আমাদের শিক্ষা,আমাদের মান!! রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাবি প্রতিনিধি: বিভিন্ন লেখক, কবি, সাহিত্যিক, কলামিস্ট, দার্শনিক শতশত বার লিখে গেছেন, লিখছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ নিয়ে। শহীদ শামসুজ্জোহা স্যারের রক্তভেজা মতিহারের সবুজ ক্যাম্পাস, লাল-সবুজের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে আমাদের শিক্ষাভূমিকে নিয়ে আজ একটু  অন্যস্বরে লিখতে বসেছি।

ইতিহাসের সত্যমিথ্যা লেখার জন্য ইতিহাসবিদরা রয়েছেন। আমি সেদিকেও যাব না। লেখার শিরোনাম দিয়েছি আমাদের শিক্ষা, আমাদের মান’। সাম্প্রতিক-অতীত ও বর্তমান শিক্ষা ও মান নিয়েই আলোচনা করতেই বেশি আগ্রহবোধ করি। প্রথমাংশে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা এবং পরে মান নিয়েই কথা বলি।

শিক্ষা আসলে কী? শিক্ষা হলো নীরব বিপ্লবের নাম। এ বিপ্লব ঘটে নীরবে, নিভৃতে আত্ম-চেতনার মধ্য দিয়ে, সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে। এই বিপ্লবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আজ কতদূর? কিছু কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে বলতে শঙ্কাবোধ নাই যে এই বিপ্লবের সাথে গণতন্ত্র শ্রোতধারায় পরিণত হয়েছে।

এটি একটি প্রতিষ্ঠান। পাবলিক প্রতিষ্ঠান। জনগণের প্রতিষ্ঠান। গণমানুষ যেখানে অংশ নিতে পারে সক্রিয়ভাবে সেখানেই গণতন্ত্র নিহিত। গণতন্ত্র মানে খেয়াল-খুশী মতো যা ইচ্ছা করে গেলাম, পরে যা হবার হোক- বিষয়টি এ রকম নয়। গণতন্ত্রেও আদর্শ থাকে। মতাদর্শ থাকে, সায়ত্ত্বশাসন থাকে। অর্ন্তনিহিত নির্যাস থাকে। রাষ্ট্রের যেমন থাকে, প্রতিষ্ঠানেরও আদর্শ থাকে। হোক সে পাবলিক কিংবা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। থাকে নিয়মনীতি, আইন-কানুন। এই নিয়মনীতির আদর্শের বাইরে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটিও কাজ করতে পারে না। সুতরাং গণতন্ত্রে পাবলিক থাকবে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও থাকবে। আর এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আদর্শ, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ছাড়া চলতে পারে না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ হচ্ছে জাতির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ’৭৩ এর অ্যাক্ট। জাতির এই মহানায়ক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষাকে এত বেশি সম্মান দিয়েছেন যে ১৯৭৩ সালের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্ট আজ প্রগতিশীল শিক্ষকদের আদর্শে পরিণত হয়েছে।

৭৩ এর অ্যাক্টের কাঠামো অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসেবে উপাচার্য নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৭৩ সালের ঐশ্বর্যমতি আইনের বিধিবিধান অনুযায়ী কাজ-দায়-দায়িত্বপালন করেন।

যদিও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শচ্যুত তথাকথিত প্রগতিশীল কতিপয় শিক্ষক গত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুকম্পা পাওয়ার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ১৯৭৩ এর অ্যাক্টের পরিবর্তনের যড়যন্ত্র করেছিল। অত্যন্ত লজ্জার বিষয় নয় কী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্প্রদায়ের জন্য।

অথচ সেই সেনা-সমর্থিত সরকার বিনা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান কিছু শিক্ষককে গ্রেফতার করেছিল, রিমান্ডে নিয়েছিল, মানসিক নির্যাতন করেছিল। আমি দেখেছি সেদিনের ভয়াবহতা। জেলখানা এবং আদালত প্রাঙ্গণে আমি আমার সেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের কান্না দেখেছি। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী থাকতে পারে শিক্ষক হিসেবে।

