ইতিহাসের ইতিহাস


ড. মুহাম্মদ আব্দুল মুমীত: জলকুক্কুট। নদী, জলাশয় প্রভৃতি অঞ্চলে বিচরণকারী সুচালো ঠোঁট এবং ধুসর বা সাদাবর্ণের শক্তিশালী লম্বা ডানা এবং সুশোভিত লেজবিশিষ্ট বিশেষ প্রজাতির শিকারি পাখি।
হলুদাভ চষ্ণু, মাথা ও পাখায় কালো ছোপ, জোড়া পাতা দীর্ঘ পা, মসৃন পালকের মায়াবী গঠনবৈশিষ্ট্য দান করেছে এদের অনন্য রূপের মাধুর্য। বিশেষ করে ঝাঁক বেঁধে চক্কর মেরে উড়ে বেলাভূমির পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ শিকারের নান্দনিক দৃশ্য যে কারও নজর কাড়তে বাধ্য। এরা খুব মার্জিত ও সরল স্বভাবের; দৃঢ়তা বা তেজস্বিতা এদের চরিত্রে পাওয়া যায় না।
বোকা-সোকা স্বভাবের জন্য ইউরোপ ও আমেরিকায় এই পাখিগুলো কমন গাল নামে সুপরিচিত; চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে এমন নাম মানানসই মনে হলেও এর অর্থ রীতিমত চমকে দেওয়ার মতো! ইংরেজিতে “Gull” শব্দটি- ঠকানো, বোকা বানানো বা গ্রাস করে ফেলা অর্থে ব্যবহৃত হয়। সঙ্গত কারণেই এরা শিকারি হলেও নিজেরাই শিকারে পরিণত হয় অনায়াসেই।
আমাদের সমাজেও এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়; যারা প্রতিনিয়ত অন্যের শিকারে পরিণত হয় হরহামেশায়। চাকচিক্যহীন সাধারণ জীবন, সরল বিশ্বাস আর অতিরিক্ত ন্যায় বোধের কারণে এই প্রকৃতির মানুষগুলোকে শিকারে পরিণত করতে এতটুকুও বেগ পেতে হয়না ধূর্ত মানবরূপী শিকারিগুলোর। শিকারির শিকারই যেন তাদের বাঁচার শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠে শেষমেশ।
শিকার ও শিকারির মনুষ্যত্ব বর্জিত এ খেলা পৃথিবীর অতি প্রাচীন। শিকারি দানবগুলো সহজ সরল মাখলুকাতকে ঠকাতে ঠকাতে নিজেকে যখন অপ্রতিদ্ব›দ্বী ও অতি লাভজনক জীবে পরিণত করে, তখনই নড়ে-চড়ে ওঠে প্রকৃতি! এভাবেই প্রকৃতি তার অসাধারণ অপ্রকাশিত কারিশমা দিয়ে সাম্যাবস্থা বজায় রাখে সৃষ্টি জগতের। যুগ যুগ ধরে এটি-ই ইতিহাস; ইতিহাসের ইতিহাস!
