খুনি হাসিনার রাজনৈতিক দর্শন

রহমান উজ্জ্বল: খুনি হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনে সমগ্র বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল এক অদৃশ্য কারাগারে। স্বৈরাচার হাসিনা এবং আওয়ামী গোষ্ঠী ক্রমাগত খুন -গুম, হামলা- মামলা দিয়ে দেশের জনগণকে আতঙ্কিত করে ফেলেছিল। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, পুলিশ লীগ মিলে পুরো দেশটাকে পরিণত করেছিল মৃত্যু উপত্যাকায়।
উন্নয়নের নামে দেশটাকে লুটপাট, ডাকতি আর চুরির নিরাপদ আস্তানা বানিয়ে ফেলেছিল আওয়ামী লীগ ও সরকারি কর্মচারীরা। আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগের মত তারা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করেছিল – আওয়ামী জাহেলিয়াত।
মাফিয়া শাসক হাসিনা ছিল মূলত তার বাবা শেখ মুজিবের মতই একরোখা ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির। শেখ মুজিব তার পোষা রক্ষী বাহিনী দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা- নাগরিককে হত্যা করেছিল।
শেখ হাসিনা আলাদা বাহিনী গঠন না করে বরং দেশের বর্তমান বাহিনীগুলোকে তার অনুগত করে দেশে অবাধে খুন -গুম ,হামলা- মামলার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
হাসিনা শেখ স্বৈরশাসনের মাপকাঠিতে এরশাদ বা আইয়ুব খানকে বহু আগেই ছাড়িয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট হাসিনা স্বেচ্ছাচারিতা, নিষ্ঠুরতা নাৎসি হিটলারকেও হার মানায়। আধুনিক সভ্যতায় এরকম নৃশংস, নিষ্ঠুর ও প্রতিহিংসা পরায়ণ নারী স্বৈরাশাসক আর দ্বিতীয়টি দেখেনি বিশ্ববাসী।
বিগত ১৬ বছরে হাসিনার বর্গী বাহিনীসমূহ কার উপর- কখন ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেই আতঙ্কে আতঙ্কগ্রস্থ থাকত দেশবাসী। একদিকে অত্যাচার,অপশাসন আর অন্যদিকে উন্নয়নের গল্প শুনতে শুনতে হাঁপিয়ে উঠেছিল দেশের মানুষ। ক্ষোভে-ঘৃণায় দেশের মানুষ বারবার নির্বাচন বর্জন করলেও স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী এসবের তোয়াক্কা করেনি। বরং দেশের শাসন বিভাগ -বিচার বিভাগকে হাতের মুঠোয় নিয়ে খুনি হাসিনা একেবারেই বেসামাল হয়ে পড়ে। আর এসব অপকর্মে তার সার্বক্ষণিক এবং সবসময়ের বিশ্বস্ত সহযোগী ছিল আমাদের তথাকথিত সুপ্রতিবেশী দেশ ভারত।
ভারতে পালিয়ে যাওয়া তাদের সেবাদাসী হাসিনার শাসন কাঠামো ছিল মূলত ভারত নির্দেশিত। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি সাজানো হতো ভারতের দেয়া প্রেসক্রিপশনে। ভারতের অব্যাহত অন্ধ সমর্থন তাই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে আরো বেশি বেপরোয়া ও স্বেচ্ছাচারী করে তুলে। এ সময় হাসিনা জনগণের বদলে পুরোপুরি বন্দুকের নলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর ওদিকে ভারত হাসিনাকে অব্যাহত সমর্থনের বিনিময় এ দেশের সম্পদ শুষে নেয় অক্টোপাসের মতো। লোভী হাসিনা বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাটামোকে অনেকটা ভারতের করদ রাজ্য বা ভারতের ক্ষমতাসীন দলের বাংলাদেশী উইংয়ে এ পরিণত করেছিল।
খুনি হাসিনা কখনো কোন ব্যাকরণ মেনে রাজনীতি করেনি। দুর্নীতি, লুটপাট ,নৃশংসভাবে ভিন্নমত দমন এবং একজন মানুষ শেখ মুজিবকে মহা মানব বানানোর অনবরত চেষ্টাই ছিল শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দর্শন। মুক্তিযুদ্ধে একটাও গুলি না ফুটানো স্বেচ্ছা কারাবরণকারী শেখ মুজিবকেই স্বাধীনতার একমাত্র স্টেক হোল্ডার হিসেবে চাপিয়ে দেয় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী গোষ্ঠী। শেখ মুজিবকে জাতির পিতা ঘোষণা দেয়।
শেখ হাসিনা ও তার ছোট- বড় দোসররা দেশটাকে নিজেদের জমিদারি অথবা বাপ দাদার তালুক বানিয়ে ফেলে। এ বিষয়ে শেখ হাসিনা রাকঢাক না করেই বলত- দেশটা আমার বাবা স্বাধীন করেছে। তাই দেশটা আমার। খুনি ফ্যাসিস্ট হাসিনার রাজনীতি ছিল ভয় ও আতঙ্ক নির্ভর। হাসিনার কথাই ছিল তখন দেশের আইন। রাজনীতিতে ভায়োলেন্স তৈরি করে প্রতিপক্ষ বা ভিন্ন মতকে নিশ্চিহ্ন করা ছিল তার অন্যতম রাজনৈতিক কৌশল। বিশেষ আলো একটি কৌশল ছিল, প্রতিপক্ষকে রাজাকার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী, সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি সব ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া। ভিন্ন দল ও মতের মানুষের মধ্যে ভয়ের ট্রমা তৈরি করে তাদের দমিয়ে রাখা হতো। আর বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে জনগণকে ব্যতিব্যস্ত রাখা হতো বছর জুড়ে। এদেশের মিডিয়া জগত সরকারের প্রচার ও কীর্তন গাওয়ার মেশিনে পরিণত হয়েছিল তখন। খুনি হাসিনার ক্ষমতায় আরোহণের শুরুটাই ছিল প্রশ্ন সাপেক্ষ।
