কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহী অঞ্চলের কর্মকর্তাদের জন্য খামারি মোবাইল অ্যাপ

নিজস্ব প্রতিবেদক: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের কর্মকর্তাদের জন্য খামারি মোবাইল অ্যাপ ও ক্রপ জোনিং সিস্টেম বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) সকালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের আয়োজনে রাজশাহী অঞ্চল অতিরিক্ত কৃষি পরিচালকের সম্মেলন কক্ষে এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন, বিএআরসি, এসআরএস বিভাগের সদস্য পরিচালক ড. মোশাররফ উদ্দিন মোল্লা।
কর্মশালায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন, ক্রপ জোনিং প্রকল্পের বিএআরসি সয়েল এক্সপার্ট সাব্বির হোসেন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, রাজশাহী অঞ্চল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ড আজিজুর রহমান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, রাজশাহী আঞ্চলিক বীজ প্রত্যায়ন এজেন্সি অফিসার ড মোতালেব হোসেন। ক্রপ জোনিং সিস্টেমের উপস্থাপনা করেন ক্রপ জোনিং প্রকল্পের প্রজেক্ট ম্যানেজার আবিদ হোসেন চৌধুরী। খামারি মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার বিষয়ক উপস্থাপনা করেন ক্রপ জোনিং প্রকল্পের পরিচালক (কম্পিউটার ও জিআইএস ইউনিট) হামিদুর রহমান।
কর্মশালায় জানানো হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। তবে দ্রুত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আবাদি জমির পরিমান হ্রাস, তুমি ও মৃত্তিবন সম্পদ এবং কৃষি উপকরণের কার্যকর ও সঠিক ব্যবহার, গবেষণার সাথে মাঠ পর্যায়ে ফলনের পার্থক্য, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধির মতো বহুবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন বর্তমান কৃষি। ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমি এবং সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের বিপরীতে বর্ধিষ্ণু জনগোষ্ঠীর খাদ্যের যোগান দিতে হলে কৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ প্রেক্ষিতে টেকসই কৃষি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রনয়ন ও লাগসই প্রযুক্তির প্রয়োগ অপরিহার্য। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) কৃষির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় টেকসই কৃষি উৎপাদন পরিকল্পনা প্রনয়নের লক্ষ্যে ২০১৭ সাল হতে ক্রপ জোনিং বাস্তবায়ন করছে।
উপজেলা ভিত্তিক ভূমি ও মৃত্তিকা এবং জলাবায়ুর তথ্য উপাত্ত ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়া করণে জিওস্পেশাল প্রযুক্তি (জিআইএস, রিমোট সেনসিং, জিপিএস) ব্যবহার করে গ্রুপ জোনিং উন্নয়নের কাজ চলমান। ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা বিবেচনায় গ্রুপ জোনিং অনুযায়ি ফসল উৎপাদন পরিকল্পনা করা হলে ফলন উলে­খযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৯৫টি উপজেলার মধ্যে ৪৫৮টি উপজেলায় ৭৬টি ফসলের উপযোগিতা নিরুপন, ফসল জোন নির্ধারন এবং সার সুপারিশ প্রনয়ন সম্পন্ন হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে কৃষকসহ অন্যান্য উপকারভোগির নিকট উন্নত কৃষি সেবা প্রদানে ফসল উৎপাদন পরামর্শক হিসাবে ‘খামারি’ মোবাইল অ্যাপ তৈরী করা হয়েছে।