শিকারিরা হয়ত অন্যের চেয়ে অনেক বেশি চালাক ও বুদ্ধিমান, কিন্তু জ্ঞানী নয় কিছুতেই। বিখ্যাত দার্শনিক আল্লামা জালালুদ্দীন রুমী তাঁর মসনবী শরীফে জ্ঞান ও বুদ্ধির চমৎকার প্রভেদ সুনিপুণভাবে চিত্রায়ণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর মতে- জ্ঞান ঐশ^রিক, অপর পক্ষে বুদ্ধি সামাজিক। জ্ঞানী ব্যক্তি বুদ্ধিমান হতে পারে কিন্তু বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে জ্ঞানী হতে হলে অনেক সাধনার প্রয়োজন হয়।
একজন জ্ঞানী ব্যক্তি তার দৈহিক ইন্দ্রিয়গুলোকে (কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ ও মাৎসর্য) যত সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষে তা কখনো সম্ভব হয় না। এই ছয়টি রিপুই শয়তানের বিশ্বস্ত অস্ত্র মানব জাতিকে পথভ্রষ্ট করার জন্য। সকলেরই জানা, শয়তান অতি চতুর এবং মহান সৃষ্টিকর্তার অনুমোদিত প্রকাশ্য শক্র।
মানুষকে বিপদগামী করতে শয়তানের আরও একটি কৌশল হলো তাদের নফস বা প্রবৃত্তিকে আয়ত্বে নেওয়া। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি যেভাবে নফসসহ এই রিপুগুলোকে বসে নিতে পারে, একজন বুদ্ধিমান ব্যাক্তির পক্ষে তা আয়ত্বে আনা সম্ভব হয় না; বরং বুদ্ধিমানেরা নফস ও রিপুর দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে প্রতিনিয়ত। তাই দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও প্রাচুর্যই তাদের মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়; ফলশ্রুতিতে তারা আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপরতার জালে আবদ্ধ হয়ে বিভৎস রকমের শিকারির রূপ ধারণ করে। সাময়িক বিচারে তারা কিছুটা লাভবান হলেও তাদের যবনিকপাত ঘটে বিভীষিকাময় পরিণতির মধ্য দিয়ে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন অতি স্বার্থপর ও ধূর্ত এ মানুষগুলোর শেষ পরিণতির সাথে প্রাসঙ্গিক একটি গল্প এক্ষেত্রে সমীচীন মনে করছি।
এক গ্রামে এক চালাক লোক বাস করত। সে যেমন বুদ্ধিমান তেমনি ধূর্তামিতেও ছিল সেরা। বিশেষ ক্ষমতা বলে সে ভবিষ্যতের বিষয়টি আগেই আঁচ করতে পারত; যেকারনে তার সাথে কেউ পেরে উঠতে পারত না। একদিন সে স্বপ্নে দেখলো তার পোষা বড় মোরগটি মারা যাবে; পরের দিন সঙ্গে সঙ্গে সে তার মোরগটি বিক্রয় করে দিল। অনেক দিন পর সে দেখল তার বড় খাসিটি মারা যাবে; তাই তাড়া-তাড়ি সে তার খাসিটি বিক্রয় করে দিল।
একইভাবে বেশ কিছু দিন পর সে স্বপ্নে দেখলো তার হালের বড় বলদটি মারা যাবে; কোন সময় না নিয়ে এবারও সে পূর্বের ন্যায় তার বলটি বিক্রয় করে নিজেকে মহা বুদ্ধিমান ভেবে আনন্দ আওরাতে লাগল। এভাবে কেটে গেল অনেকটা সময়। লোকটি নিজেকে বিপদ মুক্ত মনে করে মহা সুখে কালাতিপাত করতে লাগল। অনেক অনেক দিন পর সে স্বপ্নে দেখল তার একমাত্র ছেলেটি মারা যাবে। এবার সে পরে গেল মহাবিপদে!
মহান সৃষ্টিকর্তা এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এই প্রাণিকূল তাঁরই সৃষ্টি; বিশ^ জগতের শৃংঙ্খলা রক্ষায় প্রত্যেকের জন্য তিনিই সুনির্দ্দিষ্ট নিয়ম বা বিধান তৈরি করেছেন। শিয়াল যত চালাক প্রাণিই হোক না কেন, তার জন্য তিনি রাতকে নিরাপদ করে দিয়েছেন। শিয়াল যদি দিনের বেলায় লোকালয়ে সাহস দেখাতে আসে তাহলে সে আর আস্ত থাকবে না।
প্রতিটি জীবের জন্য এই একই নিয়ম। শুধু মানুষকে তার জ্ঞান, বুদ্ধি ও সামাজিক দায়িত্ববোধের কারণে একটু আলাদা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে; তাই বলে মানুষ প্রকৃতির নিয়মের বাইরে নয় কখনও। অন্য প্রাণির ক্ষেত্রে প্রকৃতি যতটা তৎপর, মানুষের ক্ষেত্রে একটু সময় নেয়; মানুষ যেন তার জ্ঞান দিয়ে সত্য-মিথ্যের পার্থক্য ও ন্যায়-অন্যায়ের পরিণতি অনুধাবন করে নিজেকে সুপথে টানার যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হতে পারে। এই সুযোগটাকে সৃষ্টিকর্তার দূর্বলতা মনে করা নিছক নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু নয়।
ড. মুহাম্মদ আব্দুল মুমীত, শিক্ষা কর্মী, মাউশি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.