ওয়াইফাই, মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ যে গ্রামে

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্কনরওয়েজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ স্যালবার্ডে এমন একটি গ্রাম আছে-যেখানকার বাতাস সারাবিশ্বের তুলনায় বেশি পরিষ্কার। প্রতিটি নিঃশ্বাস বিশুদ্ধতায় পরিপূর্ণ।
অতিপরিচ্ছন্ন গ্রামটিতে ওয়াই-ফাই, মোবাইল ফোন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এখানে মেরু ভল্লুকের আক্রমণ থেকে দৌড়ে পালানোর সময় আশ্রয়প্রার্থীর জন্য সব ভবনের দরজা আগে থেকেই খোলা থাকে।
তুলনামূলকভাবে শীতল পাহাড়ঘেঁষা গ্রামটি মূলত আর্কটিক মরু অঞ্চল। অত্যন্ত শুষ্ক ও হিমায়িত বাতাস প্রশ্বাসের সঙ্গে যখন বেরুতে থাকে, তখন মনে হয় কুয়াশার মতো বরফের ক্ষুদ্র ঝকঝকে হিরার মতো ঝকঝকে কণাগুলো লুকোচুরি খেলায় মত্ত।
স্পিটসবার্গেনের ব্রোগারহালভায়া নামের এই উপদ্বীপের ৫৫৬ মিটার উঁচু জেপেলিনফজেলেট পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে ছড়িয়ে গেছে এনওয়াই এলিসান্ড গ্রামটি।
যেখানে গভীর শীতে বসবাস করেন মাত্র ৪৫ জন মানুষ। আর গ্রীষ্ম আসার সঙ্গে সঙ্গে সে সংখ্যা হয়ে যায় ১৫০। যে বাসিন্দারা আসেন ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন, ইতালি, নরওয়ে, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনসহ সারা বিশ্ব থেকে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে উত্তরের স্থায়ী বসতি। উত্তর মেরু থেকে প্রায় ৭৬৫ মাইল দূরে। এক পাশে সগৌরবে মাথা উঁচু করা পাহাড়। অন্য দিকে ফজর্ড নামের একটি শ্বাসরুদ্ধকর সুন্দর জায়গা।
এই গ্রামের বাসিন্দারা মূলত বিজ্ঞানী। গবেষণার কারণেই এখানে আসেন। ১৯৮৯ সালে গবেষকদের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ নিরীক্ষণ করতে সাহায্য করতে ৪৭২ মিটার (১,৫৪৮ ফুট) উচ্চতায় এখানে একটি গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছিল। সম্প্রতি জলপরিবর্তনের পটভূমিতে জেপেলিন অবজারভেটরি নামের সেই গবেষণা কেন্দ্রটি গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা পরিমাপের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে উঠেছে।
তবে এখানে বাতাসের মান পরিবর্তন হতে পারে এমন লক্ষণও খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। মাঝে মাঝে বায়ুমণ্ডলীয় স্রোত ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা থেকে স্যালবার্ডের এই অংশে বায়ু প্রবাহিত করে-যা এই অঞ্চলে দূষিত বায়ু প্রবেশে সহায়ক হয়। গবেষকরা কেবলমাত্র কিছু দূষণের মাত্রা বাড়াচ্ছেন তা নয়-বরং বাতাসে নতুন ধরনের দূষণের লক্ষণ থাকায় বিজ্ঞানীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রেডিয়েশনমুক্ত অঞ্চলটিতে গবেষকরা রেডিও ট্রান্সমিশন ব্যবহার করতে চাইলে তাদের বিশেষভাবে অনুমতি নিতে হয়।
অন্ধকারাচ্ছন্ন ও ঠান্ডা এই এলাকাটি স্যালবার্ড মেরু ভল্লুকের প্রাকৃতিক আবাসস্থল। মানববসতির কাছাকাছিও ওদের ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। তাই নিয়ম করা হয়েছে, জনবসতির ভেতরে ভল্লুকের সম্ভাব্য উপস্থিতির কারণে কেউ কোনো ভবনের দরজায় লক ব্যবহার করতে পারবে না-যেন প্রয়োজন হলেই মেরু ভল্লুকের আক্রমণ থেকে বাঁচতে সহজেই দরজা ঠেলে বাড়ির ভেতরে আশ্রয় নিতে পারেন।
জেপেলিন অবজারভেটরি এবং নরওয়েজিয়ান ইনস্টিটিউট ফর এয়ার রিসার্চের সিনিয়র বিজ্ঞানী ওভ হারম্যানসেন বলেন, ‘জেপেলিন মানমন্দিরটি একটি দূরবর্তী এবং আদিম পরিবেশে অবস্থিত, দূষণের প্রধান উৎস থেকে অনেক দূরে। তাই এর মাত্রা কম।’ এনওয়াই এলিসান্ড-এর গবেষণা বায়ুমণ্ডলে মনুষ্যসৃষ্ট দূষণের মাত্রা কতটা প্রভাবিত হয়, তার একটা ধারণা পাওয়া যায় বলে ব্যাখ্যা করেন হারম্যানসেন। সপ্তাহে পাঁচ দিন নরওয়েজিয়ান পোলার ইনস্টিটিউটের একজন কর্মচারী ক্যাবল কারে করে মানমন্দিরে ওঠেন, সেখানে রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন তারা। এখান থেকেই বাতাসের নমুনা নেওয়া হয়।
মানমন্দিরের সেন্সরগুলো শুধু গ্রিনহাউজ গ্যাসই নয়, ক্লোরিনযুক্ত গ্যাস যেমন সিএফসি, বায়ুবাহিত ভারী ধাতু, অর্গানোফসফেট দূষণকারী যেমন কীটনাশক এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো কণাগুলোর অবস্থান বা উপস্থিতিও নির্দেশ করে।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে শত বছর আগেও এমন ছিল না জায়গাটি। ১৯১৬ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে এটি ছিল কয়লা খনির শহর। একবার কয়লাখনির বিস্ফোরণে ২১ জন খনি শ্রমিক নিহত হওয়ার পর খনিটি বন্ধ হয়ে যায়। তার পর থেকে এটি এমন এক আদর্শ বায়ুর স্থানে রূপান্তরিত হয়-যেখান থেকে বিশুদ্ধ বাতাসের সর্বোত্তম উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। (সূত্র: বিবিসি)। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.