আজ ‘শহীদ নূর হোসেন’ দিবস

 বিনম্র শ্রদ্ধা শহীদ নূর হোসেন

বিটিসি নিউজ ডেস্ক: আজ ১০ নভেম্বর, শহীদ নূর হোসেন দিবস। ১৯৮৭ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী নূর হোসেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তিপাক’ স্লোগান বুকে পিঠে ধারণ করে শহীদ হয়েছিলেন। কবি শামসুর রাহমান নূর হোসেনের আত্মত্যাগের বর্ণনা করেছিলেন তাঁর ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতায় এভাবে-

‘সারারাত নূর হোসেনের চোখে এক ফোঁটা ঘুমও

শিশিরের মতো জমেনি, বরং তার শিরায় শিরায়

জ্বলেছে আতশবাজি সারারাত, কী এক ভীষণ

বিস্ফোরণ সারারাত জাগিয়ে রেখেছে

ওকে, ওর বুকে ঘন ঘন হরিণের লাফ,

কখনো অত্যন্ত ক্ষীপ্র জাগুয়ার তাকে

প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে জ্বলজ্বলে

চোখে খর তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে,

এতটুকু ঘুমাতে দেয়নি।

……

উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠে

রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য শ্লোগান,

বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ

শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা

নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয়

ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ

বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার

বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে’।

‘সেদিন নূর হোসেনের জীবন দান ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক মাইলফলক, বিষুভিয়াসের আগ্নেয়গিরির এক জ্বলন্ত লেলিহান শিখা, সেদিন নূর হোসেন হয়ে উঠেছিল সমগ্র বাঙালির বাংলাদেশ’।

নূর হোসেন, এক অমিত সাহসী আত্মোৎসর্গকারী প্রেরণাদায়ক যুবকের নাম। যার উদোম গায়ে লেখা ছিল— ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। স্বৈরাচারের বুলেট আলিঙ্গন করেছিল সে দ্বিধাহীনচিত্তে। সময়টা তখন এমন ছিল-বাঙালি জাতি নিষ্পেষিত হচ্ছে সামরিক শাসনের জাঁতাকলে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসনের যাত্রা শুরু হয়। কারাগারের অভ্যন্তরে জাতীয় ৪ নেতাকে রাতের অন্ধকারে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এক অভ্যুত্থান সংগঠিত করে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনালে জিয়াকে কারাবন্দী করেন খুনি মোস্তাককে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করান। কিন্তু ৬ নভেম্বর পর্যন্ত সবকিছু চলে খন্দকার মোস্তাকের নামে। ৬ নভেম্বর বিচারপতি সায়েম নতুন রাষ্ট্রপতি হন। বঙ্গভবনে জেনারেল ওসমানী, জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল শাফায়েত জামিল মোস্তাকের সাথে দেন দরবার করে বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল ফারুককে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন এম.এ. জি তাওয়াবের সহযোগিতায়। জেনারেল খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

অপরদিকে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও জাসদ পরিচালিত গুণ্ডাবাহিনী পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জেনারেল জিয়াকে বন্দী দশা থেকে মুক্ত করেন। জিয়া মুক্ত হয়ে তার দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে জাসদ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। কর্নেল তাহেরকেও এক পর্যায়ে গ্রেফতার করে। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই বিচারের নামে প্রহসন করে একজন যুদ্ধাহত (এক পা হারানো) মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। কর্নেল তাহেরের বিপ্লব জিয়ার প্রতিবিপ্লবের ও বেঈমানীর কাছে হেরে যায়।

১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে ছোট বড় ২২টি সেনা অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। জেনারেল জিয়া কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা, সেনাকর্মকর্তা ও সিপাহীকে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করে। ১৯৮২ সালের ৩০ মে জিয়া খুন হয়ে যায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে। একই সময়ে আরেকজন সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মনজুরও খুন হন জিয়া হত্যার দায়ে। এইসব ঘটনার সুবিধাভোগী হচ্ছে লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। অনেক নারকীয় ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিচারপতি সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিসমূহ সামরিক শাসন অবসানের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু জগদ্দল পাথরকে এত সহজে সরানো যায় না। সামরিক স্বৈরশাসক জিয়া খুন হয়ে যাওয়ার পর রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে চেপে বসা জগদ্দল পাথরের নব্য সংস্করণ ও ধারাবাহিকতা এরশাদের সামরিক শাসন।

১৯৮২-এর ২৪ মার্চ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্রসংগঠনগুলো ও জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১০ দলীয় ঐক্যজোট পৃথকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ১৯৮৩-এর মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এক কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শহীদ হন জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল কাঞ্চন, দীপালি সাহাসহ হাজারো সাথী, যাদের লাশ গুম করে ফেলে স্বৈরশাসক। আন্দোলনের নবতর যাত্রায় নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজ ও জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। রাজনৈতিক দলসমূহ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। পাশাপাশি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতাচ্যুত বিএনপি ৭ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। কিন্তু আন্দোলনের যাত্রাপথে ১৯৮৬-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের মধ্যে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। ৮ দল, ৫ দল ও ৭ দল এই তিনটি জোটের আবির্ভাব ঘটে। সবার লক্ষ্যই এক ও অভিন্ন। সামরিক শাসনের অবসান ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া।

