উত্তরা গণভবনে ৬৫ কোটি টাকার নতুন স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ

নাটোর প্রতিনিধি: প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাঞ্চলীয় বাসভবন নাটোরের উত্তরা গণভবনকে আরো বেশি পর্যটক আকর্ষণীয় করার নামে ভেতর ও বাহিরে নতুন স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। প্রাথমিকভাবে এ কাজের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা। এছাড়া উত্তরা গণভবনের ভেতরে ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি থ্রি-ডি কর্ণার নির্মাণেরও তোরজোড় শুরু হয়েছে। পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি পাস না হলেও রাজশাহীর একজন ব্যক্তিকে আংশিক কাজের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের বিস্তারিত উল্লেখ করে গণভবনের ভিতরে ও বাহিরে সাইবোর্ড টানানো হয়েছে। পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধির নামে বিখ্যাত রাজা দয়ারাম রায়ের শাসনামল, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক এ স্থাপনায় নতুন ভবন নির্মাণ হলে কয়েকশত বছরের ঐতিহ্যের বুকে কুঠারাঘাত করা হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে স্থানীয় সুধীমহল। তবে জেলা প্রশাসনের দাবী, কেবল বিবেচনার জন্য প্রস্তাব আকারে এ সংক্রান্ত প্রকল্পটি গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

নাটোর জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর(এনডিসি) অনিন্দ্য মন্ডল বিটিসি নিউজকে জানান, ভেতরে ও বাইরে মিলিয়ে উত্তরা গণভবনের জায়গার পরিমাণ ৪৪ দশমিক ৩৯ একর। এর মধ্যে ভেতরে ৪১দশমিক ৫০ একর ও বাইরে ২ দশমিক ৮৯ একর। গণভবনের সৌন্দর্য্যবর্ধন ও লাভজনকতা বিবেচনায় নতুন স্থাপনা নির্মাণের প্রস্তাবসম্বলিত একটি প্রকল্প তৈরী করে ৬৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। যেখানে ভেতরে প্রায় ৩৪ কোটি ও বাইরে ৩১ কোটি টাকা। ভেতরে ও বাইরে মিলিয়ে থ্রি-ডি কর্ণার সিনেপ্লেক্স, মোটেল, শপিং কমপ্লেক্স, সুইমিং পুল, কালভার্ট, ওয়াকওয়ে, বোটিং, পুকুরপাড়া বাঁধাই করে আগত দর্শনার্থীদের বিনোদনের যাবতীয় ব্যবস্থার পরিকল্পনা রয়েছে প্রস্তাবিত প্রকল্পে।

২০১৭ সালে গণপূর্ত বিভাগ থেকে গণভবনের কর্তৃত্ব নেয়ার পর মন্ত্রীপরিষদ সচিবকে আমন্ত্রণ জানিয়ে অধিকতর সংস্কারের প্রস্তাব দেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প বিবেচনার জন্য পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পৌছে। এ যাবৎকালে নাটোর জেলার সর্ববৃহৎ এ প্রকল্পটি সম্পর্কে অনেকটা অন্ধকারেই ছিলো নাটোরবাসী। তবে সম্প্রতি উত্তরা গণভবন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এর ভেতরে ৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি থ্রি-ডি সিনেপ্লেক্স নির্মাণের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হওয়ার খবরে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে সচেতন মহলে। জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার নেকনজরে থাকা রাজশাহীর একজন টেলিভিশন গণমাধ্যমকর্মীকে থ্রি-ডি সিনেপ্লেক্স নির্মাণের জন্য দায়িত্ব দেয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। সেদিন ওই গণমাধ্যমকর্মীর স্থানীয় এক প্রতিনিধিও সভায় উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও গণভবনের ভেতরে কফিহাউজ ও উইন্ডোশপ স্থাপনে আগ্রহী প্রশাসন ঘনিষ্ট স্থানীয় ও জেলার বাইরের বেশ কয়েকজন ব্যক্তি গণভবন পরিদর্শনও করেছেন। সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের উধ্বতন কর্মকর্তারাও উত্তরা গণভবনে যাতায়াত বাড়িয়েছেন। গণভবনের ভেতরে-বাইরে নতুন স্থাপনার নির্মাণ সরকারী না বেসরকারীভাবে নাকি সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বে হবে- পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্ত্কৃ তার কোন নির্দেশনা এমনকি প্রকল্পটি এখন পর্যন্ত পাস না হলেও স্থাপনা নির্মাণে জেলা প্রশাসনের এমন তৎপরতায় বিস্মিত অনেকেই। একইসাথে উত্তরা গণভবন ব্যবস্থাপনা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত নাটোরের স্থানীয় ব্যক্তিদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