বর্তমান সরকার শিক্ষার আলোকে ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর এতদিনে নিশ্চয় বুঝতে কারো অসুবিধা নেই। এজন্য সরকার শিক্ষাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে সকল পর্যায়ে শিক্ষা সহজতর করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। যাই হোক, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে উচ্চ-শিক্ষা দেয়া হয় সেখানে শিক্ষক, গবেষক তারাই এই শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যান।

এক্ষেত্রে শিক্ষকের মেধা, শেখানোর কৌশল এসবের ওপর নির্ভর করে শিক্ষণ প্রক্রিয়ার সফলতা। এখানে বলতেই হয়, বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই অবস্থা বিরাজমান। যেমন, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে মানদণ্ড বা যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অত্যন্ত গণতান্ত্রিক। এখানে কোনো ছলচাতুরী নাই।

শিক্ষাদানের জন্য যে শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করছে তাকে আগেই আপনি আবেদনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করলে সেখানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকে না।
আমরা জিপিএ-সিজিপিএ-আর্নক্রেডিট কত কি যুক্ত করছি শিক্ষার উন্নয়নের জন্য, বিশ্বের অন্যান্য দেশে সাথে সমতা আনার জন্য। জিপিএ ৪ এর মধ্যে ৩.২৫ পেলে আমরা নির্ধারণ করেছি প্রথম বিভাগ বা প্রথম শ্রেণি। তাহলে যারা এই যোগ্যতা অর্জন করছে তাদেরকে কেন শিক্ষক হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবেন? রেজাল্ট ভিত্তিক থিসিস গ্রুপসহ ১-৭ শুধু শিক্ষক হওয়ার আবেদন করতে পারবে।

কেন এই ফরমান জারি করেছিলেন মহাময়। এই ক্যাম্পাস তাহলে জাতির জনকের দেয়া ১৯৭৩ এর অ্যাক্ট কাটাকুটি করে বঙ্গবন্ধুর বুকে আপনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে আরো একটি বুলেট মারেননি কী? কত শিক্ষকের এনওসি আটকিয়ে নীতিহীন কাজ করেছেন চেয়ারে বসে বিশেষ ক্ষমতাবলে মহামান্যের দোহায় দিয়ে! যদি বঞ্চিত করেন তাহলে সেখানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকে? থাকে না।

আবার নিজের পুত-পত্নীক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতার জিপিএ বাড়িয়ে দিয়ে চলে যাবেন কান ঢেকে, আর কিছু শুনবেন না, কানে নিবেন এটাও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। প্রথম শ্রেণি প্রাপ্তদের আগে আবেদন করার সুযোগ দিন, তারপরে তাকে যাচাই-বাছাই-আদর্শ বিবেচনায় এনে নিয়োগ দেন। মেধাবীর পরিচয়ে জিপিএর কেরামতিতে শিক্ষক হয়ে ক্লাস নিয়মিত নিবেন না, অন্যত্র বাণিজ্য করে বেড়াবেন, আপনার জিপিএর কেরামতি পোস্টার-ব্যানার ছাপিয়ে বাণিজ্য হবে- এটাকে শিক্ষকতা বলে না বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এনজিও, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এখন অনেকের মূল পরিসর। এজন্যই বলি ১৯৭৩ সালের অ্যাক্টের মর্যাদা রাখছি না। নিজ কর্মস্থলে আগে সময় না দিয়ে নানা কৌশলে ডানে-বামে উকি মারাটা ছাড়তে হবে।
অন্যদিকে শিক্ষা-দর্শনে আগে শিক্ষক হওয়ার আবেদন করার সুযোগ দিতে হবে। তারপর যাচাই-বাছাই করে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশে এই নিয়মটিই বলবৎ রয়েছে। আশা করি বর্তমান প্রশাসন পূর্বের প্রশাসনের পুত-পত্নীকে নিয়োগ জিপিএ কমিয়ে নিয়োগ দিয়েই পরের সিন্ডিকেটে জিপিএ বাড়িয়ে দেবে দেবে না। গত প্রশাসন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে পাবলিক নয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছিল। শিক্ষকদের সাথে স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ করেছে।

