ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্রের তত্ত্ব কি অকার্যকর বা ব্যর্থ হয়ে গেছে

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ফিলিস্তিনের জেনিনে ইসরায়েলের ভয়াবহ সামরিক অভিযানের কয়েকদিনের মধ্যেই শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) জেরুজালেমে একটি ইহুদি প্রার্থনা স্থলে বন্দুকধারীর গুলিতে অন্তত সাতজন নিহত হয়েছেন। আর সাম্প্রতিক সময়ে দুই পক্ষের মধ্যে এমন হামলা ও সহিংসতা তীব্র আকার নেয়ায় প্রশ্ন উঠছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে যে দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্ব এসেছিলো, তার কী কোনো ভবিষ্যৎ আছে? নাকি এটি কার্যত বাতিল হয়ে গেছে?
দীর্ঘদিন ধরে চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিনের সংকট নিরসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তই ছিল দুই পক্ষের জন্য আলাদা দুইটি দেশ। আর এই দ্বি-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের তত্ত্বটি এসেছিলো ১৯৯৩ সালে অসলো শান্তি আলোচনার মাধ্যমে এবং দুই পক্ষই তাতে সম্মত হয়েছিল।
ফিলিস্তিনের জেনিনে ইসরায়েলের ভয়াবহ সামরিক অভিযানের কয়েকদিনের মধ্যেই শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) জেরুজালেমে একটি ইহুদি প্রার্থনা স্থলে বন্দুকধারীর গুলিতে অন্তত সাতজন নিহত হয়েছেন।
(শুক্রবার জেরুজালেমে একটি ইহুদি প্রার্থনা স্থলে বন্দুকধারীর গুলিতে অন্তত সাতজন নিহত হয়েছেন)
কিন্তু পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলে গেছে এবং এক সময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে বৈরি সম্পর্ক ছিলো এমন কয়েকটি মুসলিম দেশ এখন ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করেছে। আবার অসলো শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী আমেরিকা সবসময় দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বের কথা বললেও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে আনার পর ওই তত্ত্বের অপমৃত্যুই হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনদের মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ করেছিলো। যুক্তরাষ্ট্র সেদিন জেরুজালেমে তাদের দূতাবাস উদ্বোধন করছিল সেদিন গাজা পরিণত হয়েছিল এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। সেদিন গাজায় নিহত হয় ৫৮ জন, আর আহত হয় আরও প্রায় তিন হাজার। ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধের পর এক দিনে এত বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানির ঘটনা আর ঘটেনি।
কিন্তু পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলে গেছে এবং এক সময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে বৈরি সম্পর্ক ছিলো এমন কয়েকটি মুসলিম দেশ এখন ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করেছে।
( ইসরায়েলের সঙ্গে বৈরি সম্পর্ক ছিলো এমন কয়েকটি মুসলিম দেশ এখন ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করেছে)
ইসরায়েল দাবি করে, জেরুজালেমের ওপর তাদের সার্বভৌম অধিকার রয়েছে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে তারা পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয় এবং জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী বলে গণ্য করে। কিন্তু অনেক দেশই একে স্বীকৃতি দেয়নি। অন্যদিকে ফিলিস্তিনরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী হিসেবে চায়।
কিন্তু আমেরিকা জেরুজালেমে দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার পর কার্যত ফিলিস্তিনদের দাবি গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের মূলে একটি বড় আঘাতই করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ইসরায়েল দাবি করে, জেরুজালেমের ওপর তাদের সার্বভৌম অধিকার রয়েছে।
(ইসরায়েল দাবি করে, জেরুজালেমের ওপর তাদের সার্বভৌম অধিকার রয়েছে)
ইস্তাম্বুল ভিত্তিক বিশ্লেষক মুরাত আসলান বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, ট্রাম্প ও তার জামাতা জ্যারেড কুশনার একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছেন। দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্ব আসলে কোনো সমাধান হয়ে উঠতেই পারেনি। কারণ এখানে এক পক্ষ ডিকটেট করে। এক পক্ষ নিয়ন্ত্রণ করলে সমাধান আসেনা। এ তত্ত্বের যেসব শর্ত আছে সেগুলোই কার্যকর হয়নি।
