গোমস্তাপুরে ইসলামিয়া ক্লিনিকে ভূল অপারেশনে রোগীর মৃত্যু ॥ নজর নেই স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের

 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি: চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার গোমস্তাপুর বাজার এলাকায় অবস্থিত ইসলামিয়া ক্লিনিকে ভূল অপারেশনে রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। একই ক্লিনিকে একাধিকবার অনভিজ্ঞ ও ভূয়া ডাক্তার দিয়ে অপরেশনে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ বা ডাক্তারের বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা। জেলার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগসাজস থাকায় নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই চালানো হচ্ছে ক্লিনিকের কার্যক্রম। জেলায় বিভিন্ন ক্লিনিকে রোগী মৃত্যু বা অন্যান্য দূর্ঘটনা ঘটলেও তেমন একটা ব্যবস্থা হয়নি ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এভাবে বেড়েই চলেছে ক্লিনিক ব্যবসার দৌরাত্ম।

ক্লিনিকে নেই অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ও ডাক্তার। রয়েছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশও। তারপরও চলছে অপারেশন। দেখার যেন কেউ নেই। অবশ্য ইসলামীয়া ক্লিনিকে ১৪ অক্টোবর মারা যাওয়া সুকতারা বেগমের পরিবারের সাথে বসে সমাধা হয়েছে, বলেই যেন ক্লিনিকের অনিয়মের শেষ ব্যবস্থা। রোগীর অভিভাবকের সাথে সমাধা করে নেয়ায় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যায় না বলছেন সিভিল সার্জন। তাহলে কি ভূল অপারেশন করে রোগীর পরিবারের সাথে মিমাংসা করে নিলেই ডাক্তার না হয়েও অপারেশনসহ অন্যান্য চিকিৎসা চালানো যাবে? সার্জিক্যাল বিভাগের চিকিৎসক না হয়েও অপারেশন করে রোগী মারা যাবে? এভাবেই কি সাধারণ সহজ সরল মানুষ প্রতারণার শিকার হয়ে আর্থিক ও মানষিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতেই থাকবে? এমন প্রশ্ন সাধারণ ও বিবেকবান মানুষদের।

জনস্বার্থে করা স্থানীয় একটি লিখিত অভিযোগে জানা গেছে, গত ১৪ অক্টোবর বিকেলে ইসলামিয়া ক্লিনিকে এাপেন্ডিসাইট অপারেশনের প্রায় ১১/১২ ঘন্টা পর মারা যায় গোমস্তাপুর হাটখোলা বাজারের ডেমু আলীর মেয়ে মোসাঃ সুকতারা বেগম (২৩)। তবে সুকতারা বেগমের মৃত্যু হয়েছে ডাক্তার না হয়েও এ্যানেস্থেসিয়া ও অপারেশন করা ভূয়া ডাক্তার মো. টুটুল ও গাইনি বিভাগের ডাক্তার মোসা. কারিমাতুন নেসা কনক এর করা ভুল অপরেশনে। আর এসবের জন্য স্থানীয়রা দায়ী করছেন ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে এবং জেলার উর্ধ্বতন স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে। অবশ্য ইসলামিয়া ক্লিনিকে ভুল অপারেশনের পর রোগীর অবস্থা বেগতিক দেখে সহজ সরল রোগীর অভিভাবককে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন অভিযুক্ত ডাক্তার ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। সুকতারা বেগমকে রাজশাহী নিয়ে যাওয়ার সময় পথেই গোদাগাড়ীতে মারা যায়। ইসলামিয়া ক্লিনিকে অপরেশনে সুকতারা বেগম নামে রোগী মৃত্যুর ঘটনাটি নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট ক্লিনিকের এক কর্মচারী। সুত্রটি জানায়, ১৪ অক্টোবর বিকেল ৩টার দিকে ক্লিনিকে অপারেশন হয়, আর রাত প্রায় ৩টার দিকে রোগীর অবস্থা খারাপ হলে রাজশাহী নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যায় সুকতারা।

অভিযোগে আরও জানা যায়, ইসলামিয়া ক্লিনিকে এর পূর্বেও ভুল অপরেশনে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি ক্লিনিকের বিরুদ্ধে। তাদের অভিযোগ জেলার সিভিল সার্জন সাহেবকে ম্যানেজ করে নেয়ায় বার বার দূর্ঘটনা ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা হয়নি। হাতুড়ে ডাক্তার বা সার্জিক্যাল ডাক্তার না হয়েও সেই ডাক্তার দিয়ে অপারেশন করার পর রোগী মৃত্যুর পর কোন ব্যবস্থা না হওয়ায় সাহস পেয়ে একইভাবে চালিয়ে যাচ্ছে ক্লিনিক ব্যবসা। ডাক্তার না হয়েও বিভিন্ন ক্লিনিকে গিয়ে বড় ও অভিজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিয়ে অপারেশন করে চলেছেন এবং দূর্ঘটনাও ঘটাচ্ছেন বলে অভিযোগ ভূয়া ডাক্তার মো. টুটুলের বিরুদ্ধে। রহনপুরের আল হেরা ক্লিনিকে স্বর্বক্ষনিকভাবে চিকিৎসা এবং অপারেশনও করে থাকেন মো. টুটুল। তার ভুল অপরেশনে রোগী মারা যাওয়ার ঘটনা ইতিপূর্বেও ঘটেছে বলেও স্থানীয় একাধিকজন অভিযোগ করেছেন।

