অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাতা থেকে : অসীম কুমার সরকার


অসীম কুমার সরকার: বঙ্গবন্ধুকে জেনেছি পিতার মুখে, অসমাপ্ত জীবনী থেকে। বঙ্গবন্ধুকে জেনেছি রেসকোর্স ময়দানের অগ্নিঝরা ভাষণ থেকে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহাকুমার (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

বঙ্গবন্ধুর দাদার নাম ছিল শেখ আব্দুল হামিদ এবং নানার নাম ছিল শেখ আব্দুল মজিদ। পিতা ছিল শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা সাহেরা খাতুন। বঙ্গবন্ধুর পিতা সেরেস্তাদারের চাকরি করতেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, মাত্র ১২/১৩ বছর বযসী বঙ্গবন্ধুর বিবাহ হয়। ৩ বছর বয়সী চাচাতো বোন রেনুর সঙ্গে। অবশ্য বিবাহের পূর্বেই এই মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের বাবা মারা যান। মা মারা যান ৫ বছর বয়সে এবং ৭ বছর বয়সে সর্বশেষ আপন বলতে বঙ্গমাতার দাদাও মারা যান।

এর পর থেকে তিনি স্বামীর পরিবারে একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে সারাটা জীবন অতিবাহিত করেছেন। ছোট থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন চঞ্চল, দূরন্তমনা ও অসীম সাহসী। তিনি ছিলেন নিরহংকার, অনাড়ম্বর, দয়ালু ও মহানুভব। ছিলেন মানবতার এক মূর্ত প্রতীক। মানুষের দুঃখ দুর্দশায় তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠত। সারাটা জীবন তিনি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। নিজের দুঃখ কষ্টকে তুচ্ছ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য, এই মা মাটি ও মানুষের মঙ্গলের জন্য দিনের পর দিন জেল খেটেছেন। তিনি না থাকলে হয়তো কোনদিন স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম না।

পক্ষান্তরে, মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ওরফে রেনু। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী। যিনি দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে নিজেকে জীবনভর উৎসর্গ করেছেন। নিজ স্বামীকে দিনের পর দিন না, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর না পাওয়ার বেদনাকে তুচ্ছ করে নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে স্বামীর কাজে সহযোগিতা করেছেন। দেশ ও দেশের মানুষের কথা ভেবে দিনের পর দিন করেছেন নিরব অশ্রু বিসর্জন। তাঁর মত ধৈর্যশীলতা, মহানুভবতা ও দেশমাতৃকাবোধ এ পৃথিবীকে হতবাক করেছে। ধন্য বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা, ধন্য মাগো ধন্য।

আর একজনের কথা না বললেই নয়। তিনি হলেন এক আদর্শ পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা শেখ লুৎফর রহমান। একদিন তিনি তারঁ সন্তানকে(বঙ্গবন্ধুকে) বললেন- “ বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এতো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। আর একটা কথা ভেবে রেখ, ’Sincerity of purpose and honesty of purpose’ থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।” আর একদিনের কথা, গোপালগঞ্জ শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর বাবাকে বলেছিলেন, আপনার ছেলে যা আরম্ভ করছে তাতে তার জেল খাটতে হবে। তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে, তাকে এখনই বাধা দেন। তিনি বলেছিলেন, “দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাব না। জীবনটা নষ্ট নাও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দিব না।” কী বিস্ময় বাণী ! বঙ্গবন্ধুর পিতা বলে কথা।

১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী, বঙ্গবন্ধু ছিলেন কারাবন্ধী। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করার জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য, মেহনতী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দিনের পর দিন জেলে বসে অনসন ধর্মঘট করেছেন। অসমাপ্ত জীবনীতে তাঁর লেখনিতে পাই,- “২১ শে ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম। রাতে সিপাহীরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। রেডিওর খবর। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেল গেটে এসেছিল, তারা বিভিন্ন শ্লোগান দিচ্ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, রাজবন্ধীদের মুক্তি চাই আরও অনেক শ্লোগান। তার লেখনিতে আরও পাই, আমি আব্বাস উদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, “মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।”

অসমাপ্ত আত্মজীবনীর নিচের অংশটুকু পড়ে আমি বিস্মিত হয়েছি! দেশ ও মানুষের জন্য ত্যাগ, কী নিদারুণ বিস্ময়কর ত্যাগ! পাঠকের