অ্যাপটি জিওস্পেশাল প্রযুক্তি নির্ভর একটি স্মার্ট কৃষি অ্যাপ, ফলে কৃষক নিজ জমিতে দাড়িয়ে তাৎক্ষনিকভাবে সেই জমির জন্য উপযোগি ফসল, সার সুপারিশসহ অন্যান্য তথ্য সহজেই জানতে পারবে। খামারি অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে জমির উপযোগি ফসল আবাদ এবং সেই ফসলের জন্য সুপারিশকৃত সার প্রয়োগ করা হলে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষাসহ অধিক ফলন প্রাপ্তি ও আর্থিক লাভ অর্জিত হবে। খামারি অ্যাপটি বাংলায় প্রস্তুত করায় এটি সহজেই বোধগম্য এবং এর ব্যবহার পদ্ধতি কৃষক বান্ধব। এটি ট্যাব এবং মোবাইল ডিভাইসে ব্যবহার করা যাবে এবং অহফৎড়রফ ও ওঙঝ অপারেটিং সিস্টেমে চলবে।
অ্যাপটি গুগল প্লে-স্টোর এবং ম্যাক অ্যাগ স্টোর হতে সহজেই ডাউনলোড করা যাবে। ফসল উৎপালন পরামর্শক। টেকসই উৎপাদন নিশ্চিতকরণে খামারি অ্যাপটি বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি চর্চা অনুসরণে কৃষকদের সক্ষম করে তুলবে। নিম্নে খামারি মোবাইল অ্যাপ প্রদত্ত সেবাসমূহ সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।
জমির উপযোগি সঠিক ফসল নির্বাচন, যা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। মাটির উর্বরতামান অনুযায়ি কৃষি জমির অবস্থান এবং ইউনিয়নভিত্তিক ফসল ও ফসল বিন্যাস অনুযায়ি সুষম সার সুপারিশ ও প্রয়োগ পদ্ধতি, যা ফলন বৃদ্ধি, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা এবং পরিবেশ দূষণরোধে সহায়ক। কৃষি প্রযুক্তি, ফসলের জাত, ফলন, জীবনকাল বিষয়ক তথ্য, যা ফসল জাত নির্বাচন ও ফসল উৎপাদন ব্যবস্থাপনার জন্য সহায়ক।
উপজেলাভিত্তিক উপযোগি ফসল এলাকার পরিমান ও মানচিত্র, যা ফসল জোনভিত্তিক উৎপাদন পরিকল্পনা প্রনয়নে সহায়ক। জমির অবস্থানভিত্তিক ভূমি ও মাটির বৈশিষ্ট্য, জৈবপদার্থ, মাটির প্রতিক্রিয়া ও উর্বরতামান সম্পর্কিত তথ্য, যা ফসল আবাদে মাটি ব্যবস্থাপনায় সহায়ক। ফসল আবাদ ও ফসলবিন্যাস অনুশীলনে লাভের পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা লাভ, যা ফসল নির্বাচনে কৃষকের জন্য সহায়ক। মাটির পুষ্টি উপাদান উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক তথা, যা টেকসই ফসল উৎপাদন ব্যবস্থা প্রতিপালনে সহায়ক।
খামারি অ্যাপ প্রদত্ত সেবার কার্যকারিতা যাচাইঃ খামারি অ্যাপ প্রদত্ত সার সুপারিশের কার্যকারিতা যাচাইয়ে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমভূক্ত প্রতিষ্ঠান এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় ২০২২-২৩ সালে ৩৮টি উপজেলায় রবি, খরিফ-১ এবং খরিফ- ২ মৌসুমে মোট ১১টি ফসলের প্রদর্শনী ট্রায়াল এবং ২০২৩-২৪ সালের রবি মৌসুমে ৬০টি উপজেলায় বোরো ধানের প্রদর্শনী ট্রায়াল কৃষকের জমিতে বাস্তবায়ন করা হয়।
প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, ২০২২-২৩ সালে খামারি অ্যাপ প্রদত্ত সার সুপারিশ ব্যবহারে রবি মৌসুমের ৭টি ফসলের (বোরো ধান, গম, ভুট্টা, আলু, সরিষা, মসুর ডাল, পেঁয়াজ) ১৬টি প্রদর্শনী ট্রায়ালের গড় ফলাফলে কৃষক চর্চার তুলনায় সার খরচ ১৩.২২% কম ও ফলন বৃদ্ধি ১০.৪৩% এবং ২০২৩ সালে খরিফ-১ মৌসুমের ৩টি ফসলের (পার্ট, তিল, মুগ ডাল) ৭টি প্রদর্শনী ট্রায়ালে ২৭.৩৪% কম সার খরচ ও ১০.০৪% ফলন বৃদ্ধি হয়েছে। খরিফ-২ মৌসুম ২০২৩ সালে আমন ধানের ৩৪টি প্রদর্শনী ট্রায়ালের গড় ফলাফলে সারের খরচ ৩৩.৯৯% কম ও ৬.৮৩% ফলন বৃদ্ধি হয়েছে এবং ২০২৩-২৪ সালের রবি মৌসুমে বোরো ধানের ৬০টি প্রদর্শনী ট্রায়ালে ১৮.২১% কম সার খরচ ও ৫.৫৯% ফলন বৃদ্ধি হয়েছে।
