করোনার টিকা নিয়ে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রমরমা বাণিজ্য

ক্রাইম (পাবনা) রিপোর্টার: করোনার টিকা দেওয়া নিয়ে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কিছু দালাল চক্র তৃতীয় শ্রেনীর কর্মকর্তার সহায়তায় রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।

গত বুধবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাত্র, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচির পরিচালক মো. শামসুল হক করোনার টিকা বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। ২৬ ফেব্রুয়ারির পর করোনার টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
শামসুল হক বিটিসি নিউজকে বলেন, ২৬ ফেব্রুয়ারির পূর্ব পর্যন্ত প্রথম ডোজের টিকা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। যাদের জন্মনিবন্ধন ও পাসপোর্ট নেই, তাঁরা ২৬ ফেব্রুয়ারির আগে সরাসরি হাসপাতাল ও টিকাকেন্দ্রে গিয়ে টিকা নিতে পারবেন।
২৬ ফেব্রুয়ারি একদিনে এক কোটি ব্যক্তিকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান শামসুল হক। তিনি বলেন, প্রতিটি ইউনিয়নে ৩টি টিকা কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। পৌরসভার প্রতিটি ওয়ার্ডে ৩টি করে দল থাকবে।
সেদিন নির্ধারিত কেন্দ্রের বাহিরেও টিকা প্রদানের জন্য প্রতি উপজেলায় ৫টি, প্রতি জেলায় ২০টি করে ভ্রাম্যমাণ দল থাকবে।এই ঘোষনার পর থেকে যারা এখনও প্রথম ডোজ টিকা গ্রহন করেননি তারা টিকা নেওয়ার জন্য টিকা কেন্দ্রগুলোতে ব্যপক ভিড় করছেন। দ্বিতীয় ও বুস্টার ডোজ নেওয়ার ব্যক্তিরাও আসছেন টিকা নিতে। ফলে টিকা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বাস্থ্য কর্মীরা। দীর্ঘ লাইন দেখা যাচ্ছে টিকা কেন্দ্রগুলোতে।
আবার অনেককে দীর্ঘ সময় লাইনে দাড়িয়ে থেকে ফিরেও যেতে হচ্ছে প্রতিদিনের টিকা প্রদানের সময়সীমা শেষ হওয়ার কারনে। এ বিড়ম্বনা এড়াতে অনেক সাধারন মানুষ বিবেক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে অসাধু উপায় বেছে নিচ্ছেন। ধরছেন দালাল দ্রুত টিকা পাওয়ার জন্য। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েই দালাল ও ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তৃতীয় শ্রেনীর কর্মকর্তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন সাধারন মানুষের পকেটের টাকা। ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্যকর্মী ও টিকা কার্যক্রম গতিশীল করার লক্ষ্যে নিয়োগ প্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী সহ মাত্র ৩৪ জন নারী পুরুষ টিকা প্রদান সেবা দিচ্ছেন। টিকা গ্রহিতাদের তথ্য ডাটাবেজে আপডেট করার জন্য লোকসংখ্যা মাত্র ২ জন।
ঈশ্বরদী উপজেলার প্রায় ৫ লাখ এবং প্রায় ৬০ হাজার বহিরাগত জনসাধারনকে টিকার সেবা প্রদানের জন্য যা অপ্রতুল। ফলে অনেকেরই টিকা গ্রহনের তথ্য ডাটাবেজে আপডেট হচ্ছে না সময়মত। এজন্যও অনেকে টাকা প্রদান করছেন দালাল চক্রের হাতে। দ্রুত টিকা ও ডাটাবেজে তথ্য আপডেট পাওয়ার জন্য সাধারন মানুষ তাদের ধৈর্য্য ও মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে অসাধু পথ বেছে নিচ্ছেন।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টিকা নেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। আর কিছু মানুষ ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রশাসনিক অফিস, স্টোররুম সহ বিভিন্ন রুমের সামনে জটলা করে আছে, আর দু—একজনকে এসকল রুমের মধ্যে টিকা প্রদান করা হচ্ছে। রুমের বাহিরে জটলাকারীদের জিজ্ঞাসা করলে তারা টিকা নেওয়ার জন্য এখানে এসেছেন বলে জানান।
