উজিরপুরে ঐতিহ্যবাহী পালকী হারিয়ে গেছে

উজিরপুর প্রতিনিধি: বরিশালের উজিরপুরে বর ও কণের বহনের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বাহন পালকী আজ আর দেখা যায় না। ৪০/৪৫ বছর পূর্বে দেশে বিবাহের কাজে একমাত্র ব্যবহার হত পালকী। এ ছাড়াও পালকী যাতায়াতসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হত। এই বাহনে এক বা দুইজন যাত্রী নিয়ে পালকী ব্যবহার করা হত। এটিকে কাঁধে তুলে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যেত ৪ বা ৮জন বাহক।
সূত্রে জানা যায়, পালকী শব্দটি সংস্কৃত পল্যাঙ্ক বা পর্যস্ক থেকে উদ্ভুত হয়। পালি ভাষায় এই যানের নাম পালঙ্ক। হিন্দি ও বাংলায় এটি পালকী নামে পরিচিত। অনেক জায়গায় পালকীকে ডুলি ও শিবিকা নামকরণ করা হয়। পর্তুগিজরা এর নাম দেয় পালাঙ্কুয়িন। তবে রামায়নে পালকীর উল্লেখ রয়েছে। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এবং চতুর্দশ শতকের পর্যটক জন ম্যাগনোলি ভ্রমণের সময় পালকী ব্যবহার করতেন।
সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে এবং পরবর্তী সময়ে সেনাধ্যক্ষদের যাতায়াতের অন্যতম বাহন ছিল পালকী। আধুনিক যানবাহন আবিস্কৃত হওয়ার আগে অভিযাত শ্রেণির লোকেরা পালকীতে চড়েই যাতায়াত করত। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বিয়ে ও অন্যান্য শুভ অনুষ্ঠানে বর-কণের জন্য পালকী ব্যবহারের প্রথা চালু ছিল।
এ ছাড়াও অসুস্থ রোগিদের চিকিৎসালয়ে নেওয়ার জন্য পালকী ব্যবহার হত। পালকী বিভিন্ন আকৃতি ও ডিজাইনের হয়ে থাকে। সবচেয়ে ছোট সাধারণ পালকী ডুলি দুুইজনে ব্যবহার করে। সবচেয়ে বড় পালকী বহন করে ৪-৮ জন বাহক। পালকীর বাহকরা এর পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের জন্য বিভিন্ন কাজ করত। বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ১০/১২ দিন পূর্ব থেকেই পালকীর বাহকদের ও মালিকদের বুকিং করে রাখা হত। তবে পালকী সচরাচর তিন ধরণের হয়ে থাকে। সাধারণ পালকী, আয়না পালকী ও ময়ূরপঙ্খী পালকী। ওইসব পালকীতে কাঠের তৈরী পাখি, পুতুল ও লতাপাতা নকশা দিয়ে তৈরী হত।
রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর শিলাইদহে অবস্থানকালে তার জমিদারী কাছারী পরিদর্শনের সময় পালকী ব্যবহার করতেন। ১৯৩০ এর দশকে শহরাঞ্চলে রিক্সা প্রচলন হওয়ার পর থেকে পালকীর ব্যবহার ক্রমশ উঠে যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্রমাগত প্রসার, সড়ক ও নদীপথে মোটর ও অন্যান্য যান চলাচল এবং প্যাডেল চালিত রিক্সা জনপ্রিয় হওয়ার ফলে পালকীর ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।
এ ব্যাপারে বীর মুক্তিযোদ্ধা আঃ হালিম রাড়ী বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, ৪০/৪৫ বছর পূর্বেও আমাদের এলাকায় প্রতিটি বাড়িতে বিয়ের সময় পালকী ব্যবহার করা হত। আজ আর সেই আনন্দ নেই। তিনি আরো বলেন, রাতে বিবাহ হত ভোরবেলা পালকীতে করে বর ও কণেকে ৮জন বাহক দিয়ে দীর্ঘরাস্তা পাড়ি দিয়ে তাদেরকে নিয়ে আসা হত। সেকি আনন্দ তা আজ আর নেই। আসার পথে বাহকরা বর-কণেকে নিয়ে ছন্দে ছন্দে গান পরিবেশন করত।
এদিকে বাড়িতে কুলোতে ধান দূর্বা নিয়ে নববধুকে বরণ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত বরের মাতা ও বোনেরা। পালকীতে চড়ে বর ও কনে বাড়িতে পৌছা মাত্র ধান ও দুর্বা ছিটিয়ে তাদেরকে বরণ করত এবং বাড়ির লোকজনরা কাদামাটি ও রং ছিটিয়ে উল্লাস করত। সেই রং বেরঙের পালকী সন্ধান আর নেই। এখন কেবলমাত্র পালকী বাংলাদেশের অতীত ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে পরিচিত।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর উজিরপুর প্রতিনিধি আঃ রহিম সরদার। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.