ওয়ান ইলেভেনের ফখরুদ্দিন -মঈনের বিশেষ আনুকূল্যে সরকার গঠন করেই হাসিনা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ক্ষমতায় আরোহণের মাত্র ৫১ দিনের মাথায় পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের গণহত্যা সংঘটিত হয় হাসিনা ও তার প্রভু ভারতের মদদে। এরপরও খুনি হাসিনা আরও অনেকগুলো গণহত্যা সংঘটিত করেছে।
বিএনপিসহ দেশের হাজার হাজার মানুষকে খুন-গুম করেছে। হাজার হাজার মানুষকে নির্যাতন করে চিরতরে পঙ্গু করে দিয়েছে। প্রায় দেড় লক্ষ মামলায় ৬০ লক্ষ বিএনপি নেতা- কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এ সময় ফ্যাসিস্টের অনুগামী পুলিশ বহুবার মৃত মানুষ অথবা প্রবাসে অবস্থান করা মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে দেশজুড়ে হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে।
পতনের পর শেখ হাসিনা সম্পর্কে যে তথ্যগুলো সামনে আসছে, তা প্রায় সবই গা শিউরে ওঠার মত। রক্তপিপাসু ডাকাতের মত বাংলাদেশের মানুষকে সামান্য কারণেই কচুকাটা করেছে শেখ হাসিনা ও তার ডাকাত দল। মানুষের রক্ত দিয়ে হোলি খেলেছে হাসিনার অনুগামী ফ্যাসিস্ট রেজিম। বহু বছর ধরে রক্ত দিয়েছে এদেশের বিরোধী দল ও মতের মানুষ। এমনকি, থানায় এ সময় এইসব নির্যাতিতদের মামলা পর্যন্ত নেয়া হত না। শেখ পরিবার কখনোই বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করেনি।
৭৪ এর দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, ৯৬ সালের পরে উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা, বিগত ১৬ বছরে সার্বিক রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা- এসব কথার সপক্ষে জ্বলন্ত উদাহরণ। আকণ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্ত আওয়ামী লীগ আমলে লুটপাটের মছ্ছব শুরু হয়। হাসিনার বিগত বছরগুলোতে ২৪০ বিলিয়ন ডলার শাসকগোষ্ঠী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিদেশে পাচার করে। ফলে দেশের অর্থনীতি ধ্বসে পড়তে সময় লাগেনি। স্বৈরাচার সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার নোট ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ে। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দেশের পরিস্থিতি আরো জটিল হয়। একদিকে মুদ্রার মান কমে যায় অন্যদিকে জিনিসপত্রের দাম হয় আকাশচুম্বি। হাজারো অত্যাচার- নিপীড়নের মধ্যেও এই জালেমশাহির বিরুদ্ধে লড়াই, আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিল এদেশের বিরোধী দলগুলো ও নাগরিকরা। এই লড়াই আন্দোলনে অসংখ্য মানুষ খুন হয় তাদের। হাজার হাজার মানুষ গুম হয় ফ্যাসিস্টদের হাতে। হাজার হাজার মানুষ বন্ধুত্বের অভিশাপ বরণ করে। লক্ষ লক্ষ পরিবার ভিটেমাটি ছাড়া হয় কিংবা বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এত কিছুর পরেও মজলুম মানুষ শেষ পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত রাখে। সত্যের পথে আলোর আশায় চেয়ে থেকে থাকে। অবশেষে আলো আসে।
আবু সাঈদের টগবগে লাল রক্তের মতো নতুন সূর্য উদিত পুবের আকাশে। আস্তে আস্তে সূর্য ওঠে- মানুষেরাও জেগে উঠতে থাকে। জাগ্রত মানুষ দেশের মেধাবী ছাত্র অথবা সন্তানদের হত্যার বিচার চায়। সন্তান অথবা ভাই -বোন হত্যার বিচারের দাবিতে লাখো- কোটি জনতা পথে নেমে আসে। সমুদ্রের মতো গর্জন করতে থাকে তারা। আগ্নেয়গিরির মত বিস্ফোরিত হয়। ছাত্র- জনতার সেই বিস্ফোরিত তোপের মুখে দানবের দুর্গ ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়।
অবশেষে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রায়, ২ হাজার মানুষকে হত্যা এবং ত্রিশ হাজার মানুষকে পঙ্গু করে দিয়ে ভারতে পালিয়ে যায় রক্তচোষা স্বৈরাচার, বাংলাদেশের ইতিহাসের অভিশাপ শেখ হাসিনা। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.