করোনাকালে সরকারী চাকরিজীবিদের বেতন চালু রাখার ফল

নূর আহমদ (শিক্ষক): স্মরণাতীতকালের ইতিহাসে বিশ্ব ব্যবস্থার স্বাভাবিকত্বে বড় ধরনের আঘাত হানা করোনাভাইরাসের উপদ্রব শুরু হয় চীনে।

বহুল প্রচারিত তথ্য অনুযায়ী চীনে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯। ধীরে ধীরে চীনের সীমানা ছাড়িয়ে পৃথিবীব্যাপী রোগটি তার ভয়াল থাবা বিস্তার করতে থাকে।

একসময় রোগের গতিপ্রকৃতি এবং ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহতা দেখে রোগটিকে বিশ^-মহামারী ঘোষণা করা হয়। রোগটি প্রতিরোধের জন্য বিবেচিত অনেক উপায়ের মধ্যে একটি হলো লকডাউন।

‘লকডাউন’ বিষয়টির সাথে অনেকেই পরিচিত হয়েছে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর। অনেক অনেক দেশে থাবা বিস্তারের পর বাংলাদেশেও হানা দেয় করোনাভাইরাস।

প্রথম রোগী শনাক্ত হয় মার্চে। মার্চের ১৭ তারিখ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয় আর ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষনা করা হয়। সরাসরি লকডাউন ঘোষণা না করে সাধারণ ছুটির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

পরিস্থিতি বিবেচনায় সেই সাধারণ ছুটি বৃদ্ধি পেতে পেতে এখনো চলছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব রকমের অফিস আদালত বন্ধ হয়ে যায়। এই সাধারণ ছুটিকে লকডাউনের বিকল্প ভাবা পুরোপুরি ভুল হবে না।

সরাসরি লকডাউন ঘোষনা না করা হলেও নানা মাধ্যমে সতর্ক করা হয়/হচ্ছে সবাই যেন ঘরে থাকে, বের না হয়। বাইরে বের না হবার জন্য মৌখিক বা লিখিত সতর্কতার পরও বাড়তি সতর্কতা হিসেবে প্রশাসনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়। এটাই একটা অলিখিত লকডাউন।

দেশের সর্বস্তরের নাগরিক চার মাসের বেশি সময় ধরে চলমান সাধারণ ছুটির অনেক পাশর্^প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে থাকে। শ্রমজীবি, বিশেষ করে দিনমজুর মানুষগুলো উপার্জনের উপায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রচন্ড অর্থাভাবে ভুগতে শুরু করে। অল্প আয়ের কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।

বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে কর্মচারী ছাঁটাই শুরু করতে থাকে। শহরে ভাড়া বাসায় বসবাসকারী অনেক মানুষ উপার্জন কমে যাওয়ায় বা বেকার হয়ে যাওয়ায় সপরিবারে গ্রামে চলে যায়। বাড়ির মালিকদের আয়ও কমে যায়।

প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও অনেক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে দিতে শুরু করে। আমার দু’জন বন্ধু একটি প্রতিষ্ঠিত বীমা কোম্পানীতে চাকরি করে। তাদের সাথে আলাপের পর জানতে পারলাম, গত কয়েক মাস ধরে তাদেরকে বেতন কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। কখন থেকে আবার তাদেরকে পুরো বেতন দেয়া হবে, তা নিয়ে তারা বেশ চিন্তিত।

আরেক আত্মীয়ের ছেলের চাকরি চলে গেছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে। তিনিও তাঁর ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ শঙ্কিত। পোশাক শিল্পে কর্মচারী ছাঁটাইয়ের ঘটনা সবচেয়ে ভয়াবহ।

অল্প আয়ের মানুষগুলো বেশ দুরবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। সরকারি এবং বেসরকারি খাত থেকে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তা দিয়ে তো এসব প্রান্তিক মানুষের সবরকম চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। এভাবে ধীরে ধীরে দেশে সৃষ্টি হতে শুরু করে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা।

সবকিছুর মাঝে একটা শ্রেণি বড় ধরনের কোনো অর্থনৈতিক সংকট বা অর্থদৈন্যে পড়েনি। এরা হচ্ছে সরকারি চাকরিজীবি। অফিস বন্ধ থাকার পরও যথানিয়মে সরকার এদেরকে বেতন দিতে থাকে।

