এখনও প্রাণবন্ত বঙ্গচেতনার প্রতীক উত্তমকুমার

কলকাতা-হাওড়া (ভারত) প্রতিনিধি: এই পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ জন্ম নেন, যাঁদের প্রতিভা কোনও গন্ডি  মানে না, মানে না কোনও সীমারেখা বা সীমানাও। সময়ের সীমানা, ভৌগলিক বা রাজনৈতিক সীমানা- এ সব কিছুরই ঊর্দ্ধে বিচরণ অনন্য প্রতিভার। এমনই এক বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে যুগে যুগে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে চলেছেন মহানায়ক উত্তম কুমার। শুধুমাত্র মহানায়ক বললে বোধহয় কম বলা হবে, তিনি ছিলেন বাংলা এবং বাঙালির অন্যতম আইকন। তাই মৃত্যুর ৪১ বছর পরেও উত্তমকুমার যেন সেই আগের মতোই প্রাণবন্ত। ২৪ জুলাই তাঁর চিরবিদায়ের দিনটি এলেই যেন ভেসে আসে বাঙালির আর এক প্রবাদপুরুষ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবির সেই গানটা- যাই, চলে যাই, যাই চলে যাই/ আমায় খুঁজো না তুমি, বন্ধু বুঝো না ভুল……
মহানায়কের অভিনয় প্রতিভা সত্যিই হৃদয় ছুঁয়ে গেছে দুই বাংলার। ‘সপ্তপদী’, ‘হারানো সুর’, ‘মন নিয়ে’, ‘মেমসাহেব’, ‘বিকেলে ভোরের ফুল’, ‘সব্যসাচী’, ‘ সাগরিকা’, ‘পথে হলো দেরি’, ‘ঝিন্দের বন্দি’, ‘ সন্ন্যাসীরাজা’, ‘ স্ত্রী’, ‘ বাঘবন্দির খেলা’, ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘অমানুষ’, ‘ওগো বধূ  সুন্দরী’, ‘ছোটি সি মুলাকাত’ –সবেতেই তিনি অনন্য। তাঁর অভিনীত অজস্র ছবিতে প্রতিভার চুলচেরা বিশ্লেষণ আজ আর নিস্প্রয়োজন। তাঁর হাঁটাচলায়, পোশাকে, কথাবার্তায় কখনও বা সাহেবি  কায়দা আবার কখনও বা বাঙালিবাবুর মেজাজ। তবে স্টাইলে,টেকনিকে পর্দায় যা-ই ফুটে উঠুক না কেন, মনেপ্রাণে উত্তমকুমার কিন্তু ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। বাঙালিয়ানা তাঁর রক্তে, জীবনের প্রতিটি ছন্দে। থ্রি পিস স্যুট নয়, ধুতি পাঞ্জাবিতেই তিনি স্বচ্ছন্দ্য। ‘সন্ন্যাসীরাজা’ র রাজাবাবু কিংবা ‘দেবদাস’এর চুণীলালের সাজেই যেন সবচেয়ে বেশি মানানসই বলে মনে হতো তাঁকে। সেই কারণেই বঙ্গ-সংস্কৃতির মূর্ত প্রতীক উত্তমকুমার।
না, ১০০ শতাংশ বললে বোধহয় পুরোটা বলা হয় না। বলা যেতে পারে ১০০০ শতাংশ বাঙালি ছিলেন মহানায়ক। লোক দেখানো নয়, বাঙালিয়ানার মোড়কে চালবাজিও নয়। আন্তরিকতায় ভরা নির্ভেজাল বাঙালিয়ানা। তাই পয়লা বৈশাখ আর বিজয় দশমীর মতো বিশেষ দু’টি দিনকে উত্তমকুমার পালন করতেন একেবারে নিজের মতো করে। পয়লা বৈশাখে ক্যামেরার মুখোমুখি হতে হতো না তাঁকে। কারণ, স্টুডিও পাড়ায় ছুটি। বাংলা বছরের প্রথম দিনটিতে তাই ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে চান করে পুজোপাঠ সেরে ধুতিপাঞ্জাবিতে নিখুঁত করে সাজিয়ে তুলতেন  নিজেকে। তারপরে মাকে প্রণাম করে দক্ষিণ কলকাতার ‘বসুশ্রী’ হলে  একেবারে অডিয়েন্সের মুখোমুখি। নববর্ষের প্রভাতী আড্ডার মূল আকর্ষণ, উত্তম কুমার-হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
দুপুরবেলার ভবানীপুরের বাড়িতে ফিরে এলাহি মধ্যাহ্নভোজ। সেখানেও বঙ্গ সংস্কৃতির প্রতিফলন। নিরামিষ রান্না করতেন মা চপলাদেবী, আমিষের দায়িত্ব স্ত্রী গৌরীদেবীর। ভাত,শুক্তো, ডাল, বেগুনভাজার পাশাপাশি আরও নানা রকমের ভাজা। মাছেরও নানা পদ। চিংড়ি চাই-ই চাই। সঙ্গে পাঁঠার মাংস। চাটনি,পায়েসের শেষে অবশ্যই মিষ্টি। সন্ধ্যায় গিরিশ মুখার্জি  রোডের বাড়ির পুরনো ঠাকুর দালান কিংবা নতুন বাড়ির চারতলার দালানে বসতো বাংলা গানের আসর। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা ছিলেন অতিথি তালিকায়। গান গাইতেন উত্তমকুমার নিজেও। সান্ধ্য-আড্ডাতেও  আয়োজন মুখরোচক বাঙালি পদের। গলা ভিজতো দইয়ের সরবতে।
