ই-সিগারেটের ভয়ঙ্কর নেশায় আসক্ত রাজশাহীর শিক্ষার্থীরা, মরণ ব্যাধিতে আক্রান্তের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

নিজস্ব প্রতিবেদক: দিন দিন ইলেক্ট্রনিক বা ই-সিগারেটের মরণ নেশায় আসক্ত হচ্ছে রাজশাহীর কিশোর, তরুণ ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা। অনলাইন জগতের বিভিন্ন পণ্য বিক্রয়ের ওয়েবসাইটে তরুণ প্রজন্মের মনকাড়া ই-সিগারেটের বিজ্ঞাপন কিংবা বন্ধুদের খপ্পরে পড়ে মেধাবীরা এ নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে। সাধারণ সিগারেটের নেশার বিকল্প, ক্ষতি কম হওয়ার আশঙ্কা কিংবা নিজেদেরকে স্মার্ট ধূমপায়ী ভেবে তরুণ প্রজন্ম আজ এ নেশায় বেশি আসক্ত হচ্ছে বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ সিগারেটের তুলনায় ই-সিগারেটের ক্ষতির পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি। বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যেই ই-সিগারেট সেবনে তাৎক্ষণিক মৃত্যু কিংবা মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার উদাহরণ দেখা গেছে। তাই তরুণ প্রজন্মকে ই-সিগারেটের ভয়ঙ্কর থাবা থেকে রক্ষায় বাংলাদেশে ই-সিগারেট নিষিদ্ধের দাবি রাজশাহীবাসীর।

সরেজমিনে রাজশাহীর বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ইদানিং এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে ই-সিগারেটের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। মুনতাখাবা তাবাচ্ছুম হৃদী নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এক শিক্ষার্থী জানালেন তার ই-সিগারেটে আসক্তি হওয়ার কথা। হৃদী বিটিসি নিউজকে জানান, অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয়ের একটি ওয়েবসাইটে তিনি বিভিন্ন দামের ও নানা ফ্লেভারের হরেক রকমের ই-সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেখতে পান। অনলাইনেই ই-সিগারেটের বিভিন্ন ফ্লেবারের মধ্যে একটি পছন্দ করে সেটি ক্রয়ের অর্ডার করেন। দুই-তিন দিনের মধ্যে তিনি হাতে পেয়ে যান সেই ইলেক্ট্রনিক সিগারেট। তখন থেকেই ই-সিগারেটের প্রতি তার আসক্তি শুরু।

ই-সিগারেটে আসক্ত আসিফ অর্ক (ছদ্মনাম) নামে রাবির আরেক শিক্ষার্থী বিটিসি নিউজকে বলেন, ‘বিভাগের দুই বন্ধুর ই-সিগারেট সেবন করা দেখে নিজে এই নেশায় আসক্ত হই। আমি চেইন স্মোকার ছিলাম। মূলত ধূমপান ছেড়ে দেয়ার বিকল্প হিসেবে ই-সিগারেট ধরি। কিন্তু কয়েক দিনের মাথায় আমার ক্রনিক কাশি দেখা দেয়। আমি ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে ঘটনা খুলে বললে ডাক্তার আমাকে ই-সিগারেট ছাড়ার পরামর্শ দেয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী, ধূমপান ছেড়ে দিয়ে এখন আমি সুস্থ্য।’

নিলয় নামে রাজশাহী কলেজের এক শিক্ষার্থী বিটিসি নিউজকে জানান, রাজশাহীর নিউ মার্কেটের একটি দোকান থেকে ই-সিগারেট ক্রয় করে তিনি এই নেশার যাত্রা শুরু করেন। নিলয়ের ই-সিগারেট সেবন করা দেখে তার অনেক বন্ধুই এখন এই নেশায় আসক্ত বলে তিনি জানান। তারা এখন নিজের পছন্দের ফ্লেভার বাছাই করে অনলাইনে অর্ডার দেন এবং সেগুলো সেবন করেন।

শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরাই নয়; নগরীর বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ ধীরে ধীরে এ নেশায় আসক্ত হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে, নিউ মার্কেট, সাহেববাজার, লক্ষ্মীপুর, সোনাদির্ঘী মোড়ের বেশ কিছু দোকানে ই-সিগারেট বিক্রি হয় বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।