সেদিন ছিল ৮ দল, ৫ দল ও ৭ দলের নৌপথ, রেলপথ ও রাজপথ অবরোধের কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি। কার্তিকের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে দলে দলে জনতা সমবেত হতে থাকে নিজ নিজ জোটের ব্যানারে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৮ দলীয় জোটের অবস্থান ছিল এখন যেখানে নূর হোসেন স্কোয়ার সেখানে। ৫ দলীয় জোটের অবস্থান ছিল হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের সামনে ও ৭ দলের অবস্থান ছিল দৈনিক বাংলা মোড়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ৮ দলীয় জোটের অবস্থানে মিলিত হলো এক দল সাহসী যুবকের খণ্ড মিছিল। ওই মিছিলটি গুলিস্তান থেকে তোপখানা মোড় পর্যন্ত বারবার প্রদক্ষিণ করছিল এবং আন্দোলনকামী জনতাকে অনুপ্রাণিত করছিল। মিছিলের অগ্রভাগে ছিল নূর হোসেন। খণ্ড মিছিলে অংশগ্রহণকারী যুবকদের উদোম গায়ে লেখা ছিল উপরোক্ত স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান। আমরা যারা সেদিন ৫ দলের ছাত্রকর্মী ছিলাম, তারাও হাউস বিল্ডিং থেকে জিরো পয়েন্ট আবার কখনো দৈনিক বাংলা পর্যন্ত সমবেত আন্দোলনকারীদের স্লোগানে প্রকম্পিত করে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করছিলাম।ততক্ষণে জননেত্রী শেখ হাসিনাও আন্দোলনস্থলে উপস্থিত হয়েছেন।

স্বৈরাচারী এরশাদের পুলিশ বাহিনী প্রথমে গুলি চালায় নূর হোসেনকে লক্ষ্য করে। পরবর্তীতে শুরু হয় জননেত্রী শেখ হাসিনা যে অস্থায়ী মঞ্চে ছিলেন সেই মঞ্চকে টার্গেট করে গুলিবর্ষণ। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। ৫ দল ও ৭ দলের অবস্থানের উপরেও পুলিশ জলকামান ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে সমবেত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু জনতার রুদ্ররোষ ঠেকানোর ক্ষমতা স্বৈরাচারের ছিল না। সেদিন নূর হোসেনের জীবন দান ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক মাইলফলক, ভিসুভিয়াসের আগ্নেয়গিরির এক জ্বলন্ত লেলিহান শিখা, সেদিন নূর হোসেন হয়ে উঠেছিল সমগ্র বাঙালির বাংলাদেশ। ক্ষুদিরাম, মাস্টার দা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ শহীদ যে পথ দেখিয়ে গেছেন সেই পথেই নূর হোসেন যুক্ত হলেন আরেক স্বাধীনচেতা আত্মোৎসর্গকারী যুবক হিসেবে। নূর হোসেনের রক্তে রঞ্জিত, অর্জিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে চলছে জঙ্গি মৌলবাদী গোষ্ঠীর উন্মত্ততা, অতিসম্প্রতি চিরায়ত বাংলা ও বাঙালির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন নষ্ট করার জন্য চলছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ, মন্দিরে আগুন, দুয়েক বছর আগে যা হয়েছিল রামুতে বৌদ্ধ বিহারে।

আজ আমরা এই দিনটিকে স্মরণ করব বাংলা এবং বাঙালির চিরায়ত বন্ধনকে কোনো অসুর শক্তি যেন ক্ষতবিক্ষত করতে না পারে এই প্রত্যাশায়। গণতন্ত্র ও উন্নয়নের যে পতাকা দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাতে উড্ডীন, তা যেন নিরাপদ থাকে। আদর্শ বিচ্যুত, আশ্রিত কিছু পরগাছা এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি একের পর এক মিলেমিশে চেষ্টা করছে এই সম্প্রীতির বন্ধনকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশকে অকার্যকর করার। কিন্তু বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে বহুদূর, সব অসাম্প্রদায়িক শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মধ্য দিয়ে তা এগিয়ে যাবে নিরন্তর। আমরা আছি, ছিলাম এবং থাকব। গণতন্ত্র এগিয়ে যাবে শোষণ মুক্তির অভীষ্ট লক্ষ্যে। নূর হোসেন তুমি ঘুমাও শান্তির পতাকাতলে।লেখা রবে ইতিহাসে নূর হোসেনের রক্তে লেখা গান, নূর হোসেনের রক্তে লেখা আন্দোলনের নাম। যে অমিত তেজ নিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছ সেই বাংলাদেশ যেন প্রতিমুহূর্তে দৃশ্যমান হয়। অমরত্ব লাভ করুক তোমার আত্মত্যাগ।#

লেখক : নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতা।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.