আমন এবং বোরো ধানে খামারি অ্যাপ ব্যবহারে আর্থিক লাভঃ প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, আমন ধানের ৩৪টি প্রদর্শনী ট্রায়ালে খামারি অ্যাপ প্রদত্ত সার সুপারিশ ব্যবহারে কৃষক চর্চার তুলনায় সার খরচ প্রতি হেক্টরে ৪,৭৩৫ টাকা সাশ্রয় এবং ৩৪০ কেজি ফলন বৃদ্ধি যার মূল্য ৩২ টাকা কেজি হিসেবে ১০,৮৮০ টাকা অর্থাৎ হেক্টর প্রতি মোট আর্থিক লাভ ১৫,৬১৫ টাকা হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ৫৭ লক্ষ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে সার সংক্রান্ত খামারি অ্যাপের সুপারিশ দেশব্যাপী বাস্তবায়ন করা হলে প্রায় ৮৯৬৫ কোটি টাকা আর্থিক লাভ অর্জন করা সম্ভব হতো। বোরো ধানের ৬০টি প্রদর্শনী ট্রায়ালের প্রাপ্ত ফলাফলে প্রতীয়মান হয়, খামারি অ্যাপ প্রদত্ত সার সুপারিশ ব্যবহারে কৃষক চর্চার তুলনায় প্রতি হেক্টরে সার খরচ ৩,৭৪২ টাকা সাশ্রয় এবং ৩৯০ কেজি ফলন বৃদ্ধি যার মূল্য ৩২ টাকা কেজি হিসেবে ১২,৪৮০ টাকা অর্থাৎ হেক্টর প্রতি মোট আর্থিক লাভ ১৬,২২২ টাকা হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২৩-২৪ সালে বাংলাদেশে ৫০.৫৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে খামারি অ্যাপ প্রদত্ত সার সুপারিশ ব্যবহার করা হলে দেশব্যাপী প্রায় ৮২০৫ কোটি টাকা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব।
খামারি অ্যাপ ব্যবহারে সার সাশ্রয়, জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমভূক্ত প্রতিষ্ঠানের ১২টি এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় ২২টি সহ ২০২৩ সালে মোট ৩৪টি উপজেলায় স্থাপিত আমন ধানের প্রদর্শনী ট্রায়ালে খামারি অ্যাপের সুপারিশ অনুযায়ী হেক্টর প্রতি বিভিন্ন ধরনের সার যেমন ইউরিয়া, ডিএপি, টিএসপি, এমওপি এবং জিপসাম ব্যবহার কৃষকদের প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় সারের ব্যবহার কম হয়েছে।
যেমন ইউরিয়া ব্যবহার ১২%, ডিএপি ৫৯%, টিএসপি ৭২%, এমওপি ১৪% এবং জিপসাম ২০% হ্রাস পেয়েছে। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় বাস্তবায়িত বোরো ধানের ৬০টি প্রদর্শনী ট্রায়ালে খামারি অ্যাপের সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতি হেক্টরে বিভিন্ন সারের ব্যবহার কৃষকদের প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় উলে­খযোগ্য হারে কম ছিল।
নির্দিষ্টভাবে, ডিএপি ব্যবহার ৪৪.৫৭%, টিএসপি ৫৬.১৮%, এমওপি ১৫.৩২% এবং জিপসাম ৯.৭২% হ্রাস পেয়েছে। তবে, প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় খামারি অ্যাপের সুপারিশ অনুযায়ী ইউরিয়ার ব্যবহার মাত্র ০.৯১% বেশি ছিল। প্রদর্শনী ট্রায়ালের ফলাফলে প্রতীয়মান হয় কৃষকের গতানুগতিক সার ব্যবহারের তুলনায় খামারি অ্যাপ প্রদত্ত সার সুপারিশ ব্যবহারে উলে­খযোগ্য হারে সার খরচ সাশ্রয় ও ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
ফলশ্রুতিতে সার আমদানি খরচ কমানো এবং বন্ধিত ফলনের মাধ্যমে অর্জিত আর্থিক লাভ দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। পরিমিত সার ব্যবহারে মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি ‘খামারি অ্যাপ কৃষি ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি, গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে, যা ভবিষ্যতে টেকসই কৃষি অনুশীলনের লক্ষ্যে কৃষক ও নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চলনা করেন, রাজশাহী বোয়ালিয়া মেট্রোপলিটন কৃষি অফিসার ফারজানা হক।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি জি, এম হাসান-ই-সালাম (বাবুল) রাজশাহী। # 

 

 

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.