মো. টুটুল নিজেকে অভিজ্ঞ ডাক্তার পরিচয়ে গোমস্তাপুরের ইসলামিয়া ক্লিনিক, রহনপুরের আল হেরা ক্লিনিক, গোমস্তাপুর মহানন্দা ক্লিনিক, মল্লিকপুরের নবাব ক্লিনিক, রহনপুরের জমজম ক্লিনিকে বিভিন্ন সময়ে অপারেশনের কাজ করে থাকেন। স্থানীয় সচেতন মানুষদের মনে প্রশ্ন, কিভাবে একজন ভূয়া ডাক্তার দিনের পর দিন অপারেশনের মত এত বড় কাজ করে চলেছেন এবং ক্লিনিক কর্তৃপক্ষও তার মত ভূয়া একজন ডাক্তার ছদ্মবেশীকে দিয়ে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন? তার হাতে অপারেশন হয়ে রোগী মারা যাওয়ার দায়ভার তাহলে কার? অন্যদিকে, ডাক্তার মোসা. কারিমাতুন নেসা কনক গাইনি বিভাগের চিকিৎসক হয়ে অপারেশনের কাজ করছেন, এটাও সঠিকভাবে চিকিৎসা দেয়া নয়, তার ভুল অপারেশনের কারণে একজন রোগীর মৃত্যুর মত কারণ ঘটানো, এটাও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ বা জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের দেখা দরকার। এদিকে ডাক্তার মোসা. কারিমাতুন নেসা কনক গোমস্তাপুর উপজেলার কয়েকটি ক্লিনিকে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন বলেও জানা গেছে।

অবশ্য জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ যদি প্রয়োজন মনে করেন অথবা জেনেও না জানান ভান করে থাকেন। তাহলেতো এধরণের ভূয়া ডাক্তার বিভিন্ন ক্লিনিকে অপারেশন করবে, আর সার্জিক্যাল ডাক্তার না হয়েও অপারেশন করবে, আর রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এটা কোন সচেতন বা আধুনিক স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্ব পালন করার মত কথা নয়। তাহলে কি আমরা সেই হাতুড়ে যুগেই বসবাস করছি?

এব্যাপারে ভূয়া ডাক্তার হিসেবে অভিযুক্ত মো. টুটুলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমি শুধুমাত্র রহনপুরের আল হেরা ক্লিনিকে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছি। এই ক্লিনিকেই কাজ করি সর্বক্ষণ। অন্য কোথাও অপারশেন বা চিকিৎসা করিনা। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো সবই বানোয়াট। এছাড়া এব্যাপারে কথা বলার জন্য ডাঃ মোসা. কারিমাতুন নেসা কনক এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে, তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এব্যাপারে ইসলামীয় ক্লিনিকের মালিক মো. নকিব এর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করে পরিচয় পাওয়ার পরই পরে কথা বলবো, একটি কাজে ব্যস্ত আছি বলে ফোন রেখে দেন।

ভূল অপারেশনে সুকতারা মৃত্যুর বিষয়ে সুকতারার অভিভাবক চাচা ও ইউপি সদস্য বেলাল উদ্দিন জানান, ইসলামিয়া ক্লিনিকে অপারেশন হয়ে আমার ভাতিজি সুকতারা মারা গেছে। মরেই যখন গেছে, তখন আর ঝামেলা করে কি করবো? আমরা কোন ঝামেলায় যায়নি। তবে এসব ভূয়া বা অনভিজ্ঞ ডাক্তার দিয়ে ক্লিনিক চালিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে সেবার নামে প্রতারণা বন্ধে একমত পোষন করে তিনি বলেন, অবশ্যই এসব প্রতারণা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। ভাল ডাক্তার দিয়ে সেবার মত সেবা প্রদান করেই ক্লিনিক চালানোর ব্যবস্থা নেয়া হোক, অন্যথায় এসব প্রতারণাকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবীও জানান তিনি।

অবশ্য জেলার সিভিল সার্জন ডাঃ সায়ফুল ফেরদৌস মুহা. খায়রুল আতাতুর্ক বলছেন, এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার হলেই তিনি অপারেশনসহ সকল চিকিৎসা দিতে পারবেন। আর পাশ করা ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ অপারেশন করতে পারবে না। ইসলামিয়া ক্লিনিকে রোগী মৃত্যুর বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. সায়ফুল ফেরদৌস খায়রুল আতাতুর্ক এর কাছে জানতে চাইলে তিনি উল্টো প্রতিবেদককেই তার কাছে অভিযোগ দিতে বলেন। অভিযোগ পেলে তখন ব্যবস্থা নেবেন। আবার তিনি এটাও বলেন, ক্লিনিকে রোগী মারা যাওয়ার পর রোগীর অভিভাবকের সাথে মিমাংসা করে নেয়ায় ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না কর্তৃপক্ষের। একজন রোগী ভুল অপারেশনে মারা যাওয়ার পর সাংবাদিককে অভিযোগ করার কথা বলেন সিভিল সার্জন, তাহলে বিষয়টি কি দাঁড়ায়? ইসলামিয়া ক্লিনিকের বিষয়ে জানতে চাওয়া মাত্রই তিনি তাড়াহুড়ো করে অফিসে আসেন, কথা বলা যাবে, বলেই ফোন কেটে দেন।

এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হলেও আধুনিক হাসপাতালের চারিদিকে গড়ে উঠেছে ক্লিনিক এবং শহরের আনাচে-কানাচে বিভিন্ন স্থানেও গড়ে উঠেছে ক্লিনিক। আর গড়ে উঠা এসব ক্লিনিক চলছে সিভিল সার্জন এর সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে। দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে ক্লিনিকের সংখ্যা জেলায়। আর এসব ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের সাথে চরম সৌখ্যতাও রয়েছে সিভিল সার্জনের বলেও একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও জেলার প্রায় সকল সরকারী হাসপাতাল বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পার্শ্ববর্তী স্থানে ক্লিনিক এর ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা গেছে।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.