ইউক্রেনে হেরে নিজেকে হারাতে চান না পুতিন

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে রাশিয়ার অগ্রগতি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছিল। বিশ্বের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা ছিল যে, প্রেসিডেন্ট পুতিন হয়তো চার-পাঁচ দিন, এক সপ্তাহ বা এক মাসের মধ্যে ইউক্রেন দখল করে নেবেন। কারণ এই হামলা সম্পর্কে ইউক্রেন কিংবা পশ্চিমা বিশ্বের খুব বেশি প্রস্তুতি ছিল না।
গত কিছুদিন ধরে পশ্চিমা বিশ্বের অস্ত্র এবং আর্থিক সহায়তায় আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সৈন্যরা। গত মাসে ৬ থেকে ৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা রাশিয়ার কাছ থেকে পুনর্দখলের দাবি করে কিয়েভ বাহিনী। কিন্তু এরই মধ্যে কিছুটা হলেও চমক দেখিয়েছেন যুদ্ধে ক্রমাগত ব্যর্থতায় সমালোচনার মুখে পড়া প্রেসিডেন্ট পুতিন।
ইউক্রেনের কতটা দখলে রাশিয়ার : মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইউক্রেনে মোট আয়তন ৬ লাখ ৩ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে রাশিয়া গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে সামরিক অভিযানের পাঁচ দিনের মধ্যে ১ লাখ ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে নিয়েছিল।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে রাশিয়ার দখলে প্রথম পাঁচ দিনের চেয়ে অন্তত তিন হাজার বর্গকিলোমিটার কম আছে। গত শুক্রবার প্রেসিডেন্ট পুতিন চারটি অঞ্চল রুশ ফেডারেশনে যুক্ত করার ঘোষণা দেন।
রুশ বাহিনীর দখলে থাকা চারটি অঞ্চলকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ায় অন্তর্গত করার সিদ্ধান্ত নেন। এই চার অঞ্চলের (লুহানস্ক, দোনেত্স্ক, দক্ষিণের জাপোরজিজিয়া এবং খেরসন) মোট আয়তন ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি। ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া (আয়তন ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার) দখল করে নিয়েছিল।
পুতিনের তড়িঘড়ির পেছনে কারণ : হঠাৎ করেই চারটি অঞ্চলে পাঁচ দিনের গণভোট এবং এতে স্বাধীনতা এবং রাশিয়ার পক্ষে যুক্ত হওয়ার রায় এসেছে। যদিও এই গণভোটকে প্রতারণা বলছে ইউক্রেন এবং পশ্চিমা বিশ্ব। ফলাফল ঘোষণার দুদিন পরই চারটি অঞ্চলকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার ঘোষণা আসে।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের এমন তাড়াহুড়োর পেছনে অবশ্যই কিছু কারণ রয়েছে। ‘তিন দিনের বিশেষ সামরিক অভিযান’ সাত মাস ধরে চলছে। রুশ সেনাবাহিনীতে হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অস্ত্র, গোলাবারুদ, সামরিক সরঞ্জাম দ্রুত কমে আসছে। অন্য দিকে পশ্চিমা মদতপুষ্ট ইউক্রেনের বাহিনী অনেক কম লোকবল ও সরঞ্জাম সত্ত্বেও রুশ সৈন্যদের কোণঠাসা করে দিচ্ছে। মরিয়া হয়ে ৩ লাখ রুশ পুরুষকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত রাশিয়ায় প্রবল সমালোচনা, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও গণহারে দেশত্যাগের কারণ হয়ে উঠেছে। কিছু একটা ‘সাফল্য’ দেখিয়ে নিজের অবস্থান শক্ত করতে এবং দেশের মানুষকে কিছুটা শান্ত করতে চান রুশ প্রেসিডেন্ট।
২০১৪ সালে ক্রিমিয়ার পর ২০২২ সালে ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণ অংশকেও রাশিয়ার ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করে সেই লক্ষ্যই পূরণ করার চেষ্টা করছেন পুতিন। এমনকি এমন পদক্ষেপকেই ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’-এর মূল লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করে সেই অভিযানের সমাপ্তিও ঘোষণা করতে পারেন তিনি। এমন জয় তুলে ধরে এক ঢিলে কয়েকটি পাখি মারতে পারেন পুতিন।
