বিশেষ (ঢাকা) প্রতিনিধি: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৭ নভেম্বর একটি তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক। দিনটি ‘বিপ্লব ও সংহতি’ দিবস নামেই সমধিক পরিচিত।
১৯৭৫ সালের এই দিনে সিপাহি-জনতার ঐতিহাসিক ঐক্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশের নতুন পথচলা। বিগত সময়ের নানা টানাপড়েন ও সংকট পেরিয়ে নেতৃত্বে উঠে আসেন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক, স্বাধীনতার ঘোষক ও মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে নেতৃত্বদানকারী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ নতুনভাবে নির্ধারিত হয়। বিশেষত, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশ যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও বিভাজনের চরম সীমায় উপনীত, তখন ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরের ঘটনার মাধ্যমে জাতি একটি নতুন দিকনির্দেশনা লাভ করে। অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অস্থিতিশীল দেশে সিপাহি-জনতার ঐক্যের মাধ্যমে শুরু হয় রাষ্ট্রীয় পুনর্জাগরণ।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদর্শন নতুনভাবে রূপ পায়, যেখানে জাতীয় ঐক্য, স্বনির্ভরতা, গণতন্ত্র, সামগ্রিক উন্নয়ন এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম পররাষ্ট্রনীতি ছিল মূল ভিত্তি।
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণের পর একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে অগ্রসর হন। অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক ন্যায়ের মাধ্যমে তিনি দেশকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করতে চেয়েছিলেন। সেই ভাবনা থেকেই জিয়াউর রহমান ‘স্বনির্ভর বাংলাদেশ’ গঠনের লক্ষ্যে কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, প্রশাসন ও রাজনীতিতে মৌলিক সংস্কার শুরু করেন।
বলতে গেলে, জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই প্রথম বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয়। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে জন-অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তিনি ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এর মাধ্যমে তিনি জাতীয় ঐক্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেন।
তিনি প্রশাসনিক কাঠামোতে দক্ষতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার ওপর বিশেষ জোর দেন। বেসামরিক প্রশাসন ও জনপ্রশাসনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা এবং দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৭৮ সালে তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনর্বহাল করেন, যা রাজনৈতিক বহুমাত্রিকতা ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির ভিত্তি তৈরি করে। এ ছাড়া তিনি কৃষি ও শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও শ্রমবাজার সম্প্রসারণে পদক্ষেপ নেন। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীলতা লাভ করে, যা বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
রাষ্ট্রগঠনে জিয়াউর রহমানের দূরদর্শিতার অন্যতম পরিচায়ক হলো, তার ঘোষিত ১৯ দফা কর্মসূচি। এটি ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশকে তথাকথিত ‘তলাবিহীন’ ঝুড়ি থেকে অন্যতম স্বনির্ভর দেশ হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল এই ১৯ দফার। এই কর্মসূচির মাধ্যমেই দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পররাষ্ট্রনীতি পুনর্গঠনের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দফাগুলো ছিল, কৃষিবিপ্লবের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের স্বনির্ভরতা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, যেন তা দেশের অগ্রগতিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নারী ও যুব সমাজকে জাতীয় উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা, স্বাধীন ও সার্বভৌম পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের মাধ্যমে দেশকে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি।
জিয়াউর রহমান তার উনিশ দফার মধ্যে, বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন দর্শনের যে রূপরেখা প্রদান করেন, তা পরবর্তী সময় দেশের বিভিন্ন সরকার ও উন্নয়ন পরিকল্পনার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশ্ব আজ নানা সংকটের মুখোমুখি। জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য, বৈষম্য, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা সংকটসহ আরও বহু চ্যালেঞ্জ গোটা বিশ্বকে জর্জরিত করে রেখেছে। এসব সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত বৈশ্বিক পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেই জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) গ্রহণ করে।
পরবর্তী সময়, ২০১৬ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময়কে লক্ষ্য রেখে গৃহীত হয় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)। এই এসডিজির আওতায় মানবকল্যাণ ও পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৭টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, জাতিসংঘের এই টেকসই উন্নয়ন চিন্তাধারার বহু আগেই অর্থাৎ ৩৮ বছর আগেই শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন ও আত্মনির্ভরতার জন্য ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। তার এই ঘোষণায় ছিল গ্রামীণ অর্থনীতি পুনর্গঠন, কৃষি ও শিল্পোন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। নিঃসন্দেহে জিয়াউর রহমানের এই ১৯ দফাই ছিল বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের প্রাথমিক রূপরেখা। এমন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও বাস্তবমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনার ফলেই জিয়াউর রহমান পরিণত হন একজন সফল রাষ্ট্রনায়কে।
বিশেষ করে, ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পর দেশের যে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল, তা থেকে উত্তরণের পথে এই ১৯ দফা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। যুগের পর যুগ ধরে তার রাষ্ট্রদর্শন ও উন্নয়নচিন্তা এখনও বাংলাদেশের মানুষের কাছে অনুকরণীয় ও প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে। তার উন্নয়ন।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ (ঢাকা) প্রতিনিধি মো: লোকমান হোসেন পলা। #

















