গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে প্রাথমিক বিদ‍্যালয় মেরামতের নামে লুটপাট 

গাইবান্ধা প্রতিনিধি: গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার প্রায় সকল প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ই শিশু শ্রেণীর ১০ টাকা, ৪০ হাজার,দেড় লাখ ও দুই লাখ টাকা চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) এর বরাদ্দ পেয়েছেন।
উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে সঠিকভাবে কাজ না করে সামান্য রং চং করে, দুই চারটি ফ‍্যান লাগিয়ে,বিদ‍্যুৎ সংযোগ ও খেলনা ক্রয় করে, মাঠে দুই ট্রলি বালু ফেলে, দুটি টিন পাল্টিয়ে, এক দুই বস্তা সিমেন্ট দিয়ে টয়লেট সংস্কার দেখিয়ে সিংহভাগ টাকা ভাগ বাটোয়ারা করার অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় গুলোর প্রধান শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।
সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে জানাযায়, চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি(পিইডিপি-৪) এর আওতায় ২০২১-২০২২ইং অর্থ বছরে সারাদেশে ১৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ে ২ দুই লক্ষ টাকা মাইনর (ক্ষুদ্র) মেরামতের জন‍্য বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলায় প্রথমে ৬৮ টি বিদ‍্যালয়ে ১ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে এর সংখ্যা বৃদ্ধি করে আরো ২৮ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ে দুই লক্ষ টাকা করে বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে।
বরাদ্দকৃত অর্থ মাইনর(ক্ষুদ্র)মেরামত স্ব-স্ব বিদ‍্যালয়ের ম‍্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে সম্পাদন করতে হবে। কাজ শুরুর পৃর্বে উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার অফিস কর্তৃক মেরামত কাজের প্রাক্কলন তৈরি করে নিয়ে উপজেলা শিক্ষা কমিটির অনুমোদন নিয়ে মেরামত কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে বিদ‍্যালয় ভবন, ওয়াশব্লক এবং টয়লেটের ক্ষতিগ্রস্ত প্লাষ্টার,ভবনের ওয়াল,স্কুল মাঠে মাটি ভরাট, শহীদ মিনার বাধ্যতামূলক, দরজা, জানালা, ব্রেঞ্চ, চেয়ার, কলাপসিবল গেট, বৈদ‍্যুতিক পাখা,সুইচসহ বিদ‍্যালয়ের নিরাপত্তার স্বার্থে যেকোন মেরামত।এছাড়াও বিদ‍্যালয়ের চাহিদাভিত্তিক অন‍্যান‍্য মেরামত করতে  শতভাগ করতে হবে।
আর বিদ‍্যালয় ম‍্যানেজিং কমিটি বিদ‍্যালয়ের কোন কোন খাতে মেরামত প্রয়োজন তার তালিকা প্রস্তুত করে প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের নিকট জমা দিবেন।উপজেলা শিক্ষা অফিসার বরাদ্দ প্রাপ্ত বিদ‍্যালয়ের মেরামতের তালিকা সংগ্রহপূর্বক একত্রে প্রাক্কলন প্রস্তাব তৈরির জন‍্য উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি)এর নিকট প্রেরণ করবেন। উপজেলা প্রকৌশলী কর্তৃক প্রাক্কলন প্রস্তাব প্রস্তুতপূর্বক উপজেলা শিক্ষা অফিসার এর নিকট প্রেরণ করবেন। বাস্তবে এর কিছুই পালন করা হয় না।
এদিকে একই অর্থ বছরে চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) এর সাব-কম্পোনেন্ট মেইনটেন‍্যান্স আওতায় সরকারি প্রাথমিক বিদ‍্যালয় মেরামতের জন‍্য পলাশবাড়ী উপজেলায় ৪০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে।
এছাড়াও বিদ‍্যালয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সকল বিদ‍্যালয়কে কার্যকরী ও শিশুবান্ধব প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করে শিশুদের জন‍্য একটি আনন্দময় শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করতে ও শিক্ষার মানোন্নয়নে স্লিপের দেড় লক্ষ টাকা করে প্রদান করা হয়েছে। এ উন্নয়ন পরিকল্পনার মূল উপজীব্য বিষয় হলো বিদ‍্যালয়ের নিজস্ব বাস্তবতা এবং প্রয়োজন ভিত্তিক বিদ‍্যালয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন। বিদ‍্যাল য়ের সামগ্রিক শিখন-শিখানোর পরিবেশ উন্নয়ন করে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ,শিশুদের বিষয়ভিত্তিক ধারাবাহিক মূল‍্যায়ন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ‍্যোগ গ্রহণ। কিন্তু পলাশবাড়ী উপজেলায় এর কোনোটাই মানা হচ্ছে না।
স্বয়ং উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম গত ১০ আগষ্ট  উপজেলার শ‍্যামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ে আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়ে স্কুলের পরিদর্শন বহিতে লেখেন, প্রধান শিক্ষক কাউকে না জানিয়ে বিদ‍্যালয় ত‍্যাগ করেছেন। এমনকি তিনি সেদিনের হাজিরা খাতায় সাক্ষর পযর্ন্ত করেননি। বিদ‍্যালয়ের মাইনর মেরামতের কাজ এখনো সম্পন্ন করেননি। স্লীপের কাজের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। বিদ‍্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিতি সন্তোষজনক নয়। বিদ‍্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদান সঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে না। বিদ‍্যালয়ের কোন তথ‍্য সঠিকভাবে পাওয়া যায়নি।
