চলে গেলেন আলোর দিশারী আবুল ফরাহ স্যার

ড. সফিকুল ইসলাম উপ সচিব
১। মানুষ আসে মানুষ যায়। কিন্তু কেউ কেউ চলে গেলে লাখো মনে ক্ষত রেখে যায়, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার চিহ্ন রেখে যায়। ভালোবাসার বিলাপ চলতে থাকে, শ্রদ্ধার মালা ঝরতে থাকে, নিরবে নিরবে অশ্রুঝরা চলতে থাকে। কেউ কেউ মারা গেলে পাড়া জুড়ে, গ্রাম জুড়ে এলাকা জুড়ে কান্না চলতে থাকে। হাজার মানুষ হাজার স্মৃতি মনে করে করে বিলাপ করতে থাকে। তেমনি একজন আজ চলে গেলেন। বাদৈর গ্রামের কৃতি সন্তান, আমাদের সবার মুরব্বী, সকলের শ্রদ্ধাভাজন, সকলের প্রিয়ভাজন, জনাব আবুল ফরাহ ভূঞা মাস্টার। সবাই যাকে হেড স্যার নামে চেনে, এলাকা যাকে ফরাহ মাস্টার নামে চেনে,  নতুন প্রজন্ম যাকে হেডমাস্টার দাদা নামে ডাকে। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। ‘‘এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভূবন‘ কথাটি ফরাহ স্যারের জন্য শতভাগ প্রযোজ্য। স্যার চলে গেলেন আজিকে, আর কাঁদিছে অঝরে সকলে।
২। মানুষ তাঁর জীবনে অনেক শিক্ষক পায়। কিন্তু কোনো কোনো শিক্ষককে মানুষ ভূলতে পারেনা। তাঁর কথার কারণে, তাঁর প্রজ্ঞা জ্ঞানের কারণে, তাঁর বলার ও চলার ধরণে, তাঁর প্রকাশের আভিজাত্যে ছাত্ররা প্রেমে পড়ে যায়, শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ে, জ্ঞানের মুক্তো কুঁড়িয়ে কুঁড়িয়ে নেয়। বাদৈর স্কুলের প্রাক্তন হেড মাস্টার তেমনি  একজন শিক্ষক ছিলেন। যিনি কেবল শিক্ষক নন, তিনি ছিলেন পথ প্রদর্শক, তিনি ছিলেন উদ্দীপনার আধার, তিনি ছিলেন ভবিষ্যত দেখাবার দূত। দেখবার জন্য আমাদের চোখের যেমন আলোর প্রয়োজন, ঠিক তেমনি কোনো প্রত্যয় অর্জন করবার জন্য আমাদের ভাবনার প্রয়োজন। সেই আলো জ্বেলে দেওয়া আর ভাবনার দুয়ার খুলে দেওয়ার কাজটি করেছেন জনাব আবুল ফরাহ ভূঞা জীবনভর।
৩। যতদূর জানা যায়, তিনি ষাটের দশকের প্রথমদিকে বিএ পাশ করে চারগাছ অখিল দত্ত স্কুলে (বর্তমান এনআইবি) শিক্ষকতা শুরু করেন। বাদৈর সাবের সাদত উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি সম্ভবত ১৯৬৫ সালের শেষের দিকে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। আর  তাঁর হাত ধরে বাদৈর স্কুলের হাজার হাজার ছাত্র বেরিয়ে গিয়ে দেশে বিদেশে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছে। অনেকেই এখন সরকারের উচ্চ পর্যায়ে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, কাজ করছেন। সবার কাছেই তিনি ছিলেন একজন মডেল, তিনি ছিলেন আদর্শ। তাঁর দেখানো পথে হেঁটেই আজ অনেকেই সফল। এছাড়াও তিনি ভাটামাথা হাইস্কুলে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ভাঙ্গরা উমালোচন উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৯৩-২০০৬ পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
৪। শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি ছিলেন এলাকার একজন সজ্জন ব্যাক্তি, মিষ্টভাষী, সদালাপী মানুষ। এলাকার ভালো মন্দ নিয়ে ভাবতেন, যুবক ও ছাত্রদের সুপরামর্শ দিতেন, মানুষকে আলোর কথা বলতেন, ভালোর কথা বলতেন, মঙ্গলের দিকে টানতেন। গ্রামের ইতিহাস তিনি জানতেন। কথায় কথায় শেয়ার করতেন। আমার খুব ইচ্ছা ছিল একদিন সারাদিন সময় নিয়ে উনার সাক্ষাতকার গ্রহণ করে রাখবো। তা আর হয়ে উঠলোনা। সময় করতে পারিনি। বড় অসময়ে তিনি চলে গেলেন। আমার খুব আফসোস লাগছে এখন, কেন সময় করলামনা, কেন কথা বললামনা, কেন লিখে রাখলামনা। এমন জীবন্ত স্মৃতিচারণ ও সত্য উচ্চারণ আর কোথায় পাবো? আর কোথায় পাবো?
