চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত দিবস ও শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি: চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত দিবস আগামীকাল ১৪ ডিসেম্বর। বাঙলা মায়ের দামাল সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের এই দিনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পার্শ্বে মহানন্দা নদীর তীরবর্তী গ্রাম রেহায়চর এলাকায় সংগঠিত হয় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।

পাকহানাদার বাহিনীর সাথে সুম্মুখযুদ্ধে ধ্বংস করে দেয় শত্রু বাহিনীর ১৮টি ট্রেঞ্চ ও ২০ থেকে ২২টি বাংকার। শত্রুমুক্ত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ। তবে, ১৫ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত দিবস বলছেন সাবেক জেলা ইউনিট কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক। ১৯৭১ সালে তৎকালিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমার অন্যান্য এলাকা মুক্ত হয়ে গেলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর ছিল পাক হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় শত্রু সেনাদের দখলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে। ১৩ ডিসেম্বর বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর শহর মুক্ত করতে কয়েকটি নৌকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রেহায়চর এলাকায় যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। সম্মুখ যুদ্ধে একের পর এক পরাস্ত করতে থাকেন শত্রু বাহিনীকে। ১৪ ডিসেম্বর রাতের আধার কেটে সকালে সূর্য ওঠার আগেই নির্ভিক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জাহাঙ্গীর সহযোদ্ধাদের নিয়ে বীরদর্পে এগিয়ে চলেন এবং ধ্বংস করে দেন শত্রু বাহিনী ১৮টি ট্রেঞ্চ ও ২০ থেকে ২২ টি বাংকার।

জাহাঙ্গীরের দুঃসাহসিক ও দুরন্ত আক্রমণে শত্রু বাহিনী তাদের আস্তানা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। রেহায়চর ঘাটের কাছেই শত্রু বাহিনীর সর্বশেষ বাংকারটি দখল করতে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে এগোতে থাকার সময় হটাৎ শত্রু বাহিনীর একটি গুলি এসে লাগে বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের কপালে। লুটিয়ে পড়েন মাটিতে বাংলার এই বীর সন্তান এবং সেখানেই শাহাদাৎ বরণ করেন। পরের দিন শহীদ ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরকে দাফন করা হয় হযরত শাহ নেয়ামাত উল্লাহ (রহঃ)-এর পুণ্যভূমি বাংলার পুরাতন রাজধানী গৌড়ের সোনামসজিদ চত্বরে। এরপর আর কোন যুদ্ধ হয়নি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। মুক্ত হয়ে যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ। তবে ১৪ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত হলেও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে মুক্তি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ১৫ই ডিসেম্বর সকালে। সেই হিসেবে ১৫ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত দিবস বলছেন সাবেক জেলা ইউনিট কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক। চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত করতে গিয়ে শহীদ হওয়া এই বীর সন্তানের নামে পরবর্তীতে ৩টি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়।

মহানন্দা নদীর উপর নির্মিত ব্রীজটির নামকরণ করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতুর। ব্রীজ চত্বরে বারঘরিয়া নামক স্থানে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতি স্তম্ভও তৈরী করা হয়। একটি পিস্তলের উপর ২টি শান্তির পায়রা খঁচিত স্তম্ভটি কালের সাক্ষি হয়ে থাকবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। অনেক পরে হলেও ২০১১ সালে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের শহীদ স্থলে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ঠিক দু’দিন আগে, ১৪ ডিসেম্বর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শত্রু মুক্ত করতে গিয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন। প্রতি বছর এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাগণ ও জেলা প্রশাসন বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে দিনটি পালন করেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মোঃ সিরাজুল হক বলেন, শিবগঞ্জ, রহনপুর মুক্ত হওয়ার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর মুক্ত করার জন্য বারঘরিয়া, সুইজগেট, রাজারামপুরসহ বিভিন্ন দিক দিয়ে পাকিস্তানী সেনাদের বাঙ্কার ধবংস করার পর ১৪ ডিসেম্বর রাতভর শত্রুসেনারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৫ ডিসেম্বর সকালে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে বিজয় উল্লাস করেন মুক্তিযোদ্ধারা। সেদিনই মুক্তি সমাবেশ করা হয়। কিন্তু জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে বন্দি থাকায় উৎফুল্লভাবে বিজয় উল্লাস করতে পারে নি মুক্তিযোদ্ধারা।

১৬ ডিসেম্বর সারাদেশ মুক্ত হলে বিজয় উল্লাস হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটসহ শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুর, নাচোল ও ভোলাহাট উপজেলার সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে ঐতিহাসিক গৌড়ের ছোট সোনামসজিদ প্রাঙ্গনে অবস্থিত মাজার চত্বরে তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। ৭ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কমান্ডিং অফিসারগণ এই দিনে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আসেন সেখানে। সেই ভয়াল দিন গুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁদের অনেকেই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। এ প্রজন্মের তরুণরা জানতে পারে, এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সেই করুণ ইতিহাস।

ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ১৯৪৯ সালে বরিশালের রহিমগঞ্জে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে মুলাদী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এবং ১৯৬২ সালে মুলাদী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ট্যালেন্ট পুলে জুনিয়ার বৃত্তি লাভ করেন। একই বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে গণিতে লেটার মার্কসহ এসএসসি পাশ করেন। ১৯৬৬ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে আবারো গণিতে লেটার মার্কসহ এইচ এসসি পাশ করেন। এর পর তিনি ‘৬৭ সালের ৫ অক্টোবর কাকুল পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমীতে যোগদান করেন। নিষ্ঠার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬৮ সালের ২ জুন কমিশন প্রাপ্ত হন। ৬ মাস চাকুরী করার পর তিনি রিসালপুরস্থ মিলিটারী কলেজ অভ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যোগদান করেন এবং ১৩ মাসের ব্যাসিক কোর্সে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ন হন। এরপর সেখান হতে বোম্বে ডিস্পোজাল কোর্স করেন এবং কোর অব ইঞ্জিনিয়ারর্স এর একজন সুদক্ষ অফিসার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে সুনাম অর্জন করেন।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি মো: আশরাফুল ইসলাম রঞ্জু।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.