কট্টর ডানপন্থিদের প্রত্যাখ্যান করেছেন ফরাসি ভোটাররা

 

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: আবারও প্রমাণিত হলো, ফরাসি ভোটাররা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কট্টর ডানপন্থিদের চান না। ইউরোপীয় নির্বাচনে (ইউরোপিয়ান ইলেকশন) তারা মারি লা পেনের কট্টর ডানপন্থি রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল র্যালিকে (আরএন) ব্যাপক সমর্থন করেছিল। এর ফলে ফ্রান্সের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রথম দফার ভোটেও আরএন এগিয়ে যায়। তবে দ্বিতীয় দফার ভোটে ঠিকই কট্টর ডানপন্থিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ভোটাররা।
আরএনের ওপর থেকে ফরাসি ভোটারদের এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনাকে দলটির জন্য ‘আশ্চর্যজনক বিপর্যয়’ই বলতে হয়। কেননা, প্রথম দফার ভোটে লা পেনের আরএন যেখানে প্রথম অবস্থানে ছিল, সেখান থেকে দ্বিতীয় দফার ভোটে এক লাফে তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে।
এক সপ্তাহ আগে প্রথম রাউন্ডের ভোটের ফলাফলের পর অনুমান করা হচ্ছিল, প্রায় ৩০০ আসন পেতে পারে আরএন। তবে দ্বিতীয় দফায় বিপুলসংখ্যক ভোটার এই দলের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন বিধায় যেমনটা মনে করা হচ্ছিল, সেই অনুপাতে ভোট পায়নি আরএন।
আরএন হয়তো যুক্তি দিতে পারে, দলের ভোট কমে যাওয়া কেবল তখনই সম্ভব হয়েছে, যখন বাকি দলগুলো আরএনকে থামাতে এককাট্টা হয়। আরএনের এই দাবি যৌক্তিক বটে। কারণ, বাকি দলগুলো আরএনের বিপক্ষে খেলতেই মাঠে নেমেছিল। লক্ষণীয়, বামপন্থি ও অন্যান্য দল হঠাত্ করেই নিজেদের মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে ‘অ্যান্টি আরএন জোট’ গঠন করে। আরো লক্ষণীয়, এই দলগুলোর এভাবে এক কাতারে দাঁড়ানোর পেছনে একটাই লক্ষ্য ছিল—আরএনের বিরোধিতা করা। এই একটি কারণ ছাড়া ঐ দলগুলোকে এক শামিয়ানার নিচে জড়ো হওয়ার দ্বিতীয় কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
যাহোক, ঘটনার পেছনে আরো অনেক কিছুই থাকতে পারে। ফ্রান্সে প্রচলতি ধারণা হলো, বেশির ভাগ ফরাসি ভোটার কট্টর ডানপন্থিদের পছন্দ করেন না। বলা যায়, ফরাসিরা তাদের ভয় পান। ফরাসি ভোটরদের আশঙ্কা, অতি ডানপন্থি সরকার ক্ষমতায় এলে অনিবার্যভাবে অস্থির হয়ে উঠতে পারে দেশ।
প্রথম দফার ভোটের ফলাফলে আরএন যখন এগিয়ে ছিল, তখন নিজেকে ‘ফ্রান্সের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন লা পেনের প্রধান সহযোদ্ধা ২৮ বছর বয়সি জর্ডান বারদেলা। তবে দ্বিতীয় দফার ভোটে আরএন প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল করতে না পারায় ফ্রান্সের নতুন প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে কাকে দেখা যাবে, তা জানতে আপাতত অপেক্ষাই করতে হচ্ছে। সম্ভবত এজন্য কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে।
দ্বিতীয় দফার ভোটের পর দেশ জুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতেই এমনটা করা হয়েছে। অর্থাত্, দেশে একধরনের অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে অভিজ্ঞ নির্বাচন বিশেষজ্ঞ অ্যালাইন ডুহামেল একটি অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি মনে করেন, ‘ফ্রান্সে এই মুহূর্তে আর কোনো একক প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল নেই।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘বর্তমান প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মূলত আমরা আমাদের রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে ধ্বংস করার পথে নামি। সম্ভবত এটা সেই মুহূর্ত, যখন ফরাসি রাজনীতি পুনর্গঠনের উপলক্ষ্য তৈরি হয়েছে।’
ডুহামেল মূলত যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো, ফ্রান্সে এখন অনেকগুলো রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে। প্রধানত তিনটি দলের কথা উল্লেখ করতে হয়। এই তিন প্রধান ব্লক হচ্ছে—বাম, কট্টর ডান ও মধ্যপন্থি। বলা বাহুল্য, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থা বিরাজ করছে। নির্বাচনে কোনো দলই এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারায় ‘একটি নতুন জোট’ গঠনের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যেতে পারে। যদিও নতুন জোট কীভাবে গঠিত হবে, এখন পর্যন্ত তা স্পষ্ট নয়। পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষের পরিপ্রেক্ষিতেই যে সেই নতুন জোটের উত্থান ঘটবে, তা একপ্রকার নিশ্চিত।