লাইন ছাড়া এখানে কেন এবং কিভাবে টিকা নিচ্ছেন এমন প্রশ্ন করলে বেড়িয়ে আসে টাকার বিনিময়ে টিকা গ্রহনের তথ্য। নাম প্রকাশে এমন অনিচ্ছুক এমন দু—একজন টিকা গ্রহিতাকে কিভাবে এখান থেকে টিকা নিচ্ছেন প্রশ্ন করলে তারা টিকা নেওয়ার জন্য টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন।
এমনই একজন ব্যক্তি তার মেয়েকে নিয়ে এসেছেন টিকা দেওয়ার জন্য, তিনি বলেন আমি ৩০০ টাকা দিয়েছি টিকা নেওয়ার জন্য এবং আপনারটার ব্যবস্থাও করে দিচ্ছি আগে আমারটা হয়ে যাক। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তিনি নাম বলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। অপর এক ব্যক্তিকে দেখা যায় তিনি এক মহিলার থেকে টাকা দিচ্ছেন আর ঐ মহিলা বলছে আরও ৫০ টাকা দাও। পরে টাকা প্রদানকারীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে, পাশের থেকে একজন বলেন ইনি সাংবাদিক তখন ঐ ব্যক্তি দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। প্রস্থানের সময় তিনি বলেন টাকা দিয়েছি আমার উপকার হয়েছে, আপনাদের বললে তো তাও পাব না।
পরে তিনি খোঁজ নিয়ে জানা যায় তার নাম রিনা, সে হাসপাতালের আয়া হিসেবে কর্মরত। অপরদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনার্স তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে আপনি হাসপাতালে কি সেবা নিতে এসেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি দুই ডোজ টিকা নিয়েছি কিন্তু এখনো তার আপডেট পাই নাই, আজ দিয়ে দুই দিন ধরে তার খোঁজ নিতে আসছি।
হাসপাতালের পরিসংখ্যান অফিসে গেলে সেখানের একজন ব্যক্তি আমাকে অফিস রুম থেকে বের করে দেন এবং ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানি যে, পরিসংখ্যান কর্মকর্তা নাই, তিনি ঈশ্বরদী ইপিজেড এ গেছেন টিকা দিতে। পরে হাসপাতালের ভিতরে এক ব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমার কি সমস্যা, আমি সমস্যার কথা বললে তিনি আমাকে বলেন ৩০০ টাকা আর আপনার তথ্য দিয়ে যান, আমার মোবাইল নম্বর ০১৭২১৯৫৬৭২১ নিয়ে যান, ২৪ ঘন্টার মধ্যে আপডেট হয়ে যাবে। পরে আমি ঐ নম্বরে কল দিলে ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে বলি, তিনি বলেন ফোনে চার্য নাই সেকারনে বন্ধ। সমস্যা নাই পরে খুলবো। সে নিজেকে বাদশা বলে পরিচয় দেন এবং আমাকে সবসময় ভ্যাকসিন রুমেই পাবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আসমা খান কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বিটিসি নিউজকে জানান, টিকা দেওয়ার জন্য টাকা কারা নিচ্ছেন এটা আমাকে ধরিয়ে দিতে হবে, ধরিয়ে না দিলে আমি কিছু করতে পারব না।
হাসপাতালের মধ্যে কারা টাকা নিচ্ছেন এটা পর্যবেক্ষনের দ্বায়িত্ব কি আপনার নয় এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমার স্টাফগণ টাকা নিচ্ছে কিনা এটা দেখার দ্বায়িত্ব আমার। আমার জানা মতে হাসপাতালের স্টাফগণ কোন টাকা নেন না। তখন বাদশা ও রিনা নামক ব্যক্তিদের টাকা নেওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান এরা হাসপাতালের কেউ নন অতএব ওদের টাকা নেওয়ার দায়ভার আমার নয়।
এখন প্রশ্ন হলো, এসব ব্যক্তিরা যদি হাসপাতালেও কেউ না হন তাহলে হাসপাতালে ভিতরে কিভাবে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন এবং কেন তাদের হাসপাতালের বিভিন্ন কক্ষে অবাধ বিচরণ এবং কেন হাসপাতালের টিকা প্রদান করা হচ্ছে? এগুলো দেখার দায়িত্ব কার?
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর ক্রাইম (পাবনা) রিপোর্টার মো: ময়নুল ইসলাম লাহিড়ী মিন্টু। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.