কত রাত নুন দিয়ে সাদা ভাত খেয়েছি তার হিসেব নেই!!!

 

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: ‘কারো বাড়ি গেলে চা-বিস্কুট দেয়, কেউ কেউ আবার হাসি মুখে শখ করে ছবিও তোলে আমার সাথে। কিন্তু কেউ দুটো ভাত খেতে দেয় না আমাকে। জীবনে কোনদিন ভাবিনাই আমার ভাতের কষ্টটাও পেতে হবে শেষমেশ। গেলো কয়েক বছর যাবত অসুস্থ আমি, ওষুধ কেনার মতো অবস্থাও নাই আমার। এদেশে যখন ছবি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, এদেশের কোনো নারীদের অভিনয়ে নামা দূরের কথা, ঘরের বাইরের বাতাসটাও ঠিকমতো পাইতো কিনা সন্দেহ।

ঠিক তখন থেকে আমি অভিনয়ের মধ্যে নিজেকে বিসর্জন করে দিয়েছিলাম। আর আজ কিনা আমার এই দশা! এই আমি তোদের দেশের শিল্পী? হে সম্মানি ব্যক্তিবর্গ আমার নামটা মুছে ফেল তোরা। এক্কেবারে মুছে ফেল তোরা। একথা বলেই আচলে চোখ মুছতে থাকলেন ৬০ এর দশকের পর্দা কাপানো ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘কাচের দেয়াল’, ‘অরুণ বরুণ কিরণমালাসহ বহু সফল সিনেমার অভিনেত্রী আমিরুন নেসা খানম।

পরে চিত্রজগতে এসে তিনি পরিচিত হয়ে উঠে রাণী সরকার হিসেবে। রাণী সরকার সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ থানার সোনাতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাতক্ষীরার সোনাতলা গ্রামের ইউপি স্কুল থেকে প্রাথমিক পাঠক্রম শেষ করেন। এরপর তিনি খুলনা করোনেশন গার্লস স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন।মরহুম সোলেমান মোল্লা ও আছিয়া খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান রাণী ছোট থেকেই গানের প্রতি আসক্ত ছিলো।

তবে অভিনয়ের খাতায় নাম লিখিয়ে ছিলেন অনেকটা সংসারের হাল ধরতেই, কিন্তু অভিনয় ছিলো এক রকম নেশার মতো। চরিত্রের মধ্যে ডুবে যাওয়াটা কতটা শৈল্পিক, তা এই বয়সেও কন্ঠস্বরে স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। বাংলার এই সৃজনশীল ব্যক্তির আজ দুঃখের শেষ নেই। নুন আনলে পান্তা ফুরায় ঠিক এরকমই অবস্থার মধ্যে পার করছেন তার দিন-রাত।

‘যা তোরা বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস কর। মাসের পর মাস আমি ভাড়া দিতে পারি না। অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকি, ওষুধ কেনার টাকা থাকে না। কি রোগ হয়েছে সেটাও এখনো বের করতে পারিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। চার দশকের মতো কাজ করলেও কোনো সঞ্চয় করতে পারেনি মন্তব্য করে রাণী সরকার জানান, ‘নেশা থেকে কাজ করতে যেতাম। যেদিন শুটিং থাকতো না, সেদিনও গিয়ে এফডিসিতে আড্ডা দিয়ে আসতাম।

আমি কখনো জমানো তো দূরের কথা টাকা-পয়সার কথা তেমন ভাবতামই না। তাছাড়া আমরা সহশিল্পীরা কতো টাকাই আর পেতাম, টাকা তো সব পায় হিরো হিরোইনরা। তারা লাখ টাকা পাইলে আমরা হাজার টাকাও পেতাম না। যখন বয়স ছিলো টাকা যা পেয়েছি পোলাও কোরমা খেতাম, কিন্তু জমানোর মতো টাকা কখনোই পাইনি। আর আজ না খেয়ে থাকি, চিকিৎসার অভাবে ভুগি।

যেন শেষ বয়সটা দুঃখিনীর চরিত্রেই আটকে রয়েছে। এই অভিনয় থেকে বের হতেই পারছি না। ‘শুধু এই না, আরও আছে। নিজের জীবন বাজী নিয়ে আমার ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকতে দিয়েছি, তাদের পাহাড়া দিয়েছি। সবাই যখন ভারতে পালিয়ে যায়, তখন আমি যাইনি। আমার সখী আমার হাত ধরে বলেছিলো রাণী চল, রাণী চল।

