কপ- ২৭: ক্ষতি কাটাতে ধনী দেশ কি এবার দরিদ্র দেশকে অর্থ দেবে?

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মিশরের শারম আল-শেখে সোমবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়া ‘কপ টুয়েন্টি সেভেন’ নামের জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনটির সাথে আগেরগুলোর একটা গুরুত্বপূর্ণ তফাৎ আছে। আর সেটি হলো – এই প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক সহায়তার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে রাজি হয়েছেন এতে আগত প্রতিনিধিরা।
উন্নয়নশীল দেশগুলো বলছে, এটি এক ‘ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।’
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক সহায়তা দেবার প্রশ্নটি অনেক দিন ধরেই একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে ছিল।
উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেকদিন ধরেই বলে আসছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তাদের দায় খুবই সামান্য – কিন্তু তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবার ঝুঁকিতে আছে, এবং সে কারণেই তারা জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণাম মোকাবিলার জন্য আরো বেশি অর্থ চায়।
কিন্তু ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো এতদিন এই দায়দায়িত্ব এবং ক্ষতিপূরণের প্রশ্নটি আলোচনার বাইরে রাখতে চাইছিল – যা এবার পাল্টে গেল।

পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমেই বাড়ছে সম্মেলনের আগে দুদিন ধরে আলোচনার পর এ বিষয়টি আলোচনার এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

কপ টুয়েন্টি সেভেন সম্মেলনের সভাপতি – স্বাগতিক দেশ মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শুকরি এই ঐকমত্যের কথাটি আগত প্রতিনিধিদের কাছে ঘোষণা করেছেন রোববারই।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ২০২২ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে – বিশ্বের তাপমাত্রা এখন প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চাইতে ১.১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়ে গেছে এবং গত আটটি বছর ছিল রেকর্ড রাখা শুরু হবার পর থেকে এপর্যন্ত পৃথিবীর উষ্ণতম বছর।
স্বাগতিক মিশর বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রশ্নে দেশগুলোকে এখন “অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির পর্ব শেষ করে বাস্তবায়নের যুগের সূচনা করতে হবে।”
সে ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলার খরচ মেটানোর বিষয়টি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
“লস এ্যান্ড ড্যামেজ’
বিবিসির সংবাদদাতা নবীন সিং খাড়কা বলছেন, মিশরে এবারকার কপ-টুয়েন্টি-সেভেনের অন্যতম আলোচিত ‘বাজওয়ার্ড’ বা শব্দবন্ধ হতে যাচ্ছে এই “লস অ্যান্ড ড্যামেজ।”
কিন্তু এর মানেটা কী এবং কেনই বা এটি এত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু?
এতদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনায় বড় বিষয় হয়েছিল কীভাবে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমানো যায়, কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করা যায়।
তবে তৃতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে, এই সমস্যার প্রধান কারণই তো শিল্পোন্নত দেশগুলো – কিন্তু এর পরিণামে যে দেশগুলোকে সবচেয়ে প্রত্যক্ষভাবে ভুগতে হবে তারা হচ্ছে দরিদ্রতর উন্নয়নশীল দেশগুলো। তাই শিল্পোন্নত দেশগুলোর কি উচিত নয় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এর মোকাবিলার জন্য অর্থ দিয়ে সাহায্য করা?
যে দেশগুলো সবচেয়ে বেশি মাত্রায় এগুলোর শিকার হচ্ছে তারা অনেক দিন ধরেই বলে আসছে এর মোকাবিলায় তাদের অর্থ দরকার।
এটাকেই বলা হচ্ছে “লস এ্যান্ড ড্যামেজ।’
এর আওতায় যেমন বাড়িঘর, জমি, খামার, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতির মত অর্থনৈতিক ক্ষতি পড়বে, তেমনি পড়বে অন্যান্য ক্ষতিও যেমন মানুষের মৃত্যু, সাংস্কৃতিক এলাকা বা প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের মত বিষযগুলোও।
এই প্রসঙ্গটিই এখন মিশরের সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক এজেণ্ডায় যুক্ত হয়েছে।
কী পরিমাণ অর্থ চাইছে দরিদ্রতর দেশগুলো?