তার মতে, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে এখন যে সহিংসতা চলছে সেটি নিয়ন্ত্রণ এবং দীর্ঘদিনের চলে আসা সংকট নিরসনের জন্য বিশ্বাসযোগ্য কারও মধ্যস্থতায় নতুন করে আলোচনা শুরু হতে পারে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বি-রাষ্ট্র নীতির দরকার নেই বলে মন্তব্য করলেও এখনকার মার্কিন প্রশাসন বলছেন তারা দ্বি-রাষ্ট্র নীতি সমর্থন করেন।
ট্রাম্প ও তার জামাতা জ্যারেড কুশনার একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছেন।
(ট্রাম্প ও তার জামাতা জ্যারেড কুশনার একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছেন)
এর আগে হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন জানিয়েছিলেন, ইসরায়েলের স্বার্থেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। দীর্ঘদিনের সংঘাত সহিংসতার পর ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন পিএলও ও ইসরায়েল একটি শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং সেই চুক্তি অনুযায়ী তাদের একে অন্যকে স্বীকার করে নেয়ার কথা।
পিএলও সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের পথ পরিহার করে ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং শান্তির অঙ্গীকার করে। কিন্তু ইসরায়েল এই প্রতিশ্রুতি কখনোই বাস্তবায়ন করেনি। তারা বরং অধিকৃত এলাকায় ইহুদী বসতি গড়ে তোলে।
এর আগে হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন জানিয়েছিলেন, ইসরায়েলের স্বার্থেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন।
(এর আগে হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন জানিয়েছিলেন, ইসরায়েলের স্বার্থেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রয়োজ)
অন্যদিকে, ফিলিস্তিনদের আরেকটি সংগঠন হামাস কখনো এই চুক্তিকে মেনে নেয়নি। যদিও ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি শান্তি চুক্তির অধীনেই গঠিত হয়েছিল ‘প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটি’ বা ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিনি সরকার।
তবে অবাক করার মতো ব্যাপার ছিলো, ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনদের মধ্যে দ্বন্দ্বের অন্যতম উৎস জেরুজালেম হলেও, এই অসলো শান্তি চুক্তিতে জেরুজালেমের বিষয়টি আসেইনি। শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে ঘোষণা দেন, তারা আর এই চুক্তি মেনে চলতে বাধ্য নন, কারণ ইসরায়েল এই চুক্তি মেনে চলেনি।
ফিলিস্তিনদের আরেকটি সংগঠন হামাস কখনো এই চুক্তিকে মেনে নেয়নি।
(ফিলিস্তিনদের আরেকটি সংগঠন হামাস কখনো এই চুক্তিকে মেনে নেয়নি)
অবশ্য ২০১২ সালের ২৯শে নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব ভোটে পাশ হয় যাতে ফিলিস্তিনকে ‘নন মেম্বার অবজারভার স্টেট’ বা পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়া হয়। এর ফলে ফিলিস্তিনরা এখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিতর্কে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।
তারা জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠাগুলোর কাজেও অংশ নিতে পারে। অবশ্য ২০১১ সালে একটি পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিন জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের আপত্তির কারণে সেই চেষ্টা সফল হয়নি।

২০১২ সালের ২৯শে নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব ভোটে পাশ হয় যাতে ফিলিস্তিনকে 'নন মেম্বার অবজারভার স্টেট' বা পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়া হয়।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সদর দফতরের বাইরে ফিলিস্তিনি জাতীয় পতাকা উত্তোলনেরও স্বীকৃতি মেলে। কিন্তু এরপরেও জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেয়াসহ দখলকৃত এলাকাগুলোয় ইহুদি বসতি স্থাপনের প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একতরফা সমর্থনের মাধ্যমে দ্বি-রাষ্ট্র নীতির অপমৃত্যুই ঘটেছে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.