৫। তিনি যখন কথা বলতেন তখন মুখে খৈ ফুটতো। বাংলা আর ইংরেজির মিশ্রণে অনর্গল কথা বলতেন। শ্রোতারা মুন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতো। বলার ভাষা আর ঢং এর মাত্রায আর সকলে নিজেদের কথা হারাতো। যেখানে বলার চেয়ে শোনা আরামের সেখানে কে আর কথা বলতে যায়? আমাদের সেই প্রিয় স্যার আজ চলে গেলেন। যার এমন মধুর কথা আমরা আর শুনতে পাবোনা। যেহেতু তিনি দীর্ঘ ত্রিশ বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন বাদৈর স্কুলের, তাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হিরন মিয়া সাহেব, ও প্রতিষ্ঠাতার সহধর্মীনী শিরিয়া খাতুন সম্পর্কে অনেক জানতেন আর উচ্চকন্ঠ প্রশংসা করতেন। প্রতিষ্ঠাতার বাবা সাদত আলী মাস্টার, আমার চাচাতো-দাদা আশরাফ উদ্দিন ধন মিয়া মাস্টারসহ গ্রামের প্রথিযশা জ্ঞানী গুণী পরোপাকারী মানুষদেরকে নিয়ে ফরাহ স্যার স্মৃতি আওড়াতেন। স্যারের এ ভালোবাসাপূর্ণ স্মৃতিচারণ ছিল নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষা। এ আলোকিত মানুষদের সম্পর্কে শুনে শুনে নতুন প্রজন্ম হিসেবে আমরা উজ্জীবিত হতাম।
৬। আমি উনার সরাসরি ছাত্র ছিলামনা। বন্ধুদের অনেকে ছাত্র, তাই আমিও স্যার ডাকতাম। আমাকে আদর করে ‘সফিক‘ ডাকতেন। এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করার পর থেকে উনার সাথে আমার প্রথম দেখা। স্যারের ছেলে আমার বন্ধু জহিরের সাথে বেশ কবার স্যারের কাছে গিয়েছি। বন্ধু প্রকৌশলী সেলিম, আনোয়ার, সেন্টুসহ অনেকে থাকতো। স্যার সুন্দর করে কথা বলতেন। নিজ হাতে তুলে তুলে নাস্তাপানি খাওয়াতেন। আর  বাংলা সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য, ইতিহাস, আঞ্চলিক ইস্যু, শিক্ষার ইস্যু, ছাত্রদের নানান কাহিনী বলে যেতেন। আমরা কেবল শুনতাম, কেবল শুনতাম। কথা এমন দামি ছিলো যে হৃদয়ে নোট নিতাম। যেহেতু ভালো কথা
অভ্যাস আমার আজীবন তাই উনাকে আমি স্যার ডাকতাম। কারণ তাঁর কাছে গেলে কথা শুনেই অনেক কিছু শিখতাম। এরপরে যতবার গ্রামে গিয়েছি, দেখা হয়েছে খুব আদর করতেন, স্নেহ করতেন। আমাকে নিয়েও গর্ব করতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। একজন ছায়া আমাদের উপর থেকে চলে গেলো। একজন আলোকিত মানুষ আমাদের ছেড়ে চলে গেলো।
৭।  স্যারের সাথে এবার অস্ট্রেলিয়া থেকে আসার পরেও বাজারে দেখা হয়েছে। আমাকে জোর করে পাশে বসিয়ে বাদাম খাইয়েছেন, চা খাইয়েছেন। বলেছেন অনেক কথা। আমার সব খবর নিয়েছেন। দুবছর আগে দ্বিপাক্ষিক একটি দ্বন্দ নিরসনে আমার উপস্থিতি ও ভূমিকা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, ‘‘ওই  মিটিং এ তোমার মুখে কথা শুনে আমি অভিভূত হয়েছি, তুমি যে গল্প দিয়ে আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলে। এরকম প্রাসঙ্গিক গল্প আগের দিনে বড় বড় সালিশকারিরা বলতে পারতেন। তোমার কারণে দীর্ঘ একটি সমস্যা সহজে সমাধান হয়েছিল‘‘। আমি বলেছিলাম যে আমিতো তেমন কিছু বলিনি, জাস্ট আমার মন থেকে কথা বলেছিলাম, আর আপ্রাণ চেয়েছিলাম যেন সমস্যাটার সমাধান হয়। সেটাই হয়েছে। স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন তুমি
অনেক দূর যাবে‘‘। এমন খাস দিলে দোয়া আমি আর কোথায় পাবো। এমন শুভাকাঙ্ক্ষী আর আমি কোথায় পাবো?
