গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ প্রাইমারি গ্রাউন্ড স্টেশন শীঘ্রই উদ্বোধন

নিজস্ব প্রতিবেদক : গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের পর, এটির নিয়ন্ত্রণ নিতে গাজীপুরে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ প্রাইমারি গ্রাউন্ড স্টেশনটিকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করা হয়েছে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের তেলীপাড়ায় টেলিযোগাযোগ স্টাফ কলেজ সংলগ্ন এলাকায় স্থাপিত, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের-১ প্রাইমারি এ গ্রাউন্ড স্টেশনটি শীঘ্রই উদ্বোধন করা হবে বলে জানা গেছে।
এজন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন নির্মাতা প্রতিষ্ঠাণসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠাণটির ব্যাপারে মুখ খুলছেন না গ্রাউন্ড ষ্টেশনে কর্মরতরাসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাগণ। সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রায় প্রতিদিনই সংবাদ কর্মীরা গাজীপুরের গ্রাউন্ড ষ্টেশনে গিয়ে ভীড় জমাচ্ছেন।
কিন্তু সেখানে কর্মরতরা তথ্য জানাতে অস্বীকার করায় তারা ফিরে আসছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাজীপুর গ্রাউন্ড ষ্টেশনে কর্মরত নির্মাতা প্রতিষ্ঠাণের এক কর্মকর্তা জানান, বিটিআরসি’র বৈধ অনুমতি ছাড়া কোন তথ্য দেয়া সম্ভব নয়। ওই কর্মকর্তা আরো জানান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের প্রাইমারি এ গ্রাউন্ড স্টেশনটি শীঘ্রই উদ্বোধন করা হবে।
এজন্য সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর জানান, গত বৃহষ্পতিবার রাতে (১১ মে) যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল লঞ্চপ্যাড থেকে দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণ করা হয়। এ স্যাটেলাইটটি মহাকাশে ডানা মেলার মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম স্যাটেলাইট ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্থান করে নিয়েছে।
ইতিহাসের সাক্ষী হতে অনেকে রাত জেগে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের এ বিরল দৃশ্যটি সরাসরি প্রচারিত টিভিতে দেখেন। তিনি আরো জানান, উৎক্ষেপণের পর গাজীপুরে স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটিকে।
এ ধরণের আরেকটি গ্রাউন্ড স্টেশন চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় স্থাপন করা হলেও সেটি গাজীপুরে স্থাপন করা গ্রাউন্ড স্টেশনের বিকল্প। মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হবে গাজীপুরের গ্রাউন্ড স্টেশন। খুব শীঘ্রই গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রাইমারি গ্রাউন্ড স্টেশনটি আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন করা হবে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানায়, স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের পর নিজস্ব কক্ষ পথে গিয়ে পৌঁছতে ৮ থেকে ১০দিন সময় লাগবে। পরে সেটির সঙ্গে সংযোগ হয়ে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এনে কাজ শুরু করতে প্রায় তিন মাস সময় লাগবে। স্যাটেলাইটটি সম্পূর্ণ চালু হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের গ্রাউন্ড স্টেশনে হস্তান্তর করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে উৎক্ষেপণের পর উচ্চগতির রকেটটি কয়েক মিনিটের মধ্যে চলে যায় স্বাভাবিক দৃষ্টিসীমার বাইরে। পরে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর রকেটের স্টেজ-১ খুলে নিচের দিকে নামতে থাকে, এরপর চালু হয় স্টেজ-২। পুনরায় ব্যবহারযোগ্য স্টেজ-১ পৃথিবীতে এলেও স্টেজ-২ একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত স্যাটেলাইটকে নিয়ে গিয়ে মহাকাশেই থেকে যায়।
দুইটি ধাপে এই উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপটি হলো লঞ্চ অ্যান্ড আরলি অরবিট ফেইজ (এলইওপি) এবং দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে স্যাটেলাইট ইন অরবিট। এলইওপি ধাপে ৮ থেকে ১০ দিন এবং পরের ধাপে বেশ কিছু সময় লাগবে। উৎক্ষেপণ স্থান থেকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরে যাবে এই স্যাটেলাইট।
