ওরা সত্যিই জলমানব, কাল্পনিক নয়

বিটিসি নিউজ ডেস্ক: পানির তলায় বাস করে ওরা দিনের ৬০ ভাগ সময় । আর এটাই তাদের বিবর্তনকে প্রভাবিত করছে।বাজাও নামে পরিচিত, মালয় দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী মানুষগুলো । এদের জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কাটে সাগরে। নৌকার ওপরে অথবা উপকূলের অগভীর অঞ্চলে মাচাঘর বানিয়ে থাকে। জীবিকার প্রয়োজনে পুরো জনগোষ্ঠী এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিভ্রমণ করে। ওদের খাদ্যাভ্যাস সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল।

পানির নিচে ডুবে থাকার অদ্ভুত ক্ষমতা ওদের। মাঝেমধ্যে পানির ৭০ মিটার গভীর পর্যন্ত চলে যেতে এবং সেখানে পাঁচ মিনিট অবধি অবস্থান করতে পারে। পানির নিচে যাওয়ার জন্য তেমন কিছু ব্যবহার করে না ওরা। শুধু ভেসে ওঠা ঠেকাতে এক জোড়া ভারী বস্তু বেঁধে নেয় শরীরে আর কাঠের ফ্রেমে ভাঙা কাচের তৈরি লেন্স লাগানো একধরনের চশমা পরে। এ ধরনের লেন্স অত গভীরে পানির চাপেও বিকৃত হয় না।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মেলিসা ইলারডো এবং রাসমুস নিয়েলসেন বাজাওদের নিয়ে গবেষণা করে তাদের অদ্ভুত জীবনাচরণের কারণ শনাক্ত করতে চেষ্টা করেছেন। বাজাওদের এভাবে বেঁচে থাকার ইতিহাস বহু পুরোনো। ঐতিহাসিক দলিলপত্রে দেখা যায়, তাদের জীবনপ্রক্রিয়ার ইতিহাস কমপক্ষে এক হাজার বছরের পুরোনো। অনেক গবেষকের ধারণা, বাজাওদের জিনগত বৈশিষ্ট্যই তাদের ব্যতিক্রমী জীবনপদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়।

যখন একজন মানুষ পানিতে ডুব দেয়, তখন তাকে কৌশলে দম ধরে রাখতে হয়। একে বলা হয় ‘ডাইভিং রেসপন্স’ বা ডুবুরির প্রতিক্রিয়া। এর সঙ্গে দেহযন্ত্রের বেশ কয়েকটা কাজ একসঙ্গে হয়। অক্সিজেনের সঞ্চয় বাঁচানোর জন্য হৃৎস্পন্দন কমাতে হয়; দেহের উপরিত্বক থেকে রক্ত সবচেয়ে বেশি অক্সিজেন-সংবেদনশীল অঙ্গগুলোয় পাঠাতে হয়, যেমন মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসে; অক্সিজেনসমৃদ্ধ লোহিত রক্তকণিকার জরুরি ভান্ডার প্লীহার সংকোচন আবশ্যক হয়, যাতে রক্তপ্রবাহে এসব কোষের উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়।

মিজ ইলার্ডো ও নিয়েলসেন বাজাওদের জিনগত বৈশিষ্ট্য ও দৈহিক গঠনতন্ত্র এসব প্রতিক্রিয়াকে সমর্থন করে কি না খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেন।এই পর্যবেক্ষণের জন্য মিজ ইলার্ডো ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে ৫৯ জন বাজাওকে নিয়োগ দেন এবং ডিএনএ পরীক্ষার জন্য তাদের লালা সংগ্রহ করার পাশাপাশি আলট্রাসনিক পদ্ধতিতে তাদের প্লীহার পরিমাপ করেন। নিয়ন্ত্রণ গোষ্ঠী হিসেবে তিনি সালুয়ানদের মধ্য থেকে ৩৪ জনকে বেছে নেন। সালুয়ানরা মাটিতে বসবাস করলেও বাজাওদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী।

আলট্রাসনিক স্ক্যানে দেখা যায়, বাজাওদের প্লীহা সালুয়ানদের প্লীহার চেয়ে ৫০ শতাংশ বড়। এই পার্থক্য একজন ব্যক্তি পানিতে নাকি পানির ওপরে নৌকায় বাস করে, তার সঙ্গে সম্পর্ক নেই। এটি ইঙ্গিত দেয় যে পানিতে ডুব দেওয়ার কাজটি নয়, মূলত বাজাও বংশলতিই বড় প্লীহার জন্য দায়ী। ডিএনএর বিশ্লেষণেও একই ঘটনার সাক্ষ্য মেলে। বাজাওদের জিনোমে এমন এক রূপান্তরের সন্ধান মেলে, যা রক্তপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণকারী একটি জিনের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন বেছে বেছে অক্সিজেন-বুভুক্ষু প্রত্যঙ্গগুলোতেই রক্ত পাঠানো।

আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কার্বনিক অ্যানহাইড্রাস এনজাইম উৎপাদনকারী জিনের রূপান্তর। এই এনজাইম রক্তপ্রবাহে কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি মন্থর করে। এটাও বাজাওদের দীর্ঘক্ষণ জলে থাকার কারণে ঘটে থাকে। প্লীহার চারপাশের পেশি সংকোচনের সঙ্গে সম্পর্কিত জিনের পরিবর্তন আসলে অতিমাত্রায় ডাইভিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্লীহা মেপে মেপে অক্সিজেন সংবেদনশীল অঙ্গগুলোতে রক্ত সঞ্চালন করতে পারে। জাওদের জিনে আরেকটি পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, যা কার্বনিক এনহাইড্রাস উৎপাদন করে থাকে।

রক্তপ্রবাহে কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদন মন্থর করে দেয় এমন একধরনের এনজাইম আছে তাঁদের শরীরে । প্লীহার চারপাশের পেশি সংকোচনের সম্পর্কিত জিনের পরিবর্তন এবং নিম্নমাত্রার অক্সিজেনের বিপরীতে প্রতিক্রিয়াও বেড়ে যায়। এসব ফলাফল একত্র করে মিজ ইলার্ডো ও নিয়েলসন দাবি করেন যে ডুব দিয়ে খাদ্য সংগ্রহের অভ্যাসই বাজাওদের মধ্যে এই জিনগত পরিবর্তন এনেছে। তবে ওই বিবর্তনের পেছনে বড় পরিবার প্রতিপালনে পর্যাপ্ত খাবার সংগ্রহ করার জন্য পানিতে ঝাঁপাতে না পারা, বা তা করতে গিয়ে তাদের মৃত্যুই কাজ করেছে কি না, এই রহস্যের কিনারা এখনো হয়নি।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.