাণ করার লক্ষ্যে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের দেশ ইকুয়েটরিয়াল গিনির সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন চীনা কর্মকর্তারা।
উচ্চাকাঙক্ষা কেবল শুরু: নৌবাহিনী নিয়ে চীনের অবিশ্বাস্য উচ্চাকাঙক্ষা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা কেবল শুরু। বিমানবাহী রণতরী ফুজিয়ান মূলত আগের মডেলের রুপান্তর। তবে এতে নিশ্চিতভাবেই একটি শক্তিশালী ও নতুন প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটেছে।
চীনা নৌ বিশেষজ্ঞ ও নকশাকাররা ইতোমধ্যে নৌপ্রযুক্তির পরবর্তী ধাপের দিকে নজর দিয়েছেন। তাদের এবারের লক্ষ্য পরমাণু শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী তৈরি করা। সেটা সম্ভব হলে তা চীনা নৌবাহিনীকে নিশ্চিতভাবেই অন্য স্তরে উন্নীত করবে। কারণ পরমাণু প্রযুক্তির রণতরীতে জ্বালানি ভরার কোনো ঝক্কি-ঝামেলা থাকবে না এবং কোনো রকম সংস্কার ছাড়াই একটানা ২০ বছর ধরে চলবে। #

 

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.