উপকূলজুড়ে ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডব, লন্ডভন্ড সেন্টমার্টিন

কক্সবাজার প্রতিনিধি: ঘূর্ণিঝড় মোখা তার গতিপথ পরিবর্তন করে মিয়ানমারের উপকূল হয়ে স্থলভাগে আঘাত হানলেও শেষ রক্ষা হয়নি দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের। এখানে এক নারী গাছচাপায় আহত হলেও আর কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে পুরো দ্বীপটি লন্ডভন্ড করে দিয়েছে মোখা।
আজ রবিবার (১৪ মে) বিকেল ৫টার পর সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান জানান, সকাল থেকে শুরু হওয়া ঝোড়ো হওয়া দুপুর ১টার পর থেকে ক্রমাগত তীব্র হতে থাকে। বিকেল ৪টার পর থেকে বাতাসের তীব্রতা কমে বৃষ্টিপাতের মাত্রা বাড়তে থাকে। এই পুরো সময়ে দ্বীপের ১২ শতাধিক আধাপাকা টিনশেড ঘর, ছোট্ট মানের কটেজ বাতাসে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। দ্বীপের ৭৫ শতাংশ গাছ ভেঙে পড়েছে। সাগরের পানি স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে একটু বেশি হলেও কোথাও প্লাবিত হয়নি।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের সদস্য (মেম্বার) খোরশেদ আলম জানান, দ্বীপের পূর্ব পাশে অবস্থিত বাজারের অধিকাংশ দোকান বাতাসে উড়ে গেছে। গাছচাপায় এক নারী আহত হলেও আর কেউ হতাহত হয়নি। চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক সড়কের ভেঙে পড়া গাছ সরিয়ে চলাচল উপযোগী করার কাজ চলছে।
দুপুর ২টায় সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের কোনারপাড়ায় গাছচাপায় আহত নারী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ব্যাপারে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল হালিম বিটিসি নিউজকে বলেন, তীব্র বাতাসে অসংখ্য গাছ ও ঘর ভেঙে গেছে। এতে একটি গাছ ভেঙে ওই নারী চাপা পড়েন। সেন্টমার্টিন ফাঁড়ির পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ওই নারীর চিকিৎসা চলছে।
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা ট্রলার মালিক সমিতির সাবেক নেতা আবু তালেব জানান, আগে থেকে আঘাতের যে তথ্য প্রচার হয়েছে, ততটা না হলেও দ্বীপটিকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে মোখা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দ্বীপের দক্ষিণ ও পূর্বাংশে। যেখানে অসংখ্য গাছ ছাড়াও আধাপাকা, টিনশেড সব ঘর ভেঙে গেছে। উড়ে গেছে ছাউনি।
বৃষ্টির সঙ্গে সাগরের ঢেউয়ের তীব্রতা এখন রয়েছে বলে জানিয়েছেন দ্বীপের ব্যবসায়ী নাহিদ হোসেন। তিনি জানান, দ্বীপের মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে অনেক সময় লাগবে।
মোখার আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সেন্টমার্টিন দ্বীপের হয়েছে বলে স্বীকার করে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানান, সেন্টমার্টিনের চেয়ারম্যান ও সেখান থেকে পাওয়া প্রাথমিক তথ্যমতে দ্বীপের ৭৫ শতাংশ গাছ ছাড়াও ১২ শতাধিক ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত এক নারী আহত হওয়ার খবর ছাড়া আর কোনো হতাহতের তথ্য পাওয়া যায়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর দ্বীপে গিয়ে ক্ষতির সার্বিক চিত্র বা পরিমাণ জানা যাবে।
তিনি জানান, দ্বীপের আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষকে সেখানেই অবস্থান নিতে বলা হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় আশ্রয়কেন্দ্র ত্যাগের অনুমতি দেয়া হবে। আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন।
উপকূলজুড়ে তাণ্ডব
কক্সবাজার জেলার উপকূলজুড়ে ঘূর্ণিঝড় মোখা তাণ্ডব চালিয়েছে। এই তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেন্টমার্টিন দ্বীপের। তবে আঘাতের কবলে পড়েছে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, টেকনাফ পৌরসভা, সদর ইউনিয়ন, বাহারছড়া ইউনিয়ন, উখিয়ার জালিয়া পালং ইউনিয়নের ইনানী, পাটুয়ারটেক, সোনাপাড়া এলাকা। যেখানেও অসংখ্য ঘর ও গাছ ভেঙে গেছে।
টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আলম বিটিসি নিউজকে জানান, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, টেকনাফ পৌরসভা, সদর ইউনিয়ন, বাহারছড়া ইউনিয়নের গাছের ওপর তাণ্ডব চালিয়েছে মোখা। এসব এলাকার ৩০ শতাংশ গাছ ভেঙে গেছে। এ ছাড়া বহু ঘর ভেঙে গেছে।
এর সংখ্যা নির্ধারণে কাজ চলছে মন্তব্য করে নুরুল আলম বিটিসি নিউজকে জানান, সেন্টমার্টিন বাদ দিলে টেকনাফ উপজেলায় আরও কম হলেও এক হাজার ঘর ভেঙে গেছে।
বেশকিছু গাছ ও ঘর ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সত্যতা স্বীকার করে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বিটিসি নিউজকে জানান, প্রাথমিক তথ্যমতে অসংখ্য গাছ ভেঙে গেছে। জেলায় ১২ হাজার ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। যার মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ঘর দুই হাজারের বেশি। এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন মিলে ক্ষতির পরিসংখ্যান নির্ধারণে কাজ শুরু হয়েছে। তবে এর সঠিক চিত্র পেতে সময় লাগবে। একই সঙ্গে জোয়ারের পানিতে নতুন করে বেড়িবাঁধের কিছু এলাকাও ভেঙে গেছে বলে জানা গেছে। তা নির্ধারণেও পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ শুরু করেছে।
কক্সবাজারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ বিটিসি নিউজকে জানান, কক্সবাজারে ৫৯৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৩২ কিলোমিটার অরক্ষিত ছিল আগে থেকেই। এই ৩২ কিলোমিটারের বাইরে কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না দেখা হচ্ছে।
তিনি জানান, মোখা যতটুকু আঘাত আনার কথা তা হয়নি। তার কারণ আঘাত আনার সময়টি ভাটা এবং পূর্ণিমা-অমাবস্যার মধ্যে সময়কাল। তার সঙ্গে ঢেউয়ের বিপরীত দিকে বাতাসের দিক হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা কমেছে।
কক্সবাজার আঞ্চলিক আবহাওয়া কার্যালয়ের প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান বিটিসি নিউজকে জানান, রোববার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজারে ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এরপর বৃষ্টির তীব্রতা বেড়েছে।
এদিকে কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া তিন লাখ মানুষ বিকেল ৫টা থেকে আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে ফিরে যেতে শুরু করেছেন। যদিও কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের প্রধান বিভীষণ কান্তি দাশ বিটিসি নিউজকে জানান, এত দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্র না ছাড়ার জন্য বলা হয়েছে। পরিস্থিতি আরও উন্নত হলে এদের ঘরে পৌঁছে দেয়া হবে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর কক্সবাজার প্রতিনিধি আবুল কালাম আজাদ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.