ধনী দেশগুলো ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য দরিদ্রতর দেশগুলোকে বছরে ১০০০০ কোটি ডলার দিতে রাজি হয়েছে।
মূলত দুটি ক্ষেত্রে এ সহায়তা দেয়া হবে। একটি হলো মিটিগেশন বা গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমানো, আরেকটি হচ্ছে এ্যাডাপ্টেশন বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য নেয়া পদক্ষেপ।
তবে ‘লস এ্যান্ড ড্যামেজে’র আওতায় যে অর্থ সহায়তার কথা বরা হচ্ছে তা এর অতিরিক্ত।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১০০জনেরও বেশি গবেষক ও নীতিনির্ধারকের একটি গোষ্টী হচ্ছে “লস এ্যান্ড ড্যামেজ কোলাবোরেশন”।
তারা তাদের এক নতুন রিপোর্টে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বিপদাপন্ন ৫৫টি দেশে ইতোমধ্যেই (২০০০ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত) যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ হচ্ছে ৫০,০০০ কোটি ডলারেরও বেশি। আগামী দশক এ ক্ষতি আরো ৫০,০০০ কোটি ডলার বেড়ে যাবে।
রিপোর্টটির প্রণেতারা বলছেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা এক ভগ্নাংশ পরিমাণ বাড়ার অর্থ হচ্ছে আরো ক্ষতি, আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য – ২০৩০ সাল নাগাদ – জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির পরিমাণ হবে ২৯০০০ কোটি ডলার থেকে ৫৮০০০ কোটি ডলার পর্যন্ত।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ২০২২ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে – বিশ্বের তাপমাত্রা এখন প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চাইতে ১.১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়ে গেছে।
দরিদ্র এবং কম শিল্পোন্নত দেশগুলো বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চরম আবহাওয়ার কারণে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে, তারা ক্ষতি কাটাতে গিয়ে আরো বেশি করে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে।
এ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছিল কেন?
সাত বছর আগে প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার প্রসঙ্গটি প্রথম স্বীকৃতি পেয়েছিল – কিন্তু কীভাবে তা করা যাবে তা নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
জার্মানির অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জোকান ফ্ল্যাজবার্থ বলেন, অনেক বছর ধরেই এই লস এ্যান্ড ড্যামেজ প্রসঙ্গটি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে একটি তিক্ত বিতর্কের বিষয় হয়ে ছিল।
“উন্নত দেশগুলোর মধ্যে একটা উদ্বেগ ছিল যে এটা শেষ পর্যন্ত সর্বাধিক গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনকারীদের জন্য একটা আইনি বাধ্যবাধকতায় পরিণত হতে পারে।”
“এটা ছিল তাদের অনেকের জন্য একটি লাল সীমারেখার মত।”
উন্নত দেশগুলো মনে করে যে এতে সম্মত হওয়ার অর্থ হবে বিভিন্ন দুর্যোগের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়া।
‘বিশ্বাসভঙ্গের শামিল’
কপ টুয়েন্টি সেভেনের আলোচকরা বলছেন – ধনী দেশগুলো এটা স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছে যে তার পরিবেশজনিত ক্ষতির কোন দায় নেবে না এবং বা কোন ক্ষতিপূরণ দেবার বাধ্যবাধকতাও মেনে নেবে না।
উন্নয়নশীল দেশগুলো এর বিরোধিতা করেছে । তবে এখন একটা ঐকমত্য হয়েছে যে দায়দায়িত্ব বা ক্ষতিপূরণের প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা হবে না।
মিশরের সম্মেলনের আগে যে ঐকমত্য হয়েছে তাতে বলা হচ্ছে – লস এ্যান্ড ড্যামেজের প্রশ্নটি কপ টুয়েন্টি সেভেনে আলোচিত হবে, তবে এর লক্ষ্য হবে আগামী বছর আবুধাবিতে অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে একটা অন্তর্বতী সিদ্ধান্তে এবং ২০২৪ সাল নাগাদ একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো।
জাতিসংঘের জলবায়ু সংক্রান্ত বৈঠকগুলোতে আফ্রিকা গ্রুপের প্রধান আলোচক আলফা উমর কালোগা বলছিলেন, তারা অনেক দিন ধরেই এ দাবি জানিয়ে আসছেন এবং “এই ঐকমত্য একটি অগ্রগতির সূচক, কিন্তু আমাদের দেখতে হবে আলোচনায় কি হয়।”
ক্লাইমেট এ্যাকশন নেটওয়ার্ক সংগঠনের হরজিৎ সিং বলছেন, এই ঐকমত্য হচ্ছে আসলে একটি আপোষরফা।
“ধনী দেশগুলো যেভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এ ক্ষেত্রে কোণঠাসা করেছে তা প্রকৃতপক্ষেই বিশ্বাসভঙ্গের শামিল। এমন একটি ভাষা তাদেরকে মেনে নিতে হয়েছে যার ফলে ঐতিহাসিকভাবে বড় দূষণকারীদের দায়দায়িত্ব এবং ক্ষতিপূরণের হাত থেকে নিরাপদ রাখা হয়েছে – কিন্তু বিপন্ন দেশগুলো মানুষের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার করা হয়নি” – বলছেন হরজিৎ সিং ।
কোন কোন ক্ষেত্রে মতপার্থক্য হতে পারে?