জানা গেছে, সাধারণ সিগারেটের বিকল্প হিসেবে ‘ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম’ বা ‘ইলেকট্রনিক সিগারেট’ ব্যবহার করা হয়। সিগারেটের মতই দেখতে ফাইবার বা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি এই ব্যাটারিচালিত যন্ত্রগুলির মধ্যে একটি প্রকোষ্ঠ থাকে। তার মধ্যে ভরা থাকে বিশেষ ধরনের তরল মিশ্রণ। যন্ত্রটি গরম হয়ে ওই তরলের বাষ্পীভবন ঘটায় এবং ব্যবহারকারী সেই বাষ্প টেনে নেয় ফুসফুসে, যা ধূমপানের অনুভূতি দেয়। এই পদ্ধতিকে বলে ‘ভেপিং’।

অনেকেই মনে করেন, ই-সিগারেট ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করতে সাহায্য করে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, ই-সিগারেট ধূমপান ছাড়তে সাহায্য করে এর কোনও প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে এর প্রভাব সাধারণ সিগারেটের চেয়েও ক্ষতিকারক বলে দাবি করছেন তারা।

তারা বলছেন, ই-সিগারেটের তরল মিশ্রণ (ই-লিকুইড)-এর মধ্যে থাকে প্রপেলিন গ্লাইসল, গ্লিসারিন, পলিইথিলিন গ্লাইসল, নানাবিধ ফ্লেভার এবং নিকোটিন। গরম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রাসায়নিক পদার্থগুলি থেকে সাধারণ সিগারেটের ধোঁয়ার সমপরিমাণ ফরমালডিহাইড উৎপন্ন হয়। এ ছাড়াও ই-সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে অতিসূক্ষ রাসায়নিক কণা যা ভীষণই ক্ষতিকারক। এর থেকে গলা-মুখ জ্বালা, বমিভাব এবং ক্রনিক কাশি দেখা দিতে পারে।

রাজশাহী পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাইমেনুল হক আতিক বিটিসি নিউজকে বলেন, ই-সিগারেটের প্রধান উপকরণ নিকোটিন থেকে দ্রুত আসক্তি তৈরি হয়। সিগারেট ছাড়তে চেয়ে যারা এটি ব্যবহার করেন তাদের এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা থেকে দেখা দিতে পারে ফুসফুসের বিভিন্ন অসুখ।

অর্থোপেডিক বিভাগের চিকিৎসক ডা. শফিউল আলম শুভ বিটিসি নিউজকে বলেন, সাধারণ সিগারেটের তুলনায় ই-সিগারেট বেশি ক্ষতিকারক। এটি বিভিন্ন কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি। সাধারণ সিগারেটের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ গুণ বেশি ক্ষতি করে।’

সূত্র জানায়, ইদানিং দেশের জনপ্রিয় বেশকিছু অনলাইন পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ওয়েবসাইটে ই-সিগারেটের লোভনীয় বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে দেশের তরুণ প্রজন্ম এ নেশায় আসক্ত হচ্ছে। তাই রাজশাহীর অনেকের দাবি, এসব ওয়েবসাইটে ই-সিগারেট বিক্রয় ও বিপণন বন্ধের পাশাপাশি এই ক্ষতিকর পণ্যটি নিষিদ্ধ করা হোক।

রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বিটিসি নিউজকে বলেন, ‘অনলাইনে পণ্য বিক্রয়ের ওয়েবসাইট এবং বিভিন্ন ই-সিগারেটের নিজস্ব পেইজে আজ এই ক্ষতিকর পণ্যটির বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গেছে। ফলে এই বিশেষ ধরনের নেশায় আকৃষ্ট হয়ে রাজশাহীসহ দেশের তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই সরকারকে এই মরণনেশার ভয়ঙ্কর থাবা থেকে তরুণ প্রজন্মকে বাঁচানোর কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।

রাজশাহীর উন্নয়ন সংস্থা ‘এ্যাসোসিয়েশন ফর কম্যুনিটি ডেভেলপমেন্ট-এসিডি’র তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. শাহীনুর রহমান বিটিসি নিউজকে বলেন, ‘ই-সিগারেট সেবনে সারাবিশ্বে প্রায় শতাধিক মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছে। এটি সেবনের ভয়াবহতা বিবেচনায় আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্তত ২৩টি দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে এই ই-সিগারেট। বাংলাদেশের ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনে ‘ই-সিগারেট’ বিষয়ে কিছু বলা নেই। তাই আইনে ‘ই-সিগারেট’ সম্পর্কিত ধারা সংযুক্ত করে বাংলাদেশে দ্রুত এটি নিষিদ্ধ করতে সরকারের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি।’

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি আমজাদ হোসেন শিমুল। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.

ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury ury