আম্ফানর ভয়াল ছোবল থেকে সুন্দরবনই রক্ষা করলো হাজার হাজার মানুষের প্রাণ, উপকূলীয় এলাকা লণ্ডভণ্ড

খুলনা ব্যুরো: সিডর-বুলবুলের মত সেই সুন্দরবনেই ছোবল মারল ‘অতি প্রবল’ ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। সুন্দরবনই রক্ষা করলো হাজার হাজার মানুষের প্রাণ।
ঘণ্টায় ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার গতির ভয়াল আম্ফান সুন্দরবনে ছোবল মারে গতকাল বুধবার (২০ মে) সন্ধ্যার দিকে। প্রবল বেগের এই ঝড়ে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটসহ উপকূলীয় এলাকা লণ্ডভণ্ড করে দেয়। বিধ্বস্ত হয় ঘরবাড়ি, ভেঙে পড়ে গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি।
উপকূলীয় জেলা খুলনায় তান্ডব চালিয়ে চলে গেছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। গতকাল বুধবার (২০ মে) সন্ধ্যা ৬ টায় শুরু হয়ে সর্বোচ্চ ১১২ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হেনেছে সুন্দরবনঘেঁষা এ জেলায়। প্রায় ৬ ঘন্টা তান্ডব চালিয়ে রাত ১২ টার দিকে খুলনা জেলাকে অতিক্রম করেছে আম্ফান।

আজ বৃহস্পতিবার (২১ মে) এ তথ্য জানিয়েছে খুলনার সিনিয়র আবহাওয়া কর্মকর্তা আমীরুল আজাদ। রাত ১০টা দিকে খুলনায় ঝড়ের গতিবেগ ছিল সব থেকে বেশি।ঝড়ের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য কাঁচা ঘরবাড়ির। ভেঙেছে গাছ, নদীর বাঁধ।

আম্ফানের প্রভাবে খুলনায় বুধবার দিনভর বৃষ্টি হয়েছিল। দুপুরে ঝড়ো হাওয়া উঠতে থাকে। বিকেল ৪ টায় প্রথম আঘাতের পর জোরালো দমকা হাওয়া বইছিল এবং নদ–নদীর পানি আছড়ে পড়ছিল বেড়িবাঁধের ওপর।

আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, গতকাল বুধবার সকাল ৬ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত প্রায় ৫৩ মিলি বৃষ্টিপাত হয়েছে খুলনা জেলায়।

আম্ফানের তান্ডবে খুলনার কয়রার ৮ টি পয়েন্ট নদীর বাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে কয়রা সদর, উত্তর বেদকাশি, দক্ষিণ বেদকাশি, মহারাজপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম তলিয়ে গেছে।

উল্লেখযোগ্য ভাবে, দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের আংটিহারা এলাকার নিরাঞ্জন ও মাজিদ গাজীর বাড়ির সামনে, ছোট আংটিহারা এলাকার বাকের গাজীর বাড়ির সামনে, গোলখালী গ্রামের তসলিম মোল্লার বাড়ির সামনে ও চরামুখা খেয়াঘাট এলাকায় বাঁধ ভেঙেছে।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিমুল কুমার সাহা বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে নদ-নদীতে পানির চাপ বেড়েছে। কয়রার দক্ষিণ বেদকাশীর গোলখালী, আংটিহাড়া, হরিণখোলায় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে।

খুলনা-৬ আসনের (কয়রা-পাইকগাছা) সংসদ সদস্য আকতারুজ্জামান বাবুও কয়রার এসব এলাকার বাঁধ ভাঙার খবর নিশ্চিত করেছেন।

ঝড়ের আঘাতে সিডর ও আইলায় বিধ্বস্ত খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকাজুড়ে লক্ষাধিকের বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের পানি বেড়ে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে বিভিন্ন এলাকার মাছের ঘের ও ফসলি জমি। এছাড়া হাজার হাজার গাছ উপড়ে পড়েছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে গোটা উপকূলীয় অঞ্চল

গতকাল বুধবার (২০ মে) সন্ধ্যায় প্রবল গতিতে খুলনাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে আম্পান। রাতভর চলে ঝড়ের তাণ্ডব। শক্তিশালী এ ঝড়ের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে উপকূলীয় গোটা এলাকা।

