আফ্রিকান নেতারা কি ইউক্রেনে শান্তি এনে দিতে পারবে?

 

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ থামানোর লক্ষ্য নিয়ে সাতটি আফ্রিকান দেশের নেতা মিলে এক শান্তি মিশন শুরু করেছেন। প্রথমে ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং পরে ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করছেন তারা – এবং এ মিশনের প্রথম পর্বে তারা একটি ট্রেনে করে পোল্যান্ড হয়ে পৌঁছেছেন কিয়েভে। প্রশ্ন এটাই, তারা এ উদ্যোগে কতটা সাফল্য পেতে পারেন?
এই প্রতিনিধিদলে আছেন দক্ষিণ আফ্রিকা, মিশর, সেনেগাল, কঙ্গো-ব্রাজাভিল, কমোরোস, জাম্বিয়া আর উগান্ডার নেতারা।
এমন এক সময় এ সফর হচ্ছে যখন ইউক্রেন সবেমাত্র তাদের বহুল-আলোচিত পাল্টা অভিযান শুরু করেছে, যার লক্ষ্য পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের যেসব ভূমি এতদিনের যুদ্ধে রুশ নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে সেগুলো পুনরুদ্ধার করা। এমন এক সময়ে এই মিশনের পক্ষে কী অর্জন করা সম্ভব – সেটা একটা প্রশ্ন।
তারা যখন ইউক্রেনে পৌঁছান, ঠিক তখনই দেশটির রাজধানী কিয়েভে বিমান হামলার সতর্ক সংকেত দিতে সাইরেন বেজে ওঠে এবং বেশ কিছু ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়।
ইউক্রেনের বিমান বাহিনী বলেছে, কৃষ্ণসাগর থেকে বেশ কয়েকটি রুশ কালিবর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। শহরের পডিলস্কি এলাকায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। পরে কিয়েভের মেয়র ভিতালি ক্লিৎস্কো টেলিগ্রামে এক বার্তায় বলেন, তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে এবং শহরের কোনো আবাসিক ভবনের ক্ষতি হয়নি।
ইউক্রেনের বিমান বাহিনী বলেছে তারা মোট ১২টি রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে।
`ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবা বলেন এসব ক্ষেপণাস্ত্র ছিল আফ্রিকার প্রতি রাশিয়ার বার্তা’ যে মি. পুতিন `আরও যুদ্ধ চান, শান্তি নয়।’
একজন কূটনীতিক ওলেক্সান্দর শেরবা এক টুইট বার্তায় বলেন, কিয়েভে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের মাধ্যমে ‘আফ্রিকান নেতাদের স্বাগত জানাচ্ছেন’ পুতিন।
কিয়েভে নামার পর আফ্রিকান নেতাদের রুশ হামলার কিছু নিদর্শন দেখানো হয়।
সিরিয়াস চেষ্টা নাকি `ফটো-অপ?’
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা গত মাসে যখন এই আফ্রিকান শান্তি মিশনের কথা ঘোষণা করেছিলেন , তখন তিনি কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বা সময়সীমার কথা বলেননি।
বরং দেখা যাচ্ছে এরকম সম্ভাব্য শান্তি-স্থাপনকারীদের ময়দানে ইতোমধ্যেই অনেক লোকের ভিড় জমে গেছে। চীন ও তুরস্কের নেতারা এবং পোপ ফ্রান্সিস – এরকম অনেকেই আছেন সেখানে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষক কিংসলে মাখুবেলা প্রশ্ন তোলেন, আফ্রিকান নেতাদের এই উদ্যোগের ‘কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দুটা কী? এটা স্পষ্ট নয়। এটা কি আফ্রিকান রাষ্ট্রপ্রধানদের একটা ফটো-অপ?’
আন্তর্জাতিক সংঘাতের ক্ষেত্রে সাধারণত আফ্রিকার নেতাদের এরকম সক্রিয়তা দেখা যায়না। সেদিক থেকে এই উদ্যোগ একটা বিরল ঘটনা। কারণ ইউক্রেন সংকটকে সাধারণত দেখা হয় রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যেকার একটা সংঘাত হিসেবে।
গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) আফ্রিকা বিষয়ক পরিচালক মুরিথি মুথিগা বলছেন, আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে ঘটনা নিয়ে এ কূটনৈতিক উদ্যোগকে তিনি স্বাগত জানান, কারণ আফ্রিকা অনেক দিন ধরেই জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আরো জোরালো ভূমিকা পাবার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে।
এই উদ্যোগের ভিত্তি স্থাপন করেছেন ব্রাজাভিল ফাউন্ডেশন নামে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান জঁ-ইভেস অলিভিয়ের। তিনি অবশ্য খুব বেশি বড় কোন লক্ষ্যের কথা বলছেন না।
তার মতে লক্ষ্যটা হচ্ছে একটা সংলাপ শুরু করা, তা ছাড়া রুশ ও ইউক্রেনীয় যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের জন্য কাজ করা।
আফ্রিকান দেশগুলোর কি সেরকম কোনো প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা আছে?