যে কারণে ইউক্রেনে হারতে চান না পুতিন : ইউক্রেনে রাশিয়া জিতলে সেটা যেমন পুতিনের জয়,  তেমনি রাশিয়া হারলেও পুতিনের হার হবে। কিন্তু কেন? এর উত্তর দিয়েছেন গ্রিগরি ইউডিন। তিনি মস্কো স্কুল অব সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক সায়েন্সের একজন সমাজবিজ্ঞানী এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভের কারণে তিনিও গ্রেফতার হয়েছিলেন। তার মতে, বেশির ভাগ রুশ নাগরিক এখনো যুদ্ধের পক্ষে। কিন্তু ইউক্রেনে পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে এসব মানুষের মতেরও পরিবর্তন হতে পারে।
কানাডার রেডিও সিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে এই অধ্যাপক বলেন, ইউক্রেনে পুতিন হেরে গেলে তার রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, রাশিয়ায় তিন ধরনের মানুষ আছে। ছোট একটা অংশ যারা যুদ্ধের পক্ষে এবং চরম জাতীয়তাবাদী। তারা যে কোনো উপায়ে দেশের জয় চান।
দ্বিতীয় ছোট একটা দল আছে যারা যুদ্ধের বিপক্ষে। তারা বিক্ষোভ করতে চাইলেও রাশিয়ায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কম হওয়ায় সেটা পুরোপুরি সম্ভব হয়ে ওঠে না। তৃতীয় একটা গ্রুপ আছে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা দেশের স্বার্থে যুদ্ধের পক্ষে। তারা সামরিক অভিযানের পক্ষে।
কিন্তু সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য যদি ভিন্ন কিছু হয় তাহলে তারা মত পরিবর্তন করতে পারেন। কারণ রাজনীতি বা যুদ্ধে তাদের কিছু যায় আসে না। তবে তারা ক্ষেপে গেলে পুতিনের জন্য বিপদ হবে। ইতিমধ্যে সেইন্ট পিটার্সবার্গের একদল কাউন্সিলর এক চিঠিতে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ উল্লেখ করে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন। এমনকি পপ তারকাও আলা পুগাচেভাও যুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট পুতিন পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারেরও হুমকি দিচ্ছেন। পুতিন কেন হঠাত্ করে এত বড় ঝুঁকি নিচ্ছেন সেই বিষয়ে লাটভিয়ার ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক লিওনিড রাগোজিন কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরায় লিখিত নিবন্ধে জানিয়েছেন, পুতিনের পররাষ্ট্রনীতি মূলত পশ্চিমাবিরোধী। কারণ রাশিয়ার বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, পশ্চিমারা কখনো রাশিয়ার কল্যাণ চায় না।
এই বিশ্বাস পুতিন খুব ভালোভাবেই নাগরিকদের মনে গেঁথে দিতে সক্ষম হয়েছেন। কারণ ৯০-র দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর সেই মত রুশ নাগরিকদের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব রেখেছে। গত মাসে শেষ সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ মারা গেলেও রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্য তো দূরের কথা সৌজন্যবশত তার মরদেহে শ্রদ্ধাও জানাননি প্রেসিডেন্ট পুতিন। কারণ গর্বাচেভ বাইরের দেশে সম্মান পেলেও রাশিয়ায় অনেকেই তাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখে।
পুতিন ক্ষমতায় আসার পরই মূলত রাশিয়ায় স্থিতিশীলতা আসে। নাগরিকরাও পুতিনকে তাই স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু ২০১১ সালে এক বিক্ষোভের পর পুতিনের শাসনকালও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ঐ সময় থেকে তিনি পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে তার বিরোধকে নিজের শাসনের বৈধ উৎস হিসেবে আরো বেশি কাজে লাগাতে শুরু করেন। গত শুক্রবার পুতিনের জাতীয়তাবাদী এবং পশ্চিমাবিরোধী বক্তব্যেই তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। লিওনিড রাগোজিনের মতে, ইউক্রেনে পরাজিত হলেই পুতিনের শাসনক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে, তেমনটি বলা যায় না।