ঝড়ের তাণ্ডবে সন্ধ্যা থেকে খুলনায় বিদ্যুৎ বিছিন্ন রয়েছে প্রায় সব এলাকা। ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ না থাকায় শহরসহ গোটা উপকূলজুড়ে নেমে আসে অন্ধকার। পুরো ভূতুড়ে পরিবেশে ঘূর্ণিঝড় আম্পান তাণ্ডব চালায়।

শক্তিশালী আম্পান শক্তি হারিয়ে চলে গেলেও গোটা পশ্চিম উপকূলে রেখে গেছে ক্ষত চিহ্ন। সড়কে বড় বড় গাছ পড়ে থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে।

বাতাস ও পানির বেগে খুলনার কয়রা উপজেলার ১১টি জায়গায় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এতে কয়রা সদর, উত্তর বেদকাশি, দক্ষিণ বেদকাশি, মহারাজপুর ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। প্রচুর পরিমাণে গাছ পালা, কাঁচা ঘর-বাড়ি, রাস্তা ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্বাধীন সমাজকল্যাণ যুব সংস্থার সভাপতি মো. আবু সাঈদ খান  বলেন, কয়রায় ৮টি পয়েন্ট দিয়ে বাঁধ ভেঙে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। ৮টি পয়েন্ট হলো দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা এলাকার নিরাঞ্জন ও মাজিদ গাজীর বাড়ির সামনে।

দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ছোট আংটিহারা এলাকার বাকের গাজীর বাড়ির সামনে। দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের গোলখালী গ্রামের তসলিম মোল্লার বাড়ির সামনে। দক্ষিণ বেদকাশীর চরামুখা খেয়াঘাট এলাকা। উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাজী পাড়া ও কাশির হাট খোলা। কয়রা সদর ইউনিয়নের হরিণখোলা এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি লোকালয় প্রবেশ করেছে।

এতে অনেকের বসত বাড়িতে পানি উঠেছে। জোয়ার শেষে পানি নেমে যায়। কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা স্লুইচ গেটের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে।

এদিকে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে ঝড়ো হাওয়াসহ ভারী বর্ষণে ধানসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উপকূলীয় উপজেলা পর্যায়ে ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত এবং গাছপালা উপড়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজিজুল হক জোয়ার্দ্দার আজ বৃহস্পতিবার (২১ মে) বলেন, খুলনায় ২ লাখ ৭ হাজার মানুষ ৮১৪টি সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় নেন। ঘূর্ণিঝড়ে এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। অনেক ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ভেঙেছে বেড়িবাঁধ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা দুপুর নাগাদ ক্ষয়ক্ষতি তথ্য জানালে সঠিক পরিসংখ্যান জানা যাবে।

ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতক্ষীরা জেলা। ঝড়ের আঘাতে সাতক্ষীরা সদর থানার কামালনগরে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য কাঁচা ঘর-বাড়ির। ভেঙেছে গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি।

যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাঁদপুর গ্রামে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তাণ্ডবে গাছ পড়ে মা ও মেয়ে নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন- চৌগাছার চাঁদপুর গ্রামের মৃত ওয়াজেদ আলীর স্ত্রী খ্যান্ত বেগম ও তার কিশোরী মেয়ে রাবেয়া খাতুন।

আম্ফান সবচেয়ে বেশি তাণ্ডব চালিয়েছে সাতক্ষীরায়। উপকূলীয় এ জেলায় রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঝড়ের গতিবেগ ছিল ১৪৮ কিলোমিটার।

সেখানকার আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, এক ঘণ্টার বেশি সময় তীব্রগতিতে তাণ্ডব চলেছে সাতক্ষীরায়। পরে গতিবেগ কমে ১০০ কিলোমিটারে নেমে আসে।

এ সময় সাতক্ষীরা, খুলনাসহ পশ্চিম উপকূলে ৫ থেকে ৭ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস বয়ে যায়। রাত ১০টার দিকে জোয়ার শুরু হলে ১৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়। এতে প্লাবিত হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা। প্রবল ঝড়ে গাছচাপায় সাতক্ষীরা শহরে গৃহবধূ, যশোরে ঘুমন্ত অবস্থায় মা-মেয়ে, পটুয়াখালীতে শিশুসহ দু’জন, কলাপাড়ায় নৌকাডুবিতে একজন, পিরোজপুরে দেয়ালচাপায় একজন, ভোলার চরফ্যাসনে গাছচাপায় একজন, বরগুনায় একজন এবং লক্ষ্মীপুরে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর খুলনা ব্যুরো প্রধান এইচ এম আলাউদ্দিন এবং মাশরুর মুর্শেদ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.