ইউক্রেনের জন্য ইসরায়েলের মতো নিরাপত্তা মডেলের খোঁজে মিত্ররা

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে ইউক্রেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো মিত্ররা ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা জোরদার এবং দেশটির ভবিষ্যৎ সার্বভৌমত্বের নিশ্চিত করতে চাইছেন। এই মডেলটিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ পশ্চিমা নেতারা ইসরায়েলের বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করছেন।
গত কয়েক মাস ধরে বাখমুতে রক্তক্ষয়ী লড়াই ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মূলকেন্দ্র। কিন্তু চলতি সপ্তাহে রুশ ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপ বাখমুত পুরোপুরি দখলের দাবি করেছে। ইউক্রেনীয় সেনা কর্মকর্তারাও বলেছেন শহরটি এখন মূলত রুশদের নিয়ন্ত্রণে। যদিও একটি অংশে ইউক্রেনীয় সেনারা এখনও অবস্থান করছে। এমন অবস্থায় নতুন আরেকটি চ্যালেঞ্জ সামনে আসছে: রাশিয়ার আগ্রাসন মোকাবিলায় কীভাবে দেশটিকে রূপান্তর করা হবে।
ইসরায়েলি ধাঁচের নিরাপত্তা চুক্তির আওতায় ইউক্রেন অস্ত্র ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহের নিশ্চয়তা পাবে বলে উল্লেখ করেছেন পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদা। এই নিরাপত্তা মডেলটি ইউক্রেনের ভবিষ্যতে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হবে। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাত চলমান অবস্থায় ইউক্রেনকে জোটের সদস্য করার সম্ভাবনা খুব কম বলে মনে করেন পশ্চিমা কর্মকর্তারা।
এক সাক্ষাৎকারে দুদা বলেছেন, এই বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে চুক্তির আওতায় কেমন অস্ত্র বা প্রযুক্তি সরবরাহ করা ইউক্রেনকে তা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি। ইতোমধ্যে পোল্যান্ড কিয়েভকে সোভিয়েত আমলের মিগ-২৯ যুদ্ধবিমানসহ বেশ কিচু প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে।
চলতি সপ্তাহে জাপানে জি-৭ সম্মেলনে বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনীয় পাইলটদের মার্কিন যুদ্ধবিমান এফ-১৬ চালনা প্রশিক্ষণে সহযোগিতা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনকে মার্কিন যুদ্ধবিমান সরবরাহে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
শনিবার রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেক্সান্ডার গ্রুশকো সতর্ক করে বলেছেন, ইউক্রেনে এফ-১৬ পাঠানোর ফলে সংঘাতের তীব্রতা আরও বাড়বে।
ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার জন্য ইউক্রেনকে হয়ত বেশ কয়েক বছর অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে তার আগ পর্যন্ত দেশটির সেনাবাহিনীকে সম্ভাব্য পাল্টা আক্রমণে সহযোগিতার জন্য ইসরায়েলি ধাঁচের নিরাপত্তা মডেল একটি উপায় হতে পারে। রুশ দখলকৃত ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে এই আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর।
পশ্চিমারা যখন কিয়েভকে সামরিক সহযোগিতা জোরদার করছে, ট্যাংকসহ অত্যাধুনিক মার্কিন ও জার্মানি নির্মিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং রণক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় গোলাবারুদের সরবরাহ বাড়িয়েছে তখন একটি নিরাপত্তা চুক্তির বিষয়টি সামনে আসছে। রাশিয়া নয়, ইউক্রেন যাতে নিজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে সেজন্য এই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে পশ্চিমা সামরিক সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।
ফেব্রুয়ারিতে পোল্যান্ড সফরের সময় বাইডেন ইসরায়েলি মডেল ধারণা নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন দুদা। লিথুয়ানিয়ার রাজধানীতে জুলাই মাসে অনুষ্ঠেয় ন্যাটো সম্মেলনের এজেন্ডার অংশ হিসেবে এখন তা পশ্চিমা মিত্রদের মনোযোগ আকর্ষণ করছে। আলোচনা সম্পর্কে অবগত কর্মকর্তারা বলছেন, এই নিরাপত্তা চুক্তিটি কিয়েভ সিকিউরিটি কম্প্যাক্ট নামের প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে। আসন্ন সম্মেলনে এটি অনুমোদিত হতে পারে।
এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ইউক্রেনের মৌলিক নিরাপত্তা ইস্যু সমাধানের উপায় হিসেবে ইসরায়েলি মডেল নিয়ে আলোচনার উদ্ভব হয়েছে। স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে যে শিগগিরই ন্যাটোর সদস্যপদ পাচ্ছে না ইউক্রেন। ইসরায়েলের নিরাপত্তা মডেলের ভিত্তিতে হলেও ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা চুক্তির রূপ এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা এখনও ইউক্রেন ও মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা করছি কেমন মডেল হতে পারে।
ইসরায়েল ন্যাটোর সদস্য নয় এবং দেশটিকে সহযোগিতার জন্য কোনও চুক্তি দ্বারা বাধ্য নয় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু কয়েক দশক ধরে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইসরায়েল বিশেষ সম্পর্কের সুবিধা পেয়ে আসছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃহত্তম মার্কিন বৈদেশিক সহযোগিতা পেয়েছে দেশটি।
দেশটির জন্য মার্কিন সহেযাগিতা ১০ বছরের একটি চুক্তি দ্বারা নির্ধারিত। ২০১৯ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে ইসরায়েলকে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ওয়াশিংটন।
লক্ষ্য পুতিনকে ঠেকানো
পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়ার সঙ্গে চলমান সংঘাতের হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারে ইউক্রেনের জন্য এমন একটি চুক্তির ব্যবস্থা হলে।
এর ফলে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের জন্য মার্কিন সহযোগিতা কমে যাওয়ার যে প্রত্যাশা করছেন তা বাস্তব পরিণতি পাবে না। আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশে জনজীবনের ব্যয় বেড়েছে। যা দেশগুলোর সরকারের কপালে ভাঁজ ফেলেছে।
পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট বলেন, এখন রাশিয়াকে বুঝতে হবে ইউক্রেন নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পেয়েছে। এই নিশ্চয়তা বাস্তবায়নে সময়ের সঙ্গে বা পশ্চিমাদের শ্রান্ত হওয়াতে কমবে না। এই নিরাপত্তা চুক্তির প্রস্তাবে মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে কোনও শান্তি প্রক্রিয়া বা আলোচনার বিষয় যুক্ত করা হয়নি।
২০২১ সালে ক্রেমলিন বলেছে, ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদান হবে একটি ‘রেড লাইন’। ইউক্রেন জোটটির সদস্য হয়নি। কিন্তু এরপরও রাশিয়া দেশটিতে আক্রমণ করেছে।
ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বারবার বলে আসছেন, ইউক্রেনের লক্ষ্য হলো ক্রিমিয়াসহ ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়ার দখলকৃত সব ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করা। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। তার দাবি, এমন কিছু হলে মস্কো নিজেদের ক্লান্ত সেনাবাহিনী পুনরায় সংগঠিত করে আরও হামলা চালাবে।
যুক্তরাষ্ট্র হতে পারে নিরাপত্তার প্রধান নিশ্চয়তাদানকারী
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইসরায়েলি মডেলে নিরাপত্তা চুক্তির ধারণাটি প্রথম খসড়া আকারে হাজির করেন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের এক শীর্ষ সহযোগী আন্দ্রি ইয়ারমাক ও ন্যাটোর সাবেক মহাসচিব ফগ রাসমুসেন।
এক বিবৃতিতে আন্দ্রি ইয়ারমাক বলেছেন, ইউক্রেনের প্রয়োজন লৌহ কঠিন ও দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চয়তা। কিয়েভ ন্যাটোতে যোগদানের আগ পর্যন্ত এই নিশ্চয়তা বহাল থাকতে হবে।
বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় ও ন্যাটো কর্মকর্তা বলছেন, লিথুয়ানিয়াতে ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দেবেন জেলেনস্কি। ধারণা করা হচ্ছে, এই সম্মেলনে ইউক্রেন ন্যাটো কাউন্সিল নামের একটি কমিটি গঠন করা হতে পারে। যা ভবিষ্যতে দেশটির সদস্যপদের দরজা উন্মুক্ত রাখবে। ইউক্রেনের ক্ষমতা থাকবে কাউন্সিলের বৈঠক আহ্বান করে সহযোগিতা চাওয়ার। যা সদস্য দেশগুলো পরে সরবরাহ করবে।
ন্যাটোর সাবেক পলিসি প্রধান ফ্যাব্রিস পথিয়ের বলছেন, ইউরোপীয় ন্যাটো সদস্যদের অংশগ্রহণসহ এই নিরাপত্তা চুক্তির প্রধান নিশ্চয়তাদানকারী হবে যুক্তরাষ্ট্র।
প্যারিস ও বার্লিনসহ একাধিক ইউরোপীয় রাজধানীর কর্মকর্তারা বলছেন, নীতিগতভাবে এই পরিকল্পনার সঙ্গে তারা সম্মত। এতে একাধিক দ্বিপক্ষীয় আশ্বাস থাকবে বহুপক্ষীয় কাঠামোর আওতায়। ন্যাটো, ইউক্রেন ও অপর দেশের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা চাইছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্স হতে নিরাপত্তা নিশ্চয়তাদানকারী দেশ।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা এর আগেও রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে নিরাপত্তা নিশ্চয়তার প্রতি তাদের সম্মতির কথা প্রকাশ করেছেন। ইউক্রেনের সেনাপ্রধান জেনারেল ভ্যালেরি ঝালুঝনি বলেছিলেন, ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের পর ইউক্রেনের উচিত একটি শক্তিশালী আধুনিক সেনাবাহিনীতে রূপান্তরিত হওয়া। যাতে করে রাশিয়ার ভবিষ্যৎ আগ্রাসন প্রতিহত করা যায়।
নিজেদের নিরাপত্তা আশ্বাসের ইতিহাসের কারণে পশ্চিমাদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট বাধ্যবাধকতা প্রয়োজন বলে জোর দিচ্ছে কিয়েভ। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইউক্রেন নিজের পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ করে। ওই সময় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেশে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়া সেই চুক্তি লঙ্ঘন করে।
ন্যাটোর সাবেক মহাসচিব পথিয়ের বলছেন, চুক্তির বিস্তারিত বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে সাফল্য। সবকিছু হতে হবে গ্রহণযোগ্য। তা না হলে রাশিয়া এটিকে গুরত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে না। ফলে তা তাদেরকে ঠেকাতে পারবে না।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। গত বছর জোটের সদস্য হওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক আবেদন করেছেন জেলেনস্কি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো মিত্ররা স্পষ্ট করেছে, জোটের সদস্য হতে সময় লাগবে।
পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট দুদা বলেন, ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডে যুদ্ধ চলমান থাকায় এই মুহূর্তে ন্যাটোর সদস্য হতে পারছে না কিয়েভ, এটি মোটামুটি স্পষ্ট। এই যুদ্ধ শুরু করেছে রাশিয়া। কিন্তু একইভাবে এটিও স্পষ্ট যে, এই যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন নিজেদের সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন করছে, ন্যাটোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.