আজ বুধবার উত্তরা গণভবনে গিয়ে মূলক ফটক পেরতেই দেখা যায় গণভবনের প্রস্তবিত সংস্কার ও স্থাপনা নির্মাণের একটা নকশা বিলবোর্ড আকারে টানানো রয়েছে। নকশা অনুযায়ী, গণভবনের চার দিকে সংস্কারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সে অনুযায়ী, প্রস্তাবিত নকশার দক্ষিণ পাশে একটি ওয়াচটাওয়ার, ফুট ওভারব্রীজ, পাথওয়ে, পাথওয়ে ল্যান্ডস্কেপ, গার্ডেন, ফোয়ারা, ভাসমান প্লাটফর্ম, পশ্চিমে দুইটি করে বিশ্রামাগার, বসার জায়গা ও সংস্কার করা ঘাট, উত্তর পার্শ্বে পাথওয়ে, ফুটওভারব্রীজ ও ওয়াচটাওয়ার এবং পূর্বে পাবলিক টয়লেট, ওয়াটারবুথ, পাথওয়ে, বিশ্রামাগার ও বসার জায়গা। প্রস্তাবনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, মূল নকশার পরিবর্তন ঘটিয়েই স্থাপনা নির্মাণ করতে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন।

নাটোরের প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, সর্বশেষ উত্তরা গণভবনের মূল নকশায় পরিবর্তন আসে ১৯৬৫ সালে। তৎকালীন পূর্ত বিভাগের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার গণভবনের মূল ভবনে একটি গম্বুজ বসায় যা এখনো অবিকৃত রয়েছে। ১৯৯৭ সালে দিঘাপতিয়া রাজবংশের সর্বশেষ উত্তরাধিকারী ভারতে বসবাসকারী বিমলেন্দুনাথ পূর্বপুরুষের জমিদারী দেখতে দিঘাপতিয়া আসেন। সেসময় উত্তরা গণভবনে এসে মূল নকশার বাইরে স্থাপিত গম্বুজ দেখেন এবং তা অপসারণের অনুরোধ করলেও তা রাখা হয়নি। গণভবনের মূল নকশার অবিকৃত রাখার ব্যাপারে রাজ আপত্তি মানা না হলেও কতিপয় ব্যক্তিকে লাভবান করার স্বার্থে প্রশাসন শতাব্দীপ্রাচীন এ স্থাপনায় অবকাঠামো নির্মাণ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নাটোরে ভালো হোটেল, মোটেল না থাকার সংকটকে পুঁজি করে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর চাহিদায় প্রভাবিত হয়ে নাটোরের ঐতিহ্যকে পাল্লায় তোলা হচ্ছে বলে মন্তব্য অনেকের।

দিঘাপতিয়া রাজার কর্মচারী নঈমুদ্দীনের চতুর্থ বংশধর শহিদউদ্দিন আক্ষেপ করে বিটিসি নিউজকে বলেন, ‘তিনপুরুষ ধরে তারা দিঘাপতিয়া রাজ ঐতিহ্যের স্বাক্ষী। জৌলুসের সেই রাজবাড়ীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে সম্প্রতি উত্তরা গণভবনকে উন্মুক্ত করে। আর এখন গণভবনকে টার্গেট করে ব্যবসা করলে তা ইতিহাসের ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা ভেবে এমন সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার দাবি জানাচ্ছি।’

