আড়াই কি.মি সরকারী খালের দাম ৬ লাখ টাকা!, চলনবিলের প্রাণকেন্দ্র সিংড়ায় অবাধে চলছে সরকারিখাল-বিল কেনাবেচা


নাটোর প্রতিনিধি: নাটোরের সিংড়ায় চলনবিলের কৃষকদের সেচ সুবিধার জন্য বিএডিসি খননকৃত ১৫৪ কিলোমিটার খালগুলোর অধিকাংশই এখন এলাকার প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দখলে।
সরকারী খালের অধিকাংশ অংশ বেঁচে দিয়েছেন নেতারা। অবাধে সরকারি খাল-বিল কেনাবেচা করে বাঁধ দিয়ে অসময়ে শ্যালো মেশিনে খালগুলো শুকিয়ে মাছ ধরার উৎসবে নেমেছেন এক শ্রেণির মৎস্য শিকারিরা।
ফলে খাল খননের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চলনবিলের প্রায় লক্ষাধিক কৃষক। এতে উন্মুক্ত জলাশয় ও খাল-বিল শুকিয়ে মাছ শিকারে দেশীয় প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি ঘটছে পাশাপাশি বিলের জীববৈচির্ত্য নষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) পক্ষ থেকে খাল রক্ষার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে চিঠি দেওয়া হলেও আশানুরূপ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও খাল রক্ষার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (ক্ষুদ্র সেচ) সিংড়া কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ জেলায় ভ‚-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় গত তিন অর্থবছরে সরকারি অর্থায়নে চলনবিলের নাটোরের সিংড়া উপজেলা অংশে ১৫৪ কিলোমিটার খাল খনন ও পুনঃখনন করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে এসব খাল চলনবিলের পানির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। বর্ষা শেষে বিলের পানি এসব খাল দিয়ে নদীতে নেমে যায়। বিলের সব দেশি প্রজাতির মাছ আশ্রয় নেয় এসব খালে। খাল না শুকিয়ে এসব মাছ ধরার অধিকার রয়েছে সাধারণ মানুষের। খালের পানি সেচে বোরো ধানসহ চৈতালি ফসল ফলানোর সুযোগও রয়েছে। ভু-উপরিস্থ এই পানি ব্যবহার করায় ভৃগর্ভস্থ পানির চাপ হ্রাস পায়। এতে মাটির মান স্বাভাবিক থাকে।
এ সম্পর্কে বিএডিসি সিংড়া জোনের সহকারী প্রকৌশলী (ক্ষুদ্র সেচ) মানিক রতন বিটিসি নিউজকে বলেন, তাঁরা গত তিন অর্থবছরে প্রায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫৪ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন করেছেন। এতে ভৃ-উপরিস্থ পানির ব্যবহারের মাধ্যমে সেচসুবিধা সম্প্রসারিত হয়েছে। কৃষকেরা স্বল্প খরচে সেচসুবিধা পাচ্ছেন।কিন্তু প্রকল্পের এসব উদ্দেশ্য ব্যর্থ হচ্ছে স্থানীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের খাল দখলের মধ্য দিয়ে।
প্রভাবশালীরা, বিশেষ করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা এসব খাল দখল করে বাঁধ দিয়ে দিচ্ছেন। খালের পানি সেচে মাছসহ জলজ প্রাণী নিধন করছেন তাঁরা। কৃষকেরা সেচসুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। জেলে স¤প্রদায়ের লোকজন এসব খাল থেকে মাছ ধরতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে অর্থের বিনিময়ে খাল কিনে নিয়ে মাছ ধরছেন তাঁরা।
পরিস্থিতি জানিয়ে ১৪ ডিসেম্বর বিএডিসির সিংড়া জোনের সহকারী প্রকৌশলীর (ক্ষুদ্র সেচ) কার্যালয় থেকে সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও মৎস্য কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বিএডিসি গত দুই অর্থবছরে খালটির ৫ দশমিক ৯০ কিলোমিটার অংশ পুনঃখনন করেছে। ১ কোটি ৩৫ লাখ ১২ হাজার ৭ টাকা খরচে পুনঃখনন করা এই খাল সংস্থার বেহাত হয়ে গেছে। পুনঃখননের ফলে হিজলী, সাতপুকুরিয়া, নদীমারী, বোয়ালমারী, পুকুরপাড়, ষষ্ঠীবিঘা, নুরপুর, কাদোগাড়ী, ডাহিয়া, মহেশচন্দ্রপুর এবং কালীনগর বিলের পানির যে সমন্বয় হওয়ার কথা ছিল, তা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পরিকল্পনা অনুসারে এই খালের পানি দিয়ে আড়াই হাজার হেক্টর জমি বোরো মৌসুমের শুরুতে চাষাবাদ শুরু করার কথা ছিল। তবে তা সম্ভব হয়নি।
এই খালের হিজলী শ্মশান থেকে তিশিখালী মাজার হয়ে কালীনগর এলাকা পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার অংশ ডাল-বাঁশ ফেলে দখল করে নেওয়া হয়েছে। খালে পাহারা বসিয়েছেন ডাহিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সাধারণ স¤পাদক হযরত আলী।
তিনি জানান, খালের এই অংশ তিনি ৬ লাখ টাকায় ইটালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য কাজল খাঁর কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন। এখন খালটি শুকিয়ে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। খালের অপর এক কিলোমিটার অংশে দুটি শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি শুকিয়ে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ডাহিয়া গ্রামের আওয়ামী লীগের কর্মী কামাল হোসেন, হিরা আলী ও রুবেল সরদার। এই অংশ তাঁরা সাতপুকুরিয়া গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী আবদুর রাজ্জাকের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা দিয়ে কিনেছেন।