একসময় অনেকের মনে হতে থাকে, আর সব পেশার মানুষ অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়লেও এই শ্রেণি এই ক্ষেত্রে বেশ সুখে আছে। সরকারি চাকরিজীবিদের নিয়ে তাই অনেকে মুখ খুলতে শুরু করে, বিভিন্ন মন্তব্য করতে শুরু করে।

আমার পরিচিত যারা সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত, তাদের মধ্যে দু’জনকে দেখলাম এই নিয়ে তাদের পরিচিত অনেক মানুষ তাদেরকে বিব্রত বা নাজেহাল করার বিষয়টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ ও দুঃখের সাথে প্রকাশ করেছে।
মিডিয়ায়ও বিষয়টা নিয়ে মাঝে মাঝে আলোচনা হয়।

একটি দৈনিক পত্রিকায় ১৯ জুন একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ‘সরকারি চাকুরে ছাড়া কেউ ভালো নেই’ শিরোনামে। আরো কিছু দৈনিকে এই বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।

সরকারি চাকরিজীবিদের বেতন চালু রাখার বিষয়টা যারা নেতিবাচকভাবে দেখছে, কিছু বিষয় লক্ষ্য না করার কারণেই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এমন হয়েছে।

অনেক বেসরকারি বা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের বেতন বন্ধ বা হ্রাস করেছে কেন? তাদের রিজার্ভ কম বা আয় বন্ধ হয়ে গেছে বলেই। আবার অনেক প্রতিষ্ঠিত প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত রিজার্ভ থাকা সত্ত্বেও এবং আয়ের অনেক পথ চালু থাকা সত্ত্বেও কর্মচারীদের বেতন হ্রাস করেছে অন্যায্যভাবে।

সাধারণ ছুটিতে সরকারের আয় পুরোপুরি কিন্তু বন্ধ হয়নি। রেমিট্যান্স, ভ্যাট, টোলসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের আয় হ্রাস পেলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, অনেক ক্ষেত্রে সরকারের আয় চলমানও আছে।

তাছাড়া সরকারের রিজার্ভ পর্যাপ্ত আছে বলেই সরকার সরকারি চাকরিজীবিদের বেতন চালু রাখতে পেরেছে। সবচেয়ে বড় কথা, সরকারি চাকরিজীবিরা তো সরকারকে না জানিয়ে অফিসে যাওয়া বন্ধ করেনি। বরং সরকার নিজেই ওদেরকে ছুটি দিয়েছে, তাই সরকারের দায়িত্ব ওদেরকে বেতন দেয়া। ওরা যদি নিজেদের প্রয়োজনে ছুটি নিতো, তাহলে সরকার ওদেরকে বেতন দিলে বিষয়টা প্রশ্নবিদ্ধ হতো।

রমজান ও ঈদের সময় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় দেড় মাস বন্ধ থাকে। সরকার কি তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত সরকারি চাকরিজীবিদের বেতন বন্ধ করে রাখা ঠিক হবে? প্রতিরক্ষা বিভাগে যারা চাকরি করে, তারা বছরে একসাথে দু’মাস ছুটি পায়। সরকার কি তখন ওদেরকে বেতন দেয়া ভুল?

যদি সরকারি চাকরিজীবিদেরকে সরকার ছুটিতে পাঠানোর পরও সরকার ওদের বেতন বন্ধ রাখতো, তাহলে সরকারের রিজার্ভে যে টাকা জমা থাকতো, তা তখন কী কাজে লাগতো? গত বাজেটে সরকারি চাকরিজীবিদের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, সরকার তা কোন কাজে খরচ করতো? লকডাউন একদিন তো শেষ হবে। তখন সরকারের আয়ের বন্ধ পথগুলোও চালু হবে, হ্রাস পাওয়া আয়ের পথগুলোও গতি ফিরে পাবে।

কিন্তু সাধারণ ছুটির সময় সরকার সরকারি চাকরিজীবিদের বেতন বন্ধ করে রাখলে ক্ষতি কার হতো বা বেতন চালু রাখাতে লাভ কার হয়েছে, তা নিয়ে আমরা কখনো গভীরভাবে ভাবি না বলেই সরকারি চাকরিজীবিদের বেতন চালু রাখাকে আমরা অনেকে নেতিবাচকভাবে দেখছি।