৩৫ হাজার ৭০০ কিলোমিটার যাওয়ার পর রকেটের স্টেজ-২ খুলে যাবে। স্যাটেলাইট উন্মুক্ত হওয়ার পরপর এর নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি এবং কোরিয়ার তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনে চলে যাবে। এই তিন স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটটিকে নিয়ন্ত্রণ করে এর নিজস্ব কক্ষপথে (১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অরবিটাল স্পট) স্থাপন করা হবে।
গ্রাউন্ড ষ্টেশনের নিরাপত্তার দায়িত্বে আনসার বাহিনী
গাজীপুর জেলা আনসার ও ভিডিপি’র কমান্ড্যান্ট মোহাম্মদ সিরাজুর রহমান ভূঞা জানান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের গাজীপুরস্থ গ্রাউন্ড স্টেশনের নিরাপত্তার দায়িত্ব বর্তমানে আনসার বাহিনীর সদস্যরা পালন করছে। সরকারের নির্দেশ মোতাবেক সেখানে প্রায় এক প্লাটুনের একটি অঙ্গীভূত আনসার ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তারা সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে আসছেন। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনকে কেন্দ্র করে সেখানে স্থাপিত আনসার ক্যাম্পের আনসার সদস্যদেরকে আরো সতর্কভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আনসার ক্যাম্পের অঙ্গীভূত আনসার প্লাটুন কমান্ডার মোস্তফা শেখ জানান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আমাদের গর্ব, তাই জয়দেবপুর গ্রাউন্ড ষ্টেশনের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে পেরে আমরা গর্ববোধ করছি।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট থেকে যে সুবিধা পাওয়া যাবে
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ যোগাযোগ এবং সম্প্রচার কাজেই মূলত ব্যবহার করা হবে। এ স্যাটেলাইটে থাকছে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার সক্ষমতা। প্রতিটি ট্রান্সপন্ডার প্রায় ৩৬ মেগাহার্টজ বেতার তরঙ্গের সমপরিমাণ।
অর্থাৎ, ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থেকে পাওয়া যাবে প্রায় এক হাজার ৪৪০ মেগাহার্টজ পরিমাণ বেতার তরঙ্গ বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট থেকে। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। আর ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে ভাড়া দেওয়ার জন্য রাখা হবে।
৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২৬টি হচ্ছে কেইউ ব্যান্ডের এবং ১৪টি সি ব্যান্ডের। গাজীপুর ও চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় স্থাপিত দুটি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। এর মধ্যে গাজীপুর প্রধান কেন্দ্র হিসেবে এবং বেতবুনিয়া বিকল্প কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহূত হবে। এরই মধ্যে প্রস্তুত হয়ে গেছে দুটি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র।
এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছে পৃথক একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিবছর অন্যান্য দেশের স্যাটেলাইট পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রায় দেড় কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ ভাড়া হিসেবে পরিশোধ করে।
বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালিত হলে এ অর্থ বাংলাদেশেই থেকে যাবে। ফলে বড় অঙ্কের টাকার বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। দেশের বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর স্যাটেলাইট ভাড়াবাবদ ব্যয়ও কমে আসবে। এ ছাড়া স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া যাবে উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ।
ফলে ব্যান্ডউইথের বিকল্প উৎসও পাওয়া যাবে। এই ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে দেশের দুর্গম দ্বীপ, নদী ও হাওর এবং পাহাড়ি অঞ্চলে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা চালুও সম্ভব হবে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে স্বাভাবিক টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও উদ্ধারকর্মীরা স্যাটেলাইট ফোনে যোগাযোগ রেখে দুর্গত এলাকায় কাজ করতে সক্ষম হবেন।
বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার ভুটান, নেপাল ও এশিয়ার অন্য অংশে কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তানের মতো দেশেও ভাড়া দেওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আয় করতে সমর্থ হবে। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.