খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের মধ্যে মতভেদ

 

ঢাকা প্রতিনিধি: দীর্ঘ ১০ বছর ধরে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি নাই। তবে নিজেদের মধ্যে ঐক্যের কারণে আদালত অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে দাপট দেখিয়ে আসছেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা। তবে দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার দণ্ডপ্রাপ্তির বিষয়ে  হাইকোর্টে আপিল দায়েরের পর থেকেই তার আইনজীবীদের মাঝে ঐক্যে ফাটল ধরেছে। মামলার ফাইল প্রস্তুত করা থেকে শুনানি পর্যন্ত এবং আরও  বেশ কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইনজীবীদের মাঝে এই ফাটল সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন খালেদা জিয়ার একাধিক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।

বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের মধ্যে বর্তমানে দু’টি গ্রুপ দৃশ্যমান। সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে তারা ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে। এর একটি ভাগে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের অধীনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবদীন ও সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুবউদ্দিন খোকন। খালেদা জিয়ার মামলাসহ বিভিন্ন জাতীয় বিষয় নিয়ে তারা নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে সরব ভূমিকা পালন করছেন।

তবে ঘরে বসে শুধু সংবাদ সম্মেলনে সন্তুষ্ট নন বিএনপির আরেক অংশের আইনজীবীরা। পাশাপাশি দীর্ঘ ১০ বছর ধরে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়া এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে এই অংশটি ‘গণতন্ত্র ও খালেদা জিয়ার মুক্তি আইনজীবী আন্দোলন’ নামের ব্যানারে সভা-সমাবেশ করছে। এই অংশের অন্যতম নেতা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার বিটিসি নিইজ ঢাকা প্রতিনিধিকে বলেন, ‘‘আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের আগে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা করা হয়নি। তাছাড়া ফোরামের ব্যানারে টিভি ক্যামেরার সামনে ঘরে বসে শুধু সংবাদ সম্মেলন করলেই হবে না, খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রশ্নে রাজপথে নামতে হবে।

এদিকে, ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের বিষয়ে আইনজীবীদের ‘ক্ষোভ’ মেনে নিয়ে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘অনেকদিন ধরে কমিটি হয় না। এজন্য অনেকের ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। কমিটি করতে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার।

এর বাইরেও খালেদা জিয়ার মামলাগুলোকে কেন্দ্র করে তার আইনজীবীরা অঘোষিত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করছেন।

একটি অংশে আছেন— বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, খালেদা জিয়ার মামলার অন্যতম আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী ও বিএনপির আইন সম্পাদক কায়সার কামালসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী। খালেদা জিয়ার কোনও মামলা ফাইল করা হলে এই অংশ থেকে কায়সার কামালকেই বেশি উদ্যোগী হতে দেখা যায়।

আরেকটি অংশে আছেন— ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, খন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নুল আবেদীন, মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ প্রমুখ আইনজীবী। আইনজীবীদের এই অংশটি শুধুমাত্র উপস্থিতির খাতিরে খালেদা জিয়ার মামলার শুনানিতে হাজির থাকেন। কিন্তু মামলার প্রস্তুতিতে তাদেরকে উল্লেখযোগ্য কোনও দায়িত্ব দেওয়া হয় না। এদেরকে নিষ্ক্রীয় রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি খালেদা জিয়ার কোনও মামলার ফাইল তৈরিতে এই অংশের আইনজীবীদের সঙ্গে কোনও আলাপও করা হয় না। বিশেষ করে ব্যারিস্টার কায়সার কামাল তার নিজের চেম্বার থেকেই মামলা প্রস্তুত করেন এবং বিভিন্ন আদালতে মামলাগুলোর বিষয়ে তিনিই দেখভাল করেন, যা জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের অনেকেই পছন্দ করেন না। এখানেই শেষ নয়, মামলার বিষয়বস্তু নিয়েও কায়সার কামালকে বেশ কিছু ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কুমিল্লার আদালতে দায়ের হওয়া নাশকতার মামলায় বিএনপি সমর্থিত স্থানীয় আইনজীবীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ আগস্ট  দলের যুগ্ম-মহাসচিব ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন শুনানি করতে যান। শুনানি নিয়ে মামলার পরবর্তী দিন ৩০ আগস্ট  ধার্য রাখেন আদালত। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, দলের আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে এ নিয়ে অভিযোগ করেছেন ।

এরপর গত ৩০ আগস্ট একই মামলায় কুমিল্লার আইনজীবীদের সহযোগিতা করতে সেখানে যান খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী ও দলটির আরেক আইন সম্পাদক অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ্ মিয়া। শুনানি শেষে আদালত মামলার পরবর্তী তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ধার্য করেন। জানা যায়, এক্ষেত্রেও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল লন্ডনে  তারেক রহমানকে ফোন করে অভিযোগ করেন। এরপর তারেক রহমান সানাউল্লাহ মিয়াকেও ফোন করেন এবং তার কাছে জানতে চান, ‘আপনারা শুনানিতে কী করলেন?’ তখন সানাউল্লাহ্ মিয়া ৩০ আগস্টের বিচারিক আদালতের আদেশ তাকে পড়ে শোনান। এই ফোনালাপের পর সানাউল্লাহ্ মিয়া মনক্ষুণ্ন হন। নাম ও পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। পরে বিষয়টি নিয়ে কায়সার কামালকে সতর্ক করেন সানাউল্লাহ্ মিয়া।

গত ৫ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উপস্থিতিতে এই বৈঠক করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। ব্যারিস্টার খোকন এসময় ব্যারিস্টার কায়সার কামালকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তুমি খালেদা জিয়ার মালিক হতে চাচ্ছো। আর আমরা খালেদা জিয়াকে জেল থেকে বের করার চেষ্টা করছি।’ এমনকি রিট পিটিশন প্রস্তুতের বিষয়ে কায়সার কামালের যোগ্যতা নিয়েও তখন প্রশ্ন তোলেন ব্যারিস্টার খোকন। ওই বৈঠকে খালেদা জিয়ার মামলার প্রশ্নে আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী ছাড়া অন্যান্য সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে কায়সার কামাল বেয়াদবি করছেন বলেও অভিযোগ তোলা হয়। পরে অবশ্য মির্জা ফখরুল পরিস্থিতি সামাল দেন।

তবে ঘটনাগুলোকে ‘মনগড়া’ বলে দাবি করেন ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বিটিসি নিউজ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব আইনজীবী ও খালেদা জিয়ার নিযুক্ত যেসব আইনজীবী আছেন, তারা সবাই সম্মিলিতভাবে সব আইনি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সবাই সম্মিলিতভাবে মামলাগুলো পরিচালনা করছি।’

একই বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘যার যা প্রয়োজন সেই ঐক্যের মাধ্যমেই কাজ হচ্ছে। ঐক্য আছে এবং থাকবে।’

খালেদা জিয়ার মামলাগুলোকে কেন্দ্র করে তার আইনজীবীদের মধ্যে ঐক্যে ফাটল সৃষ্টির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.