আমি বলেছি, না যাব না আমি। আমি এই দেশে মরতে চাই। আমি এই দেশের শিল্পী। সেখানে শেখ সাহেবের দেয়া আমার বাড়িটাও কেড়ে নিলো কারা যেন। স্বাধীনতার পরে শেখ সাহেব মানে মুজিব স্যার আমারে বাবর রোডে ২০/৩ এই বাড়িটা দিয়েছিলো থাকার জন্য। কিন্তু শেখ সাহেব মারা যাওয়ার পরে তিনমাসও যায়নি, কুকুর বেড়ালের মতো আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলো।

আমি তোদের দেশের শিল্পী। এই অবস্থা তোদের দেশের শিল্পীর? না আজ আমার নাম আছে, না আছে সম্পদ। এই ছিলো আমার তকদিরে। এই ছিলো আমার জীবনে। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস। প্রশ্নের আগে এভাবেই একটানা নিজের কথা বলে যান রাণী সরকার। তখন ডায়েরিতে লিখে নিয়ে যাওয়া প্রশ্নগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কোনো কাজ ছিলো না আমার এবং আমার সাথে থাকা ফটোগ্রাফারের।

রাণী সরকার চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন ১৯৫৮ সালের বঙ্গের বর্গী মঞ্চনাটকের মাধ্যমে। এই বছরই তার চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় এ জে কারদার পরিচালিত দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এরপর ১৯৬২ সালে বিখ্যাত চলচিত্রকার এহতেশামুর রহমান পরিচালিত উর্দু চলচ্চিত্র ‘চান্দা’তে অভিনয় করেন।

সেই ছায়াছবির পর থেকে তার পিতৃপ্রদত্ত নাম আমিরুন নেসার বদলে নতুন নাম হয় রাণী সরকার। এরই মধ্যে এক হাজারের ও বেশি ছবিতে কাজ করে থাকলেও বর্তমানে কোনো কাজের ডাক পাচ্ছেন না তিনি। অর্থকষ্ট তো আছেই এমনকি বলতে গেলে অর্ধাহারেই দিন কাটছে তাঁর। সংসারে কে কে আছেন, কীভাবে চলে সংসার জানতে চাইলে রাণী সরকার বলেন, ‘আমরা তিন ভাইবোন ছিলাম, বড় ভাই মরহুম বেলায়েত হোসেন আর ছোট ভাই নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। তার বউ বাচ্চাসহ মোট ছয় জনের সংসার।

এই সংসার চলে প্রধানমন্ত্রীর টাকায়। তিনি আমাকে ২০ লাখ টাকার একটা চেক দিয়েছিলেন, সেখান থেকে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা পাই। এই যে বাড়িটা, ছোট দুই রুমের বাসা। তাও সব মিলিয়ে প্রায় ১৪ হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হয় আমার। বাকি ছয়-সাত হাজার টাকায় তিন বেলা ভাত খাওয়া সম্ভব হয় না। চাল কিনলে ডাল কেনা যায় না। ভাত থাকলে তরকারি থাকে না। কতো রাত নুন দিয়ে সাদা ভাত খেয়েছি তার হিসেব নাই।

তিনি আবারো কাজ করে খেতে চান জানিয়ে রাণী সরকার বলেন, ‘আমি চলচ্চিত্রে কাজ করেছি, সবাই আমাকে চেনে, যে কারণে ভিক্ষা করার কথা চিন্তাও করতে পারি না। আমি কারো কাছে ভিক্ষা চাইছি না, আমি কাজ করে ভাত খেতে চাই। আমাকে আপনারা কাজ দেন, কাজের বিনিময়ে যত ইচ্ছে টাকা দেন।

এদেশে যখন নারীরা অভিনয় জগত দূরের কথা, ঘরের বাইরের বাতাসের সঙ্গে পর্যন্ত ঠিকভাবে পরিচিত ছিলো না। তখন এই রাণীরা অভিনয় দিয়ে পর্দা কাপিয়েছেন। আজ রাজাহীন রাণীদের রাজত্বেও সম্পদের অভাব। দেশের বরেন্দ্র শিল্পীর মনের গহীনে দেশের জন্য রয়েছে অপরিমেয় সব অভিযোগ আর হতাশা। অভিনয়কে যারা সৃজনশীলতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন তাদের মধ্যে ঠিক কয়জন পরিচিত ‘রাণী সরকার’ এই নামটির সাথে? #

 

 

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.