বিজয়া দশমীতেও মহা সমারোহে চলতো বাঙালিয়ানার অনুশীলন। বাড়িতে তৈরি করানো হতো ঘুগনি, নিমকি এবং কত রকমের মিষ্টি। সন্ধ্যায় ধুতি-পাঞ্জাবিতে সেজে মহানায়ক নিজে অতিথি আপ্যায়ন করতেন বাড়িতে।
এ সব গল্পই শুনেছি মহানায়কের পুত্রবধূ মহুয়া চট্টোপাধ্যায়ের মুখে। খুব সুন্দর করে ধুতি পরতেও পারতেন মহানায়ক। কোনও অনুষ্ঠানে গেলে এই পোশাকই ছিল তাঁর প্রথম পছন্দের। বাঙালি খাবার খেতে ভালোবাসতেন। আরও ভালোবাসতেন অন্যকে খাওয়াতে।
একমাত্র সন্তান গৌতমকে পড়িয়েছিলেন দার্জিলিঙের সেন্ট পলসে। পরে লা মার্টসে। স্কুল জীবন কেটেছে পুরোপুরি সাহেবি পরিবেশে। তবুও বাঙালিয়ানার প্রশ্নে উত্তমপুত্রও ছিলেন আপসহীন। বাবার মতোই অকালে চলে যেতে হয়েছিল তাঁকেও। মাত্র ৫৪ বছর বয়সেই, জুলাইয়েরই এক অভিশপ্ত রাতে। কিন্তু তাঁর অভিনেতা পুত্র গৌরবও এখন  বুক দিয়ে  আগলে রাখেন বাংলার সংস্কৃতিকে। মনে পড়ে, সম্ভবত ২০০৬ তেই বড় পর্দায় অভিষেক হয়েছিল উত্তমকুমারের নাতি গৌরবের। তরুণ মজুমদারের ‘ভালবাসার অনেক নাম’ ছবিতে। তাঁর বিপরীতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাতনি মেঘা। তাপস পাল এবং মৌসুমী ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। ভবানীপুর থানার পাশে একটি হলে ছবির ওপেনিং শো-তে উপস্থিত ছিলেন সকলেই। কিন্তু নবীন অভিনেতা গৌরবকেই শুধু দেখা গিয়েছিল সাবেক ধুতি-পাঞ্জাবিতে।
বাঙালির এই হার্টথ্রব মহানায়ক উত্তমকুমারের শেষযাত্রায় শোকে ভেঙে  পড়েছিল কলকাতা মহানগরী। বাংলার অনেক ঘরেই পালিত হয়েছিল অরন্ধনও। কিন্তু অভিযোগ, ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই তাঁর অকাল  প্রয়াণের পরে তিনি প্রাপ্য সম্মান পাননি সেই সময়ের বামফ্রন্ট সরকারের কাছে।
এই অভিমান কিন্তু মুছে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৯ এ ইউপিএ ২ সরকারের রেলমন্ত্রী হওয়ার পরেই টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের নামকরণ করেছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমারের স্মৃতিতে। উত্তমপুত্রের অকাল মৃত্যুর পর থেকে মহানায়কের পরিবারকে অভিভাবকের মতো আগলে রেখেছেন মমতাই।
সঙ্কটের দিনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার এবং সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সীও। ২০০৪-৫ এ গুরুতর অসুস্থ উত্তমপুত্র গৌতমের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রিয়বাবু। গৌতমের মৃত্যুর পরে মহানায়কের ওপরে তথ্যচিত্র নির্মাণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনিই। আজ প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সীও নেই। কিন্তু বঙ্গ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ উত্তমকুমারকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণে তাঁর ভূমিকাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে রাখবে চলচ্চিত্র জগৎ।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ (বাংলাদেশ) এর কলকাতা-হাওড়া (ভারত) প্রতিনিধি সৌম্য সিংহ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.