৮। শত ভালোবাসা আর অর্জনের মধ্যেও স্যারের মনে একটা আক্ষেপ ছিল। কথা প্রসঙ্গে তা একসময় বেরিয়ে আসতো। বাদৈর ও অত্র অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের স্যারের আরও দেওয়ার ছিল। স্যার বলতেন, ‘‘নতুন প্রজন্মের জন্য এটা করতে পারিনি, ওটা করতে পারিনি, এ ভূমিকা রাখতে পারিনি, সে ভূমিকা রাখতে পারিনি। দূরে না গেলে এ এলাকায় থাকলে আমার হাত দিয়ে আরও অনেক গুণী ছাত্র বের হতো গত ২০ বছরে।‘‘ নিজ গ্রাম তথা অত্র অঞ্চলের ছাত্রদের জন্য স্যারের ভালোবাসার অভিব্যক্তি ছিল এগুলো। যদিও তিনি অনেক করেছেন, তবু ভালো মানুষ মাত্রই, গুণী মানুষ মাত্রই হাজার করেও আরও কিছু না করতে পারার একটা অতৃপ্তি থাকে মনে। স্যারকে আল্লাহপাক বেহেশত নসীব করুক, আর আমাদেরকে আল্লাহপাক হেদায়েত করুক। আমীন
৯। শুনেছি স্যার ছিলেন পড়াশোনা ও নিয়মানুবর্তীতার ব্যাপারে খুব কড়া, আবার ভালো ছাত্রদের, মেধাবী ছাত্রদের, ক্রীড়ায় পারঙ্গমদের, সাংস্কৃতিক আগ্রহীদের আদর করতেন খুব।  আদর্শ শিক্ষক, আদর্শ অভিভাবক, আদর্শ প্রশাসক এ তিনটি গুণ অঙ্গাঙ্গীভাবে বিদ্যমান ছিলো ফরাহ স্যারের মধ্যে। যদি বাংলাদেশের সকল এলাকায় সকল স্কুলে এরকম প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষক তৈরি হয়। আর এরকম মননে মগজে প্রাণপনে কাজ করে তবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে, আর হাজার হাজার মেধাবী ছাত্র বের হবে। প্রার্থনা করি একজনকে হারিয়েছি, এরকম আর হাজারো ফরাহ স্যার তৈরি হোক। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হোক  দেশের সমস্ত শিক্ষার্থীবৃন্দ।
১০। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি অঞ্চলের বিল্পবাত্মক ও আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে। আর সেই প্রতিষ্ঠানে যদি একজন ভালো প্রধান শিক্ষক থাকেন, তাহলে কোনো কথাই নেই।  এ প্রসঙ্গে রুশ মনীষী লিও টলষ্টয় বলেছেন যে, একটি জাতির উন্নতিতে তিনটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন স্কুল, স্কুল ও স্কুল। কিন্তু আমি বলবো স্কুলের সাথে যদি একজন ভালো প্রধানশিক্ষক না থাকেন তবে তা সম্ভব হয়না। জনাব আবুল ফরাহ ভূঞা ছিলেন একজন মডেল প্রধান শিক্ষক যার কারণে ছাত্ররা স্কুল থেকে সোনা হয়ে বের হতো। একজন ভাল শিক্ষাবিদকে কেন্দ্র করে  একটি অঞ্চলের শিক্ষার বিপ্লব ঘটে, সচেতনতার প্রসার ঘটে, আলোর বিস্তার হয়।
মূলত: ফরাহ স্যার তিনটি স্কুলের শুধুমাত্র প্রধান শিক্ষকই ছিলেন না, ছিলেন অভিভাবক, পরামর্শদাতা, সংযমী ও আদর্শ চরিত্রের অধিকারী একজন মহান ব্যক্তিত্ব। আমি এই মহান শিক্ষকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং আল্লাহর কাছে তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। আল্লাহপাকা তাঁর আত্মাকে বেহেশতের সর্বোচ্চ মোকাম দান করুক। আমীন। 

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ প্রতিনিধি মোঃ লোকমান হোসেন পলা। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.