কারণ যখন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দিকেই জনগণের নজর বেশি থাকে, তখন বিপ্লবী হয়ে ওঠার চিন্তা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে ওঠে। কোনো যুদ্ধ বিপ্লবের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলার পরিবর্তে একে আরো ম্লান করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পুতিন যে বিপজ্জনক খেলায় মেতেছেন তা থেকে তাকে জয়ই পেতে হবে। না হলে রাজনৈতিক ভবিষ্যত্টা ভালো যাবে না। তবে ইউক্রেনে জয় পেলে পুতিনের ক্ষমতা আরো দীর্ঘায়িত হবে এবং বৈধতাও পাবে।
যুদ্ধ বাড়বে না কমবে : গত মাসে উজবেকিস্তানে এসসিও সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট পুতিন দ্রুত যুদ্ধ বন্ধ করার কথা বলেছিলেন। তখনই আশা জাগে যে ইউক্রেন যুদ্ধ হয়তো থামবে। কিছু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চার অঞ্চল রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে পুতিনকে জনগণের কাছে নিজের সম্মান রক্ষা করেছেন।
এখন তার সামরিক অভিযানের লক্ষ্য এটাই ছিল উল্লেখ করে যুদ্ধ বন্ধ করার ঘোষণা দিতে পারেন। যদিও পশ্চিমারা এসব অঞ্চলকে কখনোই স্বীকৃতি দেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে সাবেক ওবামা প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য জেফারি এডমন্ডস বলেন, ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নিজের ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে। কেউ এটিকে স্বীকৃতি দেয়নি, আবার কেউ কিছু করতেও যায়নি।
লিওনিড রাগোজিন লিখেছেন, উগ্র জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা এরই মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা ও উদারনীতি গ্রহণের অভিযোগে প্রেসিডেন্ট পুতিনের ওপর খেপেছেন। তারা আবার মধ্যপন্থিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। সেক্ষেত্রে পুতিন নিজেকে পুরোপুরি নিঃসঙ্গ মনে করলে এবং নিজের রাজনৈতিক জীবন বাঁচাতে শেষ অবলম্বন হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন।
চূড়ান্ত পর্যায়ের সে সম্ভাবনাও রয়েছে। সেক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আবার এমনটাও হতে পারে, সেনা সমাবেশের মধ্য দিয়ে পুতিন তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাবেন। সেক্ষেত্রে ইউক্রেন মিনস্ক চুক্তির চেয়েও অপমানজনক শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হবে। রাশিয়ার সর্বাত্মক আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মিনস্ক চুক্তিতে রাজি হয়েছিল ইউক্রেন।
আবার পরমাণু বোমা পুতিনকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্নও করে দিতে পারে। চীন, ভারত ও তুরস্কের মতো দেশের পক্ষেও রাশিয়ার প্রতি নরম মনোভাব দেখানো কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠবে। পশ্চিমা বিশ্ব এতকাল ইউক্রেনকে যথেষ্ট মদত দিলেও সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি এড়াতে বদ্ধপরিকর থেকেছে।
পুতিনের সঙ্গে যোগাযোগও ছিন্ন করেনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। কিন্তু গত শুক্রবারের পর সেই সব হিসাব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। একাধিকবার  ইউক্রেনে জবরদখল মেনে নেওয়া পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.