করোনা ভাইরাসের জন্য পৃথক ওয়ার্ড রাখার নির্দেশনা পরীক্ষার সুযোগ নেই খুলনার হাসপাতাল গুলোতে

এইচ এম আলাউদ্দিন: (খুলনা থেকে): স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট(আইইডিসিআর) থেকে পত্র দিয়ে দেশের সকল মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতালগুলোতে ২০১৯-এন করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে।

মেডিকেল কলেজ, জেলা ও উপজেলা হাসপাতালগুলোতে কমপক্ষে পাঁচটি বেড সম্বলিত ‘আইসোলেশন ইউনিট’ নির্দিষ্টকরণের জন্যও ওই পত্রে তাগিদ দেয়া হয়।

কিন্তু দেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় খুলনায়ও নেই সম্পূর্ণ নতুন এ ভাইরাসজনিত রোগটির পরীক্ষার কোন ব্যবস্থা। কিছু লক্ষ্যণ দেখামাত্রই ওই রোগীর জন্য যে পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোর প্রয়োজন সেজন্যও খুলনার কোন হাসপাতালে ব্যবস্থা নেই।

শুধুমাত্র মংলা বন্দরে গতকাল থেকে বসানো হয়েছে একটি ইলেক্ট্রিক্যাল বিলবোর্ড। যার মাধ্যমে জনসাধারণ জানতে পারবে করোনা ভাইরাসের লক্ষণ, এ থেকে প্রতিকারের উপায় প্রভৃতি। যেখানে পরীক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই সেখানে শুধু সতর্ক বার্তা কতটা সুফল বয়ে আনবে সেটি নিয়েও শংকিত অনেকে।

অর্থাৎ কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত অনেকটা সমন্বয়হীনতার মধ্যেই এগিয়ে নিতে হচ্ছে এ কার্যক্রমকে। তার পরেও দ্রুত এ ভাইরাসের প্রতিশেধক আসবে এমনটিই আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট(আইইডিসিআর) থেকে গত ২৬ জানুয়ারীর এক পত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা: মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা স্বাক্ষরিত পত্রে বলা হয়, ডিসেম্বর মাস থেকে চীনে একটি নতুন করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে এবং বর্তমানে উক্ত ভাইরাসের সংক্রমণ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। উক্ত সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিটি হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা আবশ্যক। যার অংশ হিসেবে করোনা ভাইরাস সংক্রমিত রোগীর জন্য প্রতিটি হাসপাতালে সার্বক্ষনিক অক্সিজেন এবং অন্যান্য সুবিধাসহ পাঁচটি বিছানা সম্বলিত ‘আইসোলেশন ইউনিট’ নির্দিষ্টকরণের জন্য অনুরোধ করা হলো।

ওই পত্রের আলোকে খুলনার পরিচালক(স্বাস্থ) দপ্তর থেকে গত সোমবার খুলনা বিভাগের প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল এবং সিভিল সার্জনদের কাছে পত্র দেয়া হয়। ওই পত্রে প্রতিটি হাসপাতালে করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত কিছু দিক নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়, করোনা ভাইরাসের জন্য হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবার সাথে জড়িত চিকিৎসক এবং নার্সদের বিভিন্নভাবে সতর্ক থাকতে হবে।

এই রোগের লক্ষণ এবং চিকিৎসা বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও আইইডিসিআর এর ওয়েবসাইট (www.iedcr.gov.bd) থেকে জানতে হবে।

কোথাও কোন সন্দেহভাজন রোগী পাওয়া গেলে তৎক্ষণাত তাকে আইসোলেশন বেডে রাখতে হবে এবং আইইডিসিআর এর হট লাইন নম্বরে (০১৯৩৭-০০০০১১, ০১৯২৭-৭১১৭৮৪ ও ০১৭৬৯-৯৫৭০১৩) যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাসহ পাঁচটি বেডসহ একটি আইসোলেশন ইউনিট গঠন করতে হবে। এছাড়া যশোর, সাতক্ষীরা ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় অবস্থিত ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারে মেডিকেল টিম রাখতে হবে এবং সন্দেহভাজন যাত্রীদের পরীক্ষা নীরিক্ষা   করতে হবে।