এই যখন অবস্থা, তখন বাজি ধরেই বলা যায়, বিগত সপ্তাহের উত্তেজনা ও টানটান উত্তেজনার পর সমঝোতার পথে হাঁটবেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ। দলগুলোকে সমঝোতার টেবিলে বসার আহ্বান জানাবেন। এই কাজ করার জন্য ম্যাক্রঁ অবশ্য কিছুটা ফুরসত পাচ্ছেন। আসন্ন অলিম্পিক আসর এবং গ্রীষ্মের ছুটির কারণে এই সমঝোতা প্রক্রিয়া বেশ খানিকটা বিলম্বিত হতে পারে। ফরাসিদের জন্য আশার সংবাদ হলো, এই সময়কালের মধ্যে তারা তাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার সযোগ পাবেন।
সব থেকে বড় প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রী কি বামপন্থি দল থেকে কেউ হবেন? নাকি মধ্যপন্থি দল থেকে হবেন? নাকি রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরের কেউ হবেন? এ নিয়ে আপাতত কিছুই জানার উপায় নেই। যদিও নিশ্চিতভাবে জানা যাচ্ছে, ফ্রান্স আরো বেশি সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে চলেছে। সম্ভবত এমন একটি ব্যবস্থা আসতে চলেছে, যেখানে ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁর কাছ থেকে চলে যেতে পারে নতুন সরকারপ্রধানের হাতে। এমনও হতে পারে, ম্যাক্রঁ যদি শেষ পর্যন্ত নিজের দল থেকে কাউকে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করতে সক্ষম হন, তাহলে নতুন সরকারপ্রধান সংসদীয় সমর্থনের ভিত্তিতে ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। যদিও বামপন্থিদের শক্তিশালী অবস্থানের কারণে তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, যে কোনো কিছুই ঘটতে পারে।
ফ্রান্সে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৭ সালে। সেই নির্বাচনে ম্যাক্রঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সম্ভাবনা কম। এমন একটি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে বলছেন, আগাম নির্বাচন দিয়ে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ যে বাজি ধরেছিলেন, তা তার জন্য বুমেরাং হয়েছে। ম্যাক্রঁ নিশ্চিতভাবে হেরে গেছেন বাজিতে। তাড়াহুড়া করে নির্বাচন দিয়ে তিনি এখন আফসোস করছেন কি না, সেই প্রশ্নও তুলছেন অনেকে। আবার অনেকে জানতে চাইছেন, ম্যাক্রঁ কি তাহলে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়াবেন? এ ধরনের নানা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে তখনই, যখন ম্যাক্রঁ খোলাসা করবেন—এসব নিয়ে তিনি আদতে কী ভাবছেন।
আপাতত এটাই ধরে নিতে হবে যে, ম্যাক্রঁ বলতে চাইবেন, ‘আমি নির্বাচন দিয়েছি এ কারণে যে, দেশের পরিস্থিতি ক্রমশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠছিল।’ ইতিমধ্যে তিনি তার রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। নির্বাচনি ফলাফলের ভিত্তিতে আরএনকে সংসদীয় আসনের ন্যায্য অংশের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছেন। ম্যাক্রঁ সম্ভবত জানতেন যে, ফরাসিরা কখনোই কট্টর ডানদের ক্ষমতায় বসাবে না। ম্যাক্রঁর এই একটি অনুমান সঠিক ছিল বলেই প্রমাণিত হয়েছে। আর এই একটি যুক্তিতেই তিনি থেকে যেতে পারেন রাজনীতির মাঠে। কিন্তু ম্যাক্রঁর ক্ষমতা হ্রাস পাবে নিশ্চিতভাবে। তবে তিনি এখনো এলিসি প্রাসাদেই থাকবেন। আগামী দিনগুলোতে তিনি ঠিক কী কৌশল অবলম্বন করবেন, তা কেবল তিনিই জানেন। তবে তারও নিজস্ব পরিকল্পনা রয়েছে নিশ্চই। দ্বিতীয় দফার ভোটে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর পর দলের সঙ্গে তিনি জোর শলাপরামর্শ চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজনীতিবিদদের মতামত জানতে চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি নিজের এবং দলের ইতিবাচক দিক তুলে ধরার কাজও করে যাচ্ছেন। এসব তার জন্য কতটা সুবিধা ও সুফল বয়ে আনবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এখন এতটুকুই বলতে হয়, ফ্রান্সের রাজনীতি এগিয়ে চলেছে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ফরাসি রাজনৈতিক নেতারা এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবেন, নাকি সময়কে স্তব্ধ করে দেবেন, সেটাই দেখার বিষয়। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.