প্রথমত – কোন সংস্থার মাধ্যমে এই ‘লস এ্যান্ড ড্যামেজ’ সংক্রান্ত অর্থ দেয়া হবে তা নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছানো কঠিন হবে।
উন্নত দেশগুলো বলছে, জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কাঠামোগত কনভেনশর এবং তার বাইরের প্রতিষ্ঠান এর দায়িত্ব নিতে পারে।
কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো বলছে, বর্তমানে যেসব সংস্থা আছে তা এর উপযুক্ত নয়।
উনচল্লিশটি ছোট দ্বীপরাষ্ট্রের জোট এওসিস-এর একজন আলোচক মিচাই রবার্টসন বলছেন, “পাকিস্তানে বা নাইজেরিয়ায় যখন বন্যা হয়, বা ক্যারিবিয়ানে যখন হারিকেন ঝড় হলো – তখন এসব সংস্থা কোথায় ছিল? এরা এসব কাজ করে না।”
এওসিস এবং আফ্রিকা গ্রুপ জাতিসংঘের সাথে সম্পর্কিত একটি নতুন আর্থিক সংস্থা। কিন্তু এর সপক্ষে সমর্থন জোগাড় করা কঠিন হতে পারে।
উন্নত দেশগুলো এ পর্যন্ত কত দিয়েছে ?
ধনী দেশগুলো ২০০৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় ১০,০০০ কোটি ডলার দিতে রাজি হয়েছিল – যা ২০২০ সালের মধ্যে দেবার কথা।
সেই বছর শেষ নাগাদ ৮৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার দেয়া হয়, তবে ২০২৩ সাল নাগাদ ১০ হাজার কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবার কথা।
গত বছর ‘গ্লাসগো ফিনান্সিয়াল এ্যালায়েন্স ফর নেট জিরো’ নামে একটি উদ্যোগ নেয়া হয়। এই এজেণ্ডায় ১৩০ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ সমাবেশ করার জন্য ৫৫০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অঙ্গীকার করেছে।
গত বছরের গ্লাসগোতে কপ টুয়েন্টি সিক্স সম্মেলনের সময় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোট ‘জি সেভেন্টি-সেভেন প্লাস চায়না’ উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল যেন ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ১.০ ট্রিলিয়ান ডলারের ব্যবস্থা করা হয়।
সে বছর কপ টুয়েন্টি সিক্সের সময় ‘লস এ্যান্ড ড্যামেজে’র জন্য স্কটল্যান্ড ১০ লাখ ডলারের কিছু বেশি অর্থ দেবার অঙ্গীকার করে।
ডেনমার্ক বলেছে – তারা ১কোটি ৩০ লাখ ডলার দেবে।
গত সপ্তাহে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এ জন্য একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে।
এ ছাড়া শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-সেভেন এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জোট ভি-টুয়েন্টি লস এ্যান্ড ড্যামেজের অর্থায়ন করতে আংশিক বীমাভিত্তিক একটি উদ্যোগ নিতে রাজি হয়েছে। তবে এওসিস এর বিরোধিতা করেছে।
দরিদ্র দেশগুলো এ অর্থ কাজে লাগাতে পারবে?
জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত খাতে অর্থ দেবার ব্যাপারে অতীতে নানা ধরনের সমস্যা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অর্থায়ন প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত আমলাতান্ত্রিকতার কারণে এ ধরনের অর্থ ছাড় করতে প্রচুর সময় লেগে যায়।
তা ছাড়া গ্রহীতা দেশগুলোতে সুশাসনের দুর্বলতা এবং দুর্নীতির মত সমস্যাও রয়েছে।
তবে এসব কারণ দেখিয়ে ‘লস এ্যান্ড ড্যামেজ’এর অর্থ সহায়তার প্রশ্নটি বার বার ঠেলে একপাশে সরিয়ে দেয়া হবে – দরিদ্র দেশগুলো এটা মানতে চায় না। (সূত্র: বিবিসি বাংলা)। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.