এ ছাড়া তিশিখালী ডুবাব্রিজ থেকে ডাহিয়া রাস্তার ডুবাব্রিজ পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার খাল ও পদ্দগাড়ী ভেলুয়ার বিল দখল করে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মী মজিবর সরকার ও তাঁর লোকজন।
এই খালে বানার বাঁধ দেওয়ার কাজে নিয়োজিত মেহের আলী ও খুরশেদ আলী বিটিসি নিউজকে বলেন, তাঁরা এই অংশ একটি মৎস্যজীবী সমিতির নামে ভোগদখল করেন। এখানে কাউকে কোনো টাকা দিতে হয়নি।
হুলহুলিয়া খালের শুরুতেই স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে অসময়েই বিদ্যুৎ চালিত মোটর দিয়ে পানি শুকিয়ে মাছ শিকারের ব্যবস্থা করছেন স্থানীয় আ’লীগ কর্মী আলমগীর হোসেন ও বিদ্যুৎ শেখ। এখান থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পর পর খালে আরো পাঁচটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।
খালে সেচ কাজে ব্যস্ত বিদ্যুৎ শেখ জানান, এই অংশটি তারা ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায় কিনে মাছ শিকারের ব্যবস্থা করছেন।তিনি আরো জানান, খালটি তারা আলীগ নেতা আল তৌফিক পরশের কাছ থেকে কিনেছেন।
আর এই খালের পশ্চিমাংশে সারদানগর এলাকার শেষ সীমানা পর্যন্ত খাল দখল করে মাছ শিকারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং সেখানে রাত্রি যাপনের ছাউনী ফেলেছেন আলীগ কর্মী মানিক, আজাদুল, হারিছ ও ভুলু মিয়া।
সেখানে দেখাশুনার দায়িত্বে নিয়োজিত মানিক উদ্দিন বলেন, খালের এই অংশটুকু তারা ৭৫ হাজার টাকায় আওয়ামী লীগনেতা আল তৌফিক পরশের কাছ থেকে কিনেছেন। তবে এভাবে সরকারি খালকেনা-বেচা করা ও দখল করে শুকিয়ে মাছ ধরা কি বৈধতা আছে?
এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আপনার কোনো কিছু বলা বা জানার থাকলে হুলহুলিয়ার গ্রাম চেয়ারম্যান আল তৌফিক পরশের কাছে গিয়ে জিগান।
এছাড়াও হুলহুলিয়া খালের একটি অংশ দখল করে নিয়েছেন ওই গ্রামের মাসুদ মিয়া। তিনি এই অংশটি ১ লাখ ৯২ হাজার টাকায় কিনে দখল করেছেন বলে জানা গেছে।
স্থানীয় কৃষক আব্দুল মজিদ ও গোলাম মুকুলের সাথে তারা জানান, এভাবে খাল কেনা-বেচা করায় এলাকার সাধারণ কৃষক ও কৃষির জন্য অনেক ক্ষতি হচ্ছে।সরকারি খাল বেচা-কেনার সুবাদে কৃষির ক্ষতির পাশিপাশি চলনবিলে মাছ ও অর্থ অনেকেই পকেটে তুলছেন এবং রাতারাতি আক্সগুল ফুলে কলা গাছে হচ্ছেন।
এ বিষয়ে হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় ওয়ার্ড আলীগের সভাপতি আল তৌফিক পরশ ফোনে খাল বিক্রয়ের বিষয়টি স্বীকার করে বিটিসি নিউজকে বলেন, খাল বিক্রয়ের সকল অর্থ গ্রামের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে তার নিজের কোনো লাভ বা স্বার্থ নেই। আর তার গ্রামের পাশেও তো আরো অনেক খাল এভাবে কেনা-বেচা হয়েছে। তাহলে তারা করলে দোষের কি? তবে খাল বিক্রয়ে কত টাকা পেয়েছেন এবং কিভাবে ব্যয় হয়েছে সে বিষয়ে জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
স্থানীয় কৃষক আব্দুল মজিদ বিটিসি নিউজকে বলেন, শুনেছি, খালটি কাটা হয়েছে কৃষক ও জেলেদের জন্য। কিন্তু বাস্তবে আমরা এই খালের সুবিধা ভোগ করতে পারি না। আমরা নেতাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছি।
চলনবিল জীববৈচির্ত্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বিটিসি নিউজকে বলেন, পানির স্বাভাবিক গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করছেন কতিপয় ব্যক্তি। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে অনুরোধ করেছি। প্রশাসন মাঝেমধ্যে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহাদৎ হোসেন বিটিসি নিউজকে বলেন, খালের পানি সেচে মাছ ধরা বেআইনি। এতে দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। খবর পেলে আমরা অবৈধ মাছশিকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
সিংড়ার ইউএনও মাহমুদা খাতুন বিটিসি নিউজকে জানান, খাল দখলের অভিযোগ পেয়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে খাল দখলকারীদের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেখানে আরও বেশি অভিযান চালানো হবে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নাটোর প্রতিনিধি খান মামুন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.