কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত ‘ভেবেছিলাম মরেই যাব’

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নিউ জলপাইগুড়ির কাছে শিয়ালদহগামী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের সঙ্গে একটি মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় আজ সোমবার অন্তত ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। অন্তত হয়েছে  ৬০ জন। বার্তা সংস্থা পিটিআই সূত্রে এই তথ্য জানানো হয়েছে। তবে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
স্থানীয় প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, সোমবার সকাল পৌনে ন’টা নাগাদ দার্জিলিং জেলার ফাঁসিদেওয়ার রাঙাপানি স্টেশনের কাছে যাত্রীবাহী ওই ট্রেনের পিছনে একটি মালগাড়ি ধাক্কা মারে।
সংঘর্ষের তীব্রতায় কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এর মধ্যে একটি মালবাহী ট্রেনের ইঞ্জিনের উপরে উঠে যায়, অন্য দুটি বগি দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে। দুর্ঘটনার কবলে আসা বগির মধ্যে দু’টি পার্সেল ভ্যান রয়েছে এবং একটি গার্ডের কোচ। 
এদিকে, পশ্চিমবঙ্গের রানীপাত্র রেলওয়ে স্টেশন এবং ছাত্তার হাট জংশনের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং সিস্টেম, সকাল ৫.৫০ থেকে কাজ করছিল না বলে পিটিআইকে জানিয়েছেন এক রেলের কর্মকর্তা। দুর্ঘটনার পিছনে এটি একটি সম্ভাব্য কারণ হিসেবে অনুমান করা হচ্ছে।
“ট্রেন নং ১৩১৭8 (শিয়ালদহ কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস) রাঙ্গাপানি স্টেশন থেকে সকাল ৮.২৭ নাগাদ ছেড়ে যায়। রানীপাত্র রেলওয়ে স্টেশন এবং ছাত্তার হাটের মধ্যে ট্রেনটি থেমেছিল কারণ সকাল ৫.৫০ থেকে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং-এ ত্রুটি দেখা দিয়েছিল”, পিটিআইকে বলেন ওই কর্মকর্তা।  
অন্যদিকে, প্রাথমিক ভাবে অনুমান করা হচ্ছে মালবাহী ট্রেনের চালক সিগন্যাল দেখেননি বলে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে সোমবার সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছিলেন ভারতীয় রেলওয়ে বোর্ডের সিইও এবং চেয়ারপার্সন জয়া ভার্মা সিনহা।
আগরতলা থেকে শিয়ালদহমুখী ১৩১৭৪ কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা আরও একবার উস্কে দিয়েছে ২০২৩ সালের ওড়িশার বালাসোরের কাছে ঘটা ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার স্মৃতিকে।
সেই ঘটনায় বালেশ্বরের কাছে বাহানগা স্টেশনের কিছুটা দূরে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার মুখে পড়ে হাওড়া থেকে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেস। বালাসোরে ২০২৩ সালের দোসরা জুন রাতে দুটি যাত্রীবাহী এবং একটি মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষে মৃত্যু হয় ২৯৩ জনের, আহত হন এক হাজারেরও বেশি মানুষ।
সোমবার দুর্ঘটনাগ্রস্ত কাঞ্চনজঙ্ঘার এক্সপ্রেসের এক যাত্রী শ্রুতিরাজ রায় তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, হঠাৎই তীব্র ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। আশঙ্কা করেছিলাম ট্রেনের বগি হয়তো লাইনচ্যুত হয়েছে কিন্তু পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ তখনও বুঝতে পারিনি।
ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আসার পর প্রথমে স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্ধারকার্যে হাত লাগান।
এরপর দুর্ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় রেল পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন, সেনা বাহিনী, ন্যাশানাল ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিম, চিকিৎসক-সহ উদ্ধারকারী টিম। যুদ্ধকালীন তৎপরতাতে শুরু হয় আক্রান্তদের উদ্ধারের কাজ ।
উত্তরবঙ্গে বেশ কয়েকদিন ধরেই বৃষ্টি এবং দুর্যোগপূর্ণ আবাহাওয়া রয়েছে। বৃষ্টির কারণে উদ্ধারকারীদলকে সমস্যার সম্মুখীনও হতে হয়।
ভারতীয় রেলওয়ে বোর্ডের সিইও এবং চেয়ারপার্সন জয়া ভার্মা সিনহা জানিয়েছেন, মৃতদের মধ্যে ট্রেনের যাত্রী, মালবাহী ট্রেনের চালক, সহকারী চালক এবং যাত্রীবাহী ট্রেনের গার্ডও রয়েছেন। আহতদের উদ্ধার করার পর উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ঘটনাস্থল থেকে দার্জিলিং পুলিশের অ্যাডিশনার এসপি (কার্শিয়াং) অভিষেক রায় বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে মালগাড়ি ধাক্কা মারে। যার ফলে তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয় । উদ্ধারকার্য চালানো হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্ধারকার্যে অনেক সাহায্য করেছেন।
“গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে মালগাড়ির ইঞ্জিন বার করতে হচ্ছে। সামনে একটি জায়গায় অস্থায়ী ভাবে আহতদের নিয়ে গিয়ে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে”, জানান তিনি।
প্রতক্ষ্যদর্শীরা অভিযোগ জানিয়েছেন, যাত্রীবাহী ট্রেন যে লাইনে ছিল সেই একই লাইনে চলে আসে ওই মালবাহী গাড়ি, ধাক্কা মারে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছন দিকে। কীভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে নির্ধারিত সময়েই রওনা হওয়ার পর নীচবাড়ি এবং রাঙাপানি স্টেশনের মাঝে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস।
মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষের তীব্রতা এতটাই ছিল যে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছন দিক থেকে পর পর তিনটি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে পাশে ছিটকে পড়ে।
ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান বেশ কয়েকজন, আহত হন ট্রেনের যাত্রীদের অনেকে।
পরিবারের অন্য তিন সদস্যের সঙ্গে কলকাতায় ফিরছিলেন অন্তরা দাস। তিনি বলেন, আচমকা ধাক্কায় আমরা নীচে পড়ে যাই। আমার সঙ্গে ছোট সন্তান রয়েছে। খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সবাই চিৎকার করে বলছিল দুর্ঘটনা হয়েছে। ভেবেছিলাম মরেই যাব আজ, বেঁচে ফিরতে পারব না।
বার্তা সংস্থা এএনআই-কে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, যে সময় দুর্ঘটনাটি ঘটে সে সময় ধীর গতিতে চলছিল যাত্রীবাহী ট্রেনটি। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “ট্রেনটা ধীরে ধীরে চলছিল । কীভাবে ওই লাইনে মালবাহী গাড়ি চলে এল বুঝতে পারছি না।”
“খুবই ভয়াবহ পরিস্থিতি এখানে । আমরা স্থানীয়রাই আহতদের উদ্ধারের কাজে হাত লাগাই।”
যাত্রীবাহী ট্রেনের পিছনে পার্সেল ভ্যান না থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারত বলে আশঙ্কা জানিয়েছেন যাত্রীদের অনেকে। তাদেরই মধ্যে একজন বার্তা সংস্থা এএনআইকে বলেন, “কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে পার্সেল ভ্যান না থাকে কী হতে পারত ভাবতে পারছি না!”
আহতদের উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। গুরুতর আহতরা হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও প্রাথমিক চিকিৎসার পর অনেককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ কর্মকর্তা কৌশিক মিত্র বলেন, উদ্ধারকাজ দ্রুততার সঙ্গে চালানো হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে যাত্রীদের যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব শিয়ালদহ ফিরিয়ে আনা যায়।
দুর্ঘটনার ফলে ওই লাইন বন্ধ থাকায় বেশ কয়েকটি ট্রেন পথে আটকে আছে। বেশ কিছু ট্রেনকে অন্য পথে চালনা করা হচ্ছে, রেল দফতরের তরফে জানানো হয়েছে।
সোমবার দুপুরে সাংবাদিক বৈঠকে ভারতীয় রেলওয়ে বোর্ডের সিইও এবং চেয়ারপার্সন জয়া ভার্মা সিনহা বলেন, আজ সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে যে দুর্ঘটনা ঘটে তাতে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গুরুতর আহতদের চিকিৎসা চলছে।
“এই ঘটনায় নিহতদের মধ্যে মালবাহী ট্রেনের চালক, সহকারী চালক এবং যাত্রীবাহী ট্রেনের গার্ডেরও মৃত্যু হয়েছে। “
এই দুর্ঘটনার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটল তা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। দুর্ঘনার কবলে পড়া মানুষদের উদ্ধারের কাজকে প্রাথমিক ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, নিশ্চিত করা হয়েছে যাতে আহত এবং অন্যান্য যাত্রীদের সমস্ত রকম পরিষেবা দেওয়া যায়। কেন্দ্র থেকে পুরো বিষয়টির উপর নজর রাখা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
সোমবারের দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এক্স হ্যান্ডেল (সাবেক টুইট্যার)-এ একটি বার্তায় তিনি লেখেন, “পশ্চিমবঙ্গে রেল দুর্ঘটনা দুঃখজনক। যারা তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন তাদের প্রতি সমবেদনা জানাই। প্রার্থনা করি আহতরা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক।”
“সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি সম্পর্কে খতিয়ে জেনেছি। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় উদ্ধার তৎপরতা চলছে। রেলমন্ত্রী শ্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবজি-ও দুর্ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন।”
প্রধানমন্ত্রীর তরফে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়েছে। মৃতদের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা এবং আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে ।
এই ঘটনায় আক্রান্তদের সমস্ত রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীও।
এক্স হ্যান্ডেলে একটি বার্তা পোস্ট করে তিনি লেখেন, ‘দার্জিলিং জেলার ফাঁসিডোবা এলাকায় মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনার খবর শুনে স্তম্ভিত। জানা গিয়েছে, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস একটি মালগাড়ির ধাক্কায় বিধ্বস্ত হয়েছে ।’
‘ডিএম, এসপি, চিকিৎসক, অ্যাম্বুলেন্স এবং দুর্যোগ দলকে উদ্ধার, পুনরুদ্ধার এবং চিকিৎসা সহায়তার জন্য ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় অভিযান শুরু হয়েছে।’
এদিকে, এই ঘটনাকে ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজাও। সোমবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী মোদীর শাসনকালে বারেবারে যাত্রী নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে পড়ায়, তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী। বিবিসি
এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করার পাশাপাশি তিনি লেখেন, ‘গত ১০ বছরে রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি মোদী সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং অবহেলার প্রত্যক্ষ ফল, যার ফলে প্রতিদিন যাত্রীদের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে।’ #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.