কথাসাহিত্যিক জাকির তালুদার বলেন, উত্তরা গণভবন ব্যবসা করার জায়গা না। এখানে মানুষ আছে ইতিহাসের সংস্পর্শ পেতে। গণভবনকে ব্যবসা কেন্দ্র বানিয়ে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করলে নাটোরের মানুষ এমনকি দেশবাসী বসে থাকবে না।

বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী এম আসলাম লিটন বলেন, আমারা অবশ্যই ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের পক্ষে। তবে সংস্কারের নামে ইতিহাস-ঐতিহ্যের নান্দনিকতা ও ঐতিহাসিক গুরুত্বকে বিকৃত করা বা পরিবর্তন করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবেনা। এসব বিবেচনায় রেখে সংস্কার করা হোক।

জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রসাদ কুমার তালুকদার বাচ্চা বিটিসি নিউজকে বলেন, উত্তরা গণভবন নাটোরবাসীর ভাবনা ও গর্বের জায়গা। তাছাড়া দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন কোন পর্যটনকেন্দ্র হতে পারে না। ইতিহাসের অংশ এই শতাব্দীপ্রাচীন অবকাঠামোকে এক ইঞ্চি পরিবর্তন করলেও ইতিহাসকেই বিকৃত করতে হবে। আমরা এটি হতে দেবো না।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট সুশান্ত কুমার ঘোষ বিটিসি নিউজকে বলেন, রাজ-রাজণ্যের ইতিহাসবেষ্টিত উত্তরা গণভবন সংস্কার হতে পারে তবে তা অবশ্যই ঐতিহাসিক গুরুত্ব অক্ষুন্ন রেখে। এর বাইরে ন্যুনতম পরিবর্তন সাধিত হওয়া মানে মূল চেতনা থেকে দূরে সরে আসা। একজন আইনজীবী হিসেবে এমন বিকৃতি ঠেকাতে প্রয়োজনে আইনজীবী নেতাদের প্রতিবাদের কর্মসূচী দিতে আমরা অনুরোধ করবো।

জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোর্ত্তোজা আলী বাবলু বিটিসি নিউজকে বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন, এটা ভুলে যাওয়া চলবে না। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত সরকারের কাছে উত্তরা গণভবন গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরা গণভবন যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন সেটি মাথায় রেখেই নাটোরবাসীর আবেগকে সম্মান জানাতে হবে জেলা প্রশাসনের। তবে ইতিহাস বিকৃতির মতো কোন পদক্ষেপ নেয়া হলে এ ব্যাপারে দলের পক্ষ থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের নেতৃত্বে জনগণকে সাথে নিয়ে তা প্রতিহত করা হবে।

নাটোর প্রেসক্লাবেক সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট কলামিস্ট রেজাউল করিম খান বিটিসি নিউজকে বলেন, উত্তরা গণভবনের আলাদা গুরুত্ব আছে রাষ্ট্রের। তাই এখানে পর্যটন স্পট না করাই ভালো। নতুন কোন পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধি না করে শহরের অন্য কোন স্থানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে নাটোরবাসীর সুষম বিনোদন নিশ্চিত হবে। এটিকে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে।

বিশিষ্ট সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক দীলিপ কুমার দাস বিটিসি নিউজকে বলেন, পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধির নামে উত্তরা গণভবনের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উপর হাত দেয়া চলবে না। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি বিপুল পরিমাণ অর্থের। পাস হলেও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অক্ষুন্ন রেখে এবং সরকারী অর্থ স্বচ্ছতার সাথে ব্যয় করতে হবে। অন্যথায় নাটোরবাসী এটি মেনে নেবে না।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহরিয়াজ বিটিসি নিউজকে বলেন, ‘উত্তরা গণভবনে পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধির প্রকল্পটি নতুন প্রজন্মের চাহিদা বিবেচনায় প্রেরণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি পাস হলে ধাপে ধাপে অর্থ বরাদ্দ আসবে। থ্রি-ডি কর্ণার রাজা দয়ারামের কাচারীবাড়ির ভেতরে করা হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে ইতিহাস বা ঐতিহ্য ক্ষুন্ন হবে না।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নাটোর প্রতিনিধি খান মামুন।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.