চীনকে ঠেকাতে অস্ট্রেলিয়া কি বড় ঝুঁকি নিচ্ছে?

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: অকাস চুক্তিতে সই করে অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সেটা তারা প্রকাশ করে দিয়েছে। এই চুক্তি থেকে বোঝা যায় যে চীনের ব্যাপারে তারা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার জন্য এটি অনেক বড় একটি সিদ্ধান্ত।
যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া যে নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তার ফলে তারা সামরিক বিবেচনায় বিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তিশালী দেশের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো উন্নত করতে পারবে।
তবে এটা এমন এক উপহার যার সঙ্গে সুতা বাঁধা রয়েছে। এছাড়াও বিতর্ক উঠেছে যে জনগণের কাছ থেকে কোনো ধরনের মতামত না নিয়ে ও আলাপ আলোচনা না করেই এতো বড় একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়েছে কিনা। প্রশ্ন উঠেছে এই চুক্তি অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় স্বার্থে কতোটুকু ভূমিকা রাখবে।
অস্ট্রেলিয়ার অবস্থানের পরিবর্তন: চীন ক্রমশই শক্তিশালী হয়ে ওঠার কারণে তারা প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম নৌ বাহিনী গড়ে তুলেছে চীন এবং দক্ষিণ চীন সাগরের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা-পূর্ণ অঞ্চলে দেশটি ক্রমশই দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়ে উঠছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন – এই দুটো শক্তির মধ্যে চীন এতদিন কোন একটির পক্ষে অবস্থান নেয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেইজিং-এর প্রতি দেশটির মনোভাব কঠোর হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার অভিযোগ যে চীন তাদের দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাইবার হামলা পরিচালনা করছে।
করোনাভাইরাসের উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে অস্ট্রেলিয়া গত বছর তদন্তের আহবান জানানোর পর এই দুটো দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পর পরই অস্ট্রেলিয়ার রপ্তানির ওপর চীন আকস্মিকভাবে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
অস্ট্রেলিয়ার জন্য এটা ছিল “হঠাৎ করে কিছু একটা আবিষ্কার করার মতো মুহূর্ত,” বলেন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত অধ্যাপক জন ব্ল্যাক্সল্যান্ড।
“এসব থেকে অস্ট্রেলিয়া উপলব্ধি করতে শুরু করলো যে যা কিছু হচ্ছে সেসব তাদের অনুকূলে যাচ্ছে না,” বলেন তিনি। “আমরা এমন একটি দেশ নিয়ে কথা বলছিলাম যা হঠাৎ করেই শত্রুভাবাপন্ন হয়ে পড়েছে।”
অস্ট্রেলিয়া উপলব্ধি করলো যে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুব দ্রুতই উন্নত করা দরকার।
প্রধান সুবিধা: এই হিসেবে, অস্ট্রেলিয়ার জন্য অকাস চুক্তিটি বড় ধরনের এক অভ্যুত্থানের মতো। এই সমঝোতার ফলে পারমাণবিক সাবমেরিন ও দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে প্রযুক্তি দিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে সাহায্য করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এবং কোনো ধরনের সংঘাতের ঘটনা ঘটলে অস্ট্রেলিয়া এই প্রথম তার শত্রুপক্ষের ওপর দূর থেকে আঘাত হানতে পারবে।
“এর ফলে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা বাহিনী ওই অঞ্চলে কিছু সক্ষমতা অর্জন করবে যেখানে চীনের ক্ষমতার তুলনায় দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেক পিছিয়ে ছিল,” বলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা, এবং বর্তমানে এশিয়া সোসাইটি অস্ট্রেলিয়া নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক রিচার্ড মড।
যুক্তরাষ্ট্র কী পাবে?: নিজেদের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির মতো মূল্যবান একটি জিনিস অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেক বড় একটি বিষয়। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ওয়াশিংটন মনে করে চীনকে ঠেকাতে “এক কালীন” এই বাণিজ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগ।
চীন যেহেতু ওই অঞ্চলে তাদের নৌ শক্তিকে ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে, সেকারণে অস্ট্রেলিয়ার এই বহর- ছোট হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের নৌ শক্তির পাশে থাকার কারণে, তারা চীনের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
“একটি যুতসই প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে আমরা শক্তি অর্জনের চেষ্টা করছি যাতে যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে যায়,” বলেন অধ্যাপক ব্ল্যাক্সল্যান্ড।
“কারণ বর্তমানে আমাদের কাছে যে প্রতিরোধী ব্যবস্থা রয়েছে সেটা খুব বেশি নির্ভরযোগ্য নয়। কোনো ধরনের ঝুঁকির কথা চিন্তা না করেই চীন আমাদের বিরুদ্ধে নেমে পড়তে পারে। রাজনৈতিকভাবে এটা আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।”
সমালোচকরা বলছেন, অস্ট্রেলিয়ার দিক থেকে এতদিন যে কৌশলগত অস্পষ্টতা ছিল সেটা তারা পরিত্যাগ করেছে এবং এই চুক্তির ফলে দেশটি এখন অনেক বড় এক টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