তারা যা করেছে তার মানে ‘আমার মেয়ে আমার, আর তোর ছেলে চোর’। রাজশাহী অঞ্চলে একটি জনপ্রিয় কথন আছে ‘বুললেই তো বুলবেহিনি বুলছে’। প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সভার ডায়াসে উঠে সুন্দর, সাবলীল উচ্চারণে জাতির জনকের জন্য মনে হয় এখন জান দিয়ে দিবে! আর ভোট বুথে ঢুকে প্রতিক্রিয়াশীলকে নীরবে-নিভৃতে-আদরে ভোট দিতেও দ্বিধা করেন না তারা।

মূল বিষয়ে ফিরে আসি, বর্তমান সরকার শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত মান উন্নয়নের জন্য ডিজিটালাইজেশন ফর ম্যাসপিপলস প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ করছে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হচ্ছে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে একটু স্বতন্ত্র-আলাদা করে দেখতে হবে আমাদের। এখানে অনলাইন লাইব্রেরি, ডিজিটাল আর্কাইভস, প্রত্যেক আবাসিক হলে ইন্টারনেট সুবিধা তো আছেই। পুরো ক্যাম্পাস এখন ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের ভেতরে আনা হয়েছে।

শিক্ষা উপকরণের অভাব তো কল্পনা করাই যায় না। উন্নত বিশ্বেও মানসম্মত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য গমণ করছেন। আবার পড়াশুনা শেষ ফিরে আসছে। বাংলাদেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে এই ফিরে আসার হার অনেক বেশি।

তারপরও আমরা নিজেদের কিছু সমালোচনা করতেই পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে দোকানপাট। সেগুলোর খাবারের মান নিয়েও প্রশ্ন অনেক। আবার শিক্ষকদের আবাসিক কোর্য়াটারগুলোর বেহাল দশা। শিক্ষকদের মধ্যে প্রায় আশি শতাংশ এই ভূতুড়ে কোয়ার্টার ছেড়ে দিয়েছে। ফলে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিমাসে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এই কোয়ার্টারগুলোর বয়স অনুযায়ী সরকার পরিত্যক্ত ঘোষণা করে নির্ধারিত ভাড়ায় শিক্ষকদের কম ভাড়ায় থাকার সুযোগ করে দিতে পারে। এখানেও থেকে গেছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বেশ কয়েক দফা কোয়ার্টারগুলোর নির্ধারিত বা সাব-স্টার্ন্ডাড ভাড়ার জন্য সরকারের গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাথে আলাপ-আলোচনা, চিঠি চালাচালী করেও কোনো সমাধান পায়নি।

এতে সকল পর্যায়ের শিক্ষকরাও হতাশ। অন্তত কুড়ি বছরের বেশি সময় থেকে শুনে আসছি কোয়ার্টারগুলো নিধার্রিত ভাড়ায় যাচ্ছে। সেই আশা এখন নিরাশার বালুচরে পরিণত হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা নতুন নয়। তবে আশার কথা বর্তমান প্রশাসন ছাত্রীদের জন্য দশতলা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক শেখ হাসিনা হল নির্মাণের সকল পরিকল্পনা প্রায় শেষ করে ফেলেছে। একই সাথে ছাত্রদের জন্য জাতীয় চারনেতার অন্যতম এএইচএম কামারুজ্জামান হল নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করে ফেলেছে যার নির্মাণ কাজ অচিরের শুরু হবে বলে আমরা জেনেছি।

এত সীমাবদ্ধতার মাঝেও প্রতিষ্ঠার যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ডায়নামিজম বা গতিশীলতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে এখানে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি হওয়ার মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। চীন, জাপান, মালেশিয়া, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ভারত নেপাল, আমেরিকা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া এ রকম অনেক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাথে সমঝোতা স্মারক সাক্ষর ও এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম চলছে।

এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সবাই উপকৃত হচ্ছে। অন্যদিকে পঞ্চাশ বছরের মহাপরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এখন বাংলাদেশের স্বতন্ত্র ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। এজন্য আমরা আশা করতেই পারি, শিক্ষার্থী-শিক্ষক, বর্তমান প্রশাসনের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তগ্রহণের মাধ্যমে নিঃশব্দ বিপ্লব শিক্ষা ও মান-মর্যাদা নিয়েই এগিয়ে যাবে।

 সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর  রাবি প্রতিনিধি মো: মুজাহিদ হোসেন।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.