সরকার সরকারি চাকরিজীবিদের বেতন তখনও চালু রেখেছে, যখন বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স অনেকাংশে বন্ধ হয়ে গেছে; সাধারণ মানুষের ব্যাংক ব্যালেন্স বা জমানো টাকা কমে গেছে; যখন অনেক পরিবারের অনেক সদস্যের আয়ের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে; যখন ড্রাইভার, নাপিত, জেলে, দিনমজুরসহ সাধারণ শ্রমজীবিদের নিয়মিত উপার্জন বন্ধ হয়ে যাবার কারণে তাদের সামান্য রিজার্ভটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেছে।

এই ভয়াবহ সময়ে এই শ্রেণির বেতন চালু রাখার ফলে লাভ হয়েছে কার? শুধু যাদেরকে বেতন দিয়েছে, তাদের লাভ হয়নি। তারা বেতন পেয়ে কিন্তু তা ব্যাংকে, পকেটে বা বালিশের নিচে রেখে দেয়নি।

খরচ করতে হয়েছে, করেছে। সেই খরচ কখনো মুদি দোকানীর হাতে গেছে, কখনো রিকশাঅলার হাতে গেছে, কখনো কখনো দিনমজুরের হাতেও গেছে, কখনো গেছে ঔষধ বিক্রেতার পকেটে। আবার যাদের পকেটে এই শ্রেণির মানুষের টাকা গেছে, তাদের পকেট থেকে পকেট বদল হয়ে সেই টাকা আবার চলে গেছে অন্য অনেক পেশাজীবির পকেটে।

গিয়েছে মাছ বিক্রেতার কাছে, গিয়েছে সবজি বিক্রেতার কাছে। এভাবে যারা এই শ্রেণির মানুষের বেতন চালু রাখার বিরোধীতা করছে, তাদের পকেটেও ওই টাকা গেছে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে। এই শ্রেণির কাছে টাকা থাকায় অনেকে এদের কাছ থেকে ধার নিয়েও সাময়িক অর্থনৈতিক সংকট লাঘবের সুযোগ পেয়েছে।

সমাজে, রাষ্ট্রে সীমিত পরিসরে হলেও চলমান রয়েছে অর্থনীতির গতি। অর্থনীতি পুরো ভেঙ্গে পড়েনি, অর্থনীতির প্রবাহ পুরোপুরি থমকে যায়নি এই শ্রেণির হাতে সরকার যথানিয়মে যথাসময়ে বেতন তুলে দেয়ায়। বলতে হবে এই শ্রেণির বেতন চালু রাখার মাধ্যমে সরকার দেশে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, সর্বস্তরের জনগণের কল্যাণের পথই চালু রেখেছে।

সরকার এই শ্রেণির বেতন বন্ধ রাখলে সরকারের পকেট ভারী থাকতো, কিন্তু জনগণের কী লাভ হতো! কিছুই না।
আমাদের উচিত বিষয়টা নিয়ে সরকারি চাকরিজীবিদেরকে এবং সরকারকে বিব্রত না করে বরং এজন্য সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া।

আরেকটা কথা অস্বীকার করলে চলবে না, সাধারণ ছুটি চলাকালীন সরকারি চাকরিজীবিরা একেবারে শুয়ে-বসে বেতন নেয়নি। অধিকাংশ ডিপার্টমেন্টের চাকরিজীবিকে সরকারি অনেক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঘর থেকে বের হতে হয়েছে। প্রশাসনে কর্মরতরা খুব কম ছুটি ভোগ করতে পেরেছে।

সরকারি চিকিৎসকরাও সাধারণ ছুটি ভোগ করতে পারেনি। ব্যাংকে চাকরিজীবিদেরকেও ব্যাংকে যেতে হয়েছে অনিয়মিতভাবে হলেও। প্রতিরক্ষা বিভাগও ছুটি ভোগ করেনি।

শিক্ষা বিভাগে কর্মরতদেরকেও মাঠপর্যায়ে সরকারের বিশেষ কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে। অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, মারাও গেছেন অনেকে।

তাই সরকারি চাকরিজীবিদের বেতন চালু রাখা নিয়ে মন্তব্য করার আগে বিষয়গুলো মাথায় রাখা উচিত।

সংবাদ প্রেরক শিক্ষক : নূর আহমদ।  nurahmad786@gmail.com  দক্ষিণ মাগুরী, দত্তপাড়া, লক্ষ্মীপুর-৩৭০৬। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.