বিদ‍্যালয়ের গৃহ, প্রাঙ্গন, অফিস কক্ষ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও সজ্জিত নয়। বিদ‍্যালয়ের শহীদ মিনার সঠিকভাবে সঠিক নিয়মে তৈরি করা হচ্ছে না। তিনি শেষে লিখেছেন, উল্লেখিত অনিয়মসমূহ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন বরাদ্দের কাজ আগামী ৭ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশ প্রদান করলেও প্রধান শিক্ষক উপজেলা সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তার এসব লেখাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নিজের নিয়মেই স্কুল পরিচালনা করে আসছেন বলে অভিভাবকেরা জানান।
উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানাযায়, পলাশবাড়ী উপজেলায় ২০২২ইং অর্থ বছরে ২১৬ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ক্ষুদ্র মেরামত করার জন্য ৮১ টি বিদ্যালয়ের অনুকুলে ২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়। এ ছাড়াও এসব স্কুলে ৪০ হাজার করে টাকা স্লিপ ও ১০ হাজার করে টাকা শিশু শ্রেনীর সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ করা হয়। সব মিলিয়ে স্কুল  ৮১ টি স্কুলে ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ও  কোন স্কুলে ১ লাখ ৫০ হাজারসহ সে স্কুলে আবার ৪০ হাজার টাকা এবং শিশু শ্রেণীর ১০ হাজার টাকা সহ মোটে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়।মোট বরাদ্দের ৫০ শতাংশ টাকা সরকারি কোষাগার থেকে উত্তোলন করে এ যৎ সামান্য কাজ করেছেন কতিপয় প্রতিষ্ঠান প্রধানগন। স্কুলগুলোতে এবছর শহীদ মিনার বাধ্যতামূলক করলেও তিনভাগ স্কুলের প্রধান শিক্ষক তা মানেনি।
সচেতন মহলের অভিযোগ তদারকি কর্মকর্তারা এসব কাজ পরিদর্শন না করেই ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে শতভাগ কাজ বাস্তবায়ন দেখিয়ে ইতোমধ্যেই চুড়ান্ত বিল উত্তোলনের জন্য প্রধান শিক্ষকগনের নিকট ছাড়পত্র প্রদান করেছেন।যা বর্তমানে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের টেবিলে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
চলতি মাসে বিদ্যালয় গুলো সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায় উপজেলার সুইগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,উত্তর সুলতানপুর বাড়াইপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,শিশুদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মোস্তফাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়,ডাকের পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খামার নড়াইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শ্যামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাকোয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জেবেদা বড় ভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে অধিকাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষক আছে শিক্ষার্থী নেই। আবার কোথাও শিক্ষক আছে অথচ শিক্ষার্থী নেই। উপস্থিতি খুবই কম।অনেক স্কুল সাড়ে ৯ টা থেকে ১০ টায় সময় খোলা হয়।আবার অনেক স্কুল বেলা ৩ টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়।
এছাড়াও শিক্ষকরা তাদের ইচ্ছে মত স্কুলে যাতায়াত করেন। যথা সময়ে স্কুল গুলোতে পতাকা উত্তোলন করা হয় না।অনেক স্কুলে এসেম্বিলি ও জাতীয় সঙ্গীত পর্যন্ত বাজানো হয় না।অভিভাবক সমাবেশ ও মা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় কাগজে কলমে ।
স্কুলগুলোর পরিদর্শন বহিতে প্রথম মাস থেকে দুই বছর পরিদর্শন বহিতে স্বাক্ষর নেই অনেক উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার। তারা প্রধান শিক্ষকদের মাধ্যমে  শিক্ষক শিক্ষার্থীদের হাজিরা খাতা উপজেলা শিক্ষা অফিসে নিয়ে এসে স্বাক্ষর দিয়ে বিদ্যালয় পরিদর্শন দেখানো হয়।
এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা,নাজমা আকতার বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তারা কাজের প্রতি আন্তরিক না হওয়া, এবং যথাযথ মনিটরিং না করার জন্যই কাজের গুনমান খারাপ হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুজ্জামান নয়ন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, আগামী শিক্ষা কমিটির মিটিংয়ে বিষয়টি উত্থাপন করা হবে।কোথাও কোন অসঙ্গতি পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর গাইবান্ধা প্রতিনিধি মোঃ শাহরিয়ার কবির আকন্দ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.