“যেভাবে এই চুক্তির বিষয়টি ঘোষণা করা হয়েছে তার ফলে চীনের ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়া সামরিক শক্তি ব্যবহার না করার যে ভান করে আসছিল সেটা ভেঙে গেছে,” বলেন অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক অ্যালেন গিঞ্জেল।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়াকে হয়তো তাদের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার চীনের কাছ থেকে আরো কিছু অর্থনৈতিক প্রতিশোধের মুখে পড়তে হতে পারে।
“দুটো দেশের মধ্যে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তেমন একটা ছিল না। এখন এই অবস্থার আরো অবনতি হলো,” বলেন সিডনিতে প্রযুক্তি বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির শিক্ষক ড. লাই-হা চান।
অন্যান্যরা বলছেন, এর ফলে অস্ট্রেলিয়া দীর্ঘ সময়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আটকা পড়ে গেল।
তাদের মতে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়াকে হয়তো আগামীতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতার বিষয়ে বেগ পেতে হবে। তাদেরকে নির্ভরশীল হতে হবে বিদেশি পরমাণু প্রযুক্তির ওপর।
“আমরা তো নিজেরা সাবমেরিন পরিচালনা করতে পারি না। ফলে আমরা আমাদের সার্বভৌমত্বের কিছুটা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দিয়ে দিচ্ছি, এবং হয়তো ব্রিটেনের কাছেও,” বলেন অধ্যাপক গিঞ্জেল।
“এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া বড় ধরনের সক্ষমতা থাকা স্বত্বেও অস্ট্রেলিয়ার নৌ বাহিনীর পক্ষে কাজ করা অসম্ভব হবে।”
তিনি বলেন, এছাড়াও অস্ট্রেলিয়া ইংরেজিভাষী দেশগুলোর ক্ষুদ্র একটি অংশীদারে পরিণত হবে, যদিও দেশটি গত কয়েক বছরে এশিয়াতে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছিল।
“আমরা আবার তাদের সাথে মেলামেশা করতে শুরু করছি যাদের সঙ্গে মিশতে আমরা সন্তোষ বোধ করি। আমাদের অঞ্চলে অন্যদের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আমাদের যে উদ্যোগ ছিল সেটা আমরা পরিত্যাগ করছি। এটা একটা সমস্যা,” বলেন অধ্যাপক গিঞ্জেল। এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এর ফলে আরো একটি ঝুঁকি আছে।
এই চুক্তির কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো হয়তো ধারণা করতে পারে যে অস্ট্রেলিয়া মনে করে ওই অঞ্চলের নিরাপত্তা শুধুমাত্র পশ্চিমা বড় শক্তিই রক্ষা করতে পারবে, বলেন তিনি।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত জোট আসিয়ানের মধ্যেও এই চুক্তির ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেছে, এবং মালয়েশিয়াও সতর্ক করে দিয়েছে যে এই চুক্তির ফলে “পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বেড়ে যেতে পারে।”
তাসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্লেষক জেমস চিন বলেছেন, অকাস চুক্তি থেকে এটা আবারও স্পষ্ট হয়েছে যে মহাশক্তিধর দেশগুলো ওই অঞ্চলে কিভাবে কাজ করবে সে ব্যাপারে আসিয়ান জোটের সদস্য দেশগুলোর মতামতের তেমন গুরুত্ব নেই।”
তবে কিছু কিছু বিশ্লেষক মনে করেন এশিয়ার অনেক ছোট ছোট দেশও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে খুশি।
“কিছু কিছু পণ্ডিত ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সময় বলবে: ‘আমরা মনে করি তোমরা অস্ট্রেলিয়ানরা বোকা, আনাড়ি এবং সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনহীন। কিন্তু তোমরা যা করছো আমরা সেটা অপছন্দ করি না। কিন্তু যেভাবে করছো আমরা সেটা পছন্দ করছি না। আমরা চাই কিছু করার আগে তোমরা আমাদের সাথে আলাপ করে নিবে যাতে আমরা মনে করতে পারি যে আমরাও এর মধ্যে আছি,” বলেন মি. ব্ল্যাক্সল্যান্ড।
বেশিরভাগ বিশ্লেষক মনে করেন যে অকাস চুক্তিকে ঘিরে অস্ট্রেলিয়া তার কূটনীতিকে ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারেনি। ফ্রান্সের সঙ্গে আগের সাবমেরিন চুক্তি বাতিল করার কারণেও ফ্রান্স মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা একটা খারাপ দিক। কারণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কে সামরিক চুক্তি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কূটনীতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের স্বার্থে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বজায় রাখতে হবে। কিন্তু সেটা কিভাবে করতে হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বিভক্ত।
কেউ কেউ বলছেন এজন্য খুব সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। অন্যদিকে যারা কঠোর তারা মনে করেন শক্তি প্রদর্শন না করলে চীন আর কোন কিছুতেই সাড়া দেবে না।
তবে যাই হোক, একটা বিষয় নিশ্চিত যে আমরা আরো উত্তেজনাকর সময়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছি।
“পূর্ব এশিয়ার হিসেবে আমরা বিশ্বের মধ্যে শান্ত একটি এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিলাম। এখন এটা আর থাকছে না,” বলেন অধ্যাপক গিঞ্জেল।
“সুতরাং পররাষ্ট্র নীতি এবং প্রতিরক্ষার মতো বিষয় অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ জনগণের ওপর গত কয়েক দশকের তুলনায় আরো বেশি প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। বিষয়গুলো এখন বাড়ির কাছাকাছি আসছে।” (সূত্র: বিবিসি)। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.