বিবিসির বিশ্লেষক অ্যারন আকিনিয়েমি বলছেন, আফ্রিকান নেতাদের এই ইউক্রেন শান্তি মিশন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন আফ্রিকান দেশগুলোর অনেকে।
সামাজিক মাধ্যমে অনেকে সংশয় প্রকাশ করছেন যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ওপর প্রভাব ফেলার মতো কোন ক্ষমতা বা সুবিধা এই নেতাদের আছে কিনা।
অন্য অনেকে বলছেন, এই সংকটের ক্ষেত্রে আফ্রিকার দেশগুলো যে অবস্থান নিয়েছে তা `অস্পষ্ট বা ধোঁয়াটে’, এবং তা এই মিশনের কোন অর্থপূর্ণ প্রভাব ফেলার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে না।
অনেকে সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন, যখন সুদানসহ আফ্রিকার নানা স্থানে সংঘাত চলছে, এবং মহাদেশ জুড়ে চলছে অর্থনৈতিক সংকট – তখন এই রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি উদ্যোগের পেছনে সম্পদ ব্যয় করাটা কতটা যৌক্তিক।
একজন উগান্ডার বিশ্লেষক অবশ্য বলেছেন, আফ্রিকার ভুমিকা ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের সমাধান সম্ভব নয়।
ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরুর পর গত বছর মার্চ মাসে জাতিসংঘের যে জরুরি অধিবেশন হয়েছিল – তাতে ৫৪টি আফ্রিকান দেশের মধ্যে ২৮টি বা ৫১% রাশিয়ার নিন্দা করে নেয়া প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিল। ১৭টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। অন্যদিকে আফ্রিকা মহাদেশের বাইরের দেশগুলোর ৮০ শতাংশেরও বেশি ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।
আফ্রিকান দেশগুলোর স্বার্থটা কী?
অলিভিয়ের আরও একটি লক্ষ্যের কথা বলছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পুরো আফ্রিকা মহাদেশ জুড়েই জীবনযাত্রার মানের ওপর গুরুতর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় আছে যা আফ্রিকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে আছে খাদ্যশস্য এবং সার। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন থেকে যে শস্য এবং রাশিয়া থেকে যে সার রপ্তানি হতো – তা ভীষণভাবে সীমিত হয়ে পড়েছে।
সারা বিশ্বেই এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে গেছে। এর জন্য সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে আফ্রিকাকে – কারণ তারা ইউক্রেনের শস্য এবং রাশিয়ার সার এ দুটিরই ওপর নির্ভরশীল ছিল।
অলিভিয়ের বলছেন, আফ্রিকান নেতারা চাইছেন রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করতে যেন তারা সেই চুক্তিটির মেয়াদ বাড়ায় – যার মাধ্যমে কৃষ্ণসাগরের ভেতর দিয়ে ইউক্রেন জাহাজে করে খাদ্যশস্য পাঠাতে পারে।
তাছাড়া এই নেতারা কিয়েভের প্রতিও আহ্বান জানাবেন যেন তারা তাদের বন্দরগুলোতে রুশ সারের যে চালান আটকে আছে – তার ওপর থেকে বিধিনিষেধ শিথিল করার একটা উপায় বের করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর মার্কিন চাপ
আফ্রিকার নেতাদের এই প্রতিনিধিদলটি তৈরি করা হয়েছে ব্যাপ্তি এবং ভারসাম্যের কথা মাথায় রেখে।
এখানে আছেন আফ্রিকার বিভিন্ন প্রান্তের দেশগুলোর নেতারা – যাদের এই সংকট সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গীও ভিন্ন।
এতে আছেন চারজন প্রেসিডেন্ট, মিশরের প্রধানমন্ত্রী, আর উগান্ডা ও কঙ্গো-ব্রাজাভিলের দু জন প্রতিনিধি।
এখানে দক্ষিণ আফ্রিকা ও উগান্ডাকে দেখা হয় রাশিয়ার প্রতি নমনীয় হিসেবে। অন্যদিকে জাম্বিয়া ও কমোরোস হচ্ছে অপেক্ষাকৃত পশ্চিমা-ঘনিষ্ঠ। মিশর, সেনেগাল ও কঙ্গো-ব্রাজাভিল মোটামুটি নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়েছে।
তবে সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু ঘটনাবলী এই উদ্যোগের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
অভিযোগ উঠেছে যে রাশিয়ার যুদ্ধে সমর্থন দিচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং এ কারণে রামাফোসার সরকার এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে আছে।
সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত অভিযোগ করেন যে দেশটি রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং কেপ টাউন বন্দরে গত ডিসেম্বর মাসে একটি রুশ জাহাজে অস্ত্র-গোলাবারুদ ভর্তি করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট রামাফোসা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এখন এ ব্যাপারে প্রিটোরিয়ার সরকারি তদন্তের ফলাফলের অপেক্ষায় আছে বাইডেন প্রশাসন। কিন্তু মার্কিন আইনপ্রণেতাদের একটি দ্বি-দলীয় গোষ্ঠী চাইছে যে হোয়াইট হাউস যেন এজন্য দক্ষিণ আফ্রিকাকে শাস্তি দেয় এবং দেশটির যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যেসব সুবিধা পায় তা পুনর্বিবেচনা করা হয়।
লন্ডনের গবেষণা সংস্থা চ্যাটহ্যাম হাউসের আফ্রিকা কর্মসূচির পরিচালক অ্যালেক্স ভাইন বলছেন, দক্ষিণ আফ্রিকাকে এখন তার নিজের কাজের একটা ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে।
তিনি বলছেন, এতকাল অনেক আফ্রিকান দেশই জোট-নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে আসছিল, এবং এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এতকাল মেনে নিয়েছিল যে এর অর্থ মস্কোকে সমর্থন করা নয়।
কিন্তু এখন তারা `প্রকৃত জোট-নিরপেক্ষতা’ চাইছে, বলেন ভাইন – `দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর চাপটা এ কারণেই, তাদের এখন প্রমাণ করতে হবে যে তারা সত্যিই জোট-নিরপেক্ষ।’
আগ্রহ দেখাচ্ছে মস্কো ও কিয়েভ উভয়েই
আফ্রিকান শান্তি উদ্যোগ এবং এই সফরের ক্ষেত্রে প্রধান চালিকাশক্তির ভূমিকা নিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট রামাফোসা।
তিনি পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন টেলিফোনে, এ ছাড়া জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টোনিও গুটেরেসকেও এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্রিফিং করেছেন।
রাশিয়া এবং ইউক্রেন এখন পর্যন্ত শান্তি আলোচনার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখায়নি, তবে তারা আফ্রিকান নেতাদের এ সফরটির ব্যাপারে আগ্রহী।
মস্কো বেশ কিছুকাল করে আফ্রিকায় তাদের প্রভাব বাড়ানোর জন্য কাজ করে চলেছে। আগামী মাসে সেন্ট পিটার্সবুর্গে একটি রাশিয়া-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনে তারা সেটার একটা নমুনা দেখাবে বলে আশা করছে।
ইউক্রেনও আফ্রিকান কূটনীতির ক্ষেত্রে জায়গা করে করে নেবার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবা এ মহাদেশে একটি সফর করে এসেছেন।
মাখুবেলা বলছেন, ইউক্রেন সম্ভবত আফ্রিকান মধ্যস্থতাকারীদের বোঝানোর চেষ্টা করবে যেন তারা সেন্ট পিটার্সবুর্গের সম্মেলনে যোগ না দেন।
তিনি বলেন, রাশিয়ানরা এটা দেখাতে চায় যে তারা বিচ্ছিন্ন নয়। কিন্তু সেন্ট পিটার্সবুর্গে আফ্রিকার রাষ্ট্রপ্রধানরা যাবেন কিনা – এটা তাদেরকে একটা দ্বিধায় ফেলে দিতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন ওই সম্মেলনটি রাশিয়ার সাথে আফ্রিকার সম্পর্কের একটা গুরুত্বপূর্ণ সূচক, কিন্তু তা আদর্শিক নয়।
ভাইনস বলছেন, আফ্রিকানরা এ ক্ষেত্রে দেনাপাওনায় বিশ্বাসী।
তার মতে, সম্প্রতি মোজাম্বিকের যে সাবেক গেরিলা যোদ্ধাদের সাথে তার কথা হয়েছে – তারা জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি নিয়েই বেশি চিন্তিত – যার কারণ `বহু দূরের একটি ইউরোপিয়ান যুদ্ধ।’
`এটা তাদের কোন যুদ্ধ নয়’ বলেন ভাইন্স। আফ্রিকান নেতাদের জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এটাকে একটা সুবিধাই বলা যায়, বলছেন মুথিগা। আসল প্রশ্ন হলো, যাদের মধ্যে এ যুদ্ধ হচ্ছে – সেই রাশিয়া ও ইউক্রেন আদৌ আলোচনার টেবিলে এসে বসবে কিনা। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.