ওই নির্দেশনার আলোকে খুলনাঞ্চলের সর্ববৃহৎ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল মঙ্গলবার থেকেই পাঁচ শয্যার একটি ওয়ার্ড প্রস্তুত করা হয়েছে বলে হাসপাতালের পরিচালক ডা: এটিএমএম মোর্শেদ জানিয়েছেন। ওয়ার্ডটির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা: এসএম কামালের ওপর।

দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়ার্ড প্রধান অধ্যাপক ডা: এসএম কামাল বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, গতকাল থেকেই হাসপাতালের গ্যাষ্ট্রোলজি বিভাগের পাশের একটি ওয়ার্ডে পাঁচটি বেড প্রস্তুত করা হয়েছে। যেখানে আগে ডেঙ্গু ওয়ার্ড ছিল। ওই ওয়ার্ডটির জন্য একজন সহকারী রেজিষ্ট্রার এবং একজন নার্সকে দায়িত্ব দিয়ে আরও কিছু জনবল পদায়ন করা হবে।

তবে লক্ষণ দেখে রোগী ভর্তি করা হলেও এখানে কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন। যে সন্দেহ হলেও সংশ্লিষ্ট রোগীকে ঢাকায় রেফার্ড করার প্রয়োজন হতে পারে।

খুলনার সিভিল সার্জন জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: সুজাত আহমেদ বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, ওই হাসপাতালেও গতকাল থেকে পাঁচটি বেড সম্বলিত একটি ওয়ার্ড পৃথক করা হয়েছে। সেখানে ডিউটিকালীন চিকিৎসক-নার্সদের মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অন্যান্য উপজেলা হাসপাতালগুলোকেও এমন নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে যাতে প্রতিটি হাসপাতালেই পাঁচটি বেড আলাদা করে করোনা ভাইরাসের ওয়ার্ড করা হয়।

পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা খুলনায় নেই উল্লেখ করে সিভিল সার্জন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, এমন কোন রোগীর সন্ধান পেলেই তাকে ঢাকার মহাখালীর আইইডিসিআর অথবা কুর্মিটোলা হাসপাতালে পাঠানো হবে।

খুলনাস্থ মংলা পোর্ট হেলথ্ অফিসার ডা: সুফিয়া খাতুন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, মংলা পোর্ট কেন্দ্রিক সতর্কতা বাড়ানো হয়েছে। যেসব জাহাজ বিদেশ থেকে আসবে সেগুলোতে আসা ক্রুদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটি ইলেক্ট্রিক্যাল বিলবোর্ড দেয়া হয়েছে। যেটি মংলা বন্দর গেটে গতকাল স্থাপনা করা হয়েছে।

করোনা ভাইরাস সম্পর্কে গতকাল রূপসা উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: এসএম তারেক উর রহমান বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে স্বাস্থ্য বার্তা এবং সতর্কতা অবলম্বনের জন্য বলা হয়েছে। সে নির্দেশনার আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কোন রোগীর এমনটি সন্দেহ হলে তাকে পৃথক বেডে রাখা হবে। তবে এখনও পর্যন্ত যেহেতু এটি বিমান বন্দর এবং সীমান্ত এলাকা কেন্দ্রিক রয়েছে সেহেতু তৃণমূল পর্যায়ে খুব একটা আতংকিত হওয়ার নেই।

তেরখাদা উপজেলা স্বাস্থ্য ও প:প: কর্মকর্তা(ভারপ্রাপ্ত) ডা: রাফিদ শাহরিয়ার বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত কিছু লিফলেট দেয়া হয়েছে। যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে লাগানো হবে। এছাড়া এ সংক্রান্ত সতর্ক বার্তা দিয়ে ব্যানারও বানানো হবে বলে তিনি জানান।

ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও প:প: কর্মকর্তা ডা: শেখ মোহাম্মদ কামাল হোসেন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, গতকালই তিনি সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে পাঁচটি বেড সম্বলিত পৃথক ওয়ার্ড করার নির্দেশনা পেয়েছেন। আজ বুধবার তিনি এ কার্যক্রম হাতে নেবেন। এমনকি করোণা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সন্দেহ করার সাথে সাথেই সেটি সিভিল সার্জন দপ্তরকে অবহিত করতে বলা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও প:প: কর্মকর্তা ডা: নীতিশ চন্দ্র গোলদার বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, তিনিও গতকাল সিভিল সার্জনের কাছ থেকে এ সম্পর্কিত নির্দেশনা পেয়েছেন। যার আলোকে ব্যানার-লিফলেট বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া পাঁচটি বেড সম্বলিত পৃথক কর্ণার করা হয়েছে।

এদিকে, করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআর সংশ্লিষ্টদের কাছে বিভিন্ন বার্তা দিয়েছে। যার আলোকে এ সংক্রান্ত বেশকিছু তথ্য মিলেছে।

করোনা ভাইরাস: করোনা ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি। এটি এক ধরনের করোনা ভাইরাস। ভাইরাসটির অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৭টি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি হয়তো মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতোমধ্যে ‘মিউটেট করছে’, অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করছে। ফলে এটি আরও বেশি বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ভাইরাস একজন মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মানুষের দেহে ছড়াতে পারে।

লক্ষ্মণ: করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রধান লক্ষণ হলো, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, জ্বর এবং কাশি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় পাঁচ দিন লাগে। প্রথম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। তারপর দেখা দেয় শুকনো কাশি। এক সপ্তাহের মধ্যে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় এবং তখনই কোনও কোনও রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।

যেভাবে ছড়ায়: মধ্য চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা। ৩১ ডিসেম্বর এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এরপর ১১ জানুয়ারী প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। তবে ঠিক কিভাবে এর সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, তা এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সম্ভবত কোনও প্রাণী এর উৎস ছিল। প্রাণী থেকেই প্রথমে ভাইরাসটি কোনও মানুষের দেহে ঢুকেছে এবং তারপর মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে। এর আগে সার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রথমে বাদুড় এবং পরে গন্ধগোকুল থেকে মানুষের দেহে ঢোকার নজির রয়েছে। আর মার্স ভাইরাস ছড়িয়েছিল উট থেকে।

করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে উহান শহরে সামুদ্রিক একটি খাবারের কথা বলা হচ্ছে। শহরটির একটি বাজারে গিয়েছিল এমন ব্যক্তিদের মধ্যে এই রোগের সংক্রমণ ঘটেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই বাজারটিতে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা হতো
চিকিৎসা: ভাইরাসটি নতুন হওয়াতে এখনই এর কোনও টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। এমনকি এমন কোনও চিকিৎসাও নেই, যা এ রোগ ঠেকাতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে মানুষকে নিয়মিত হাত ভালোভাবে ধোয়া নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে। হাঁচি-কাশির সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখা এবং ঠান্ডা ও ফ্লু আক্রান্ত মানুষ থেকে দূরে থাকারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
আপাতত প্রতিকার হিসেবে এ ভাইরাস বহনকারীদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে বলছেন বিজ্ঞানীরা। ডাক্তারদের পরামর্শ, বারবার হাত ধোয়া, হাত দিয়ে নাক-মুখ স্পর্শ না করা ও ঘরের বাইরে গেলে মুখোশ পরার কথাও বলা হচ্ছে।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর খুলনা ব্যুরো প্রধান এইচ এম আলাউদ্দিন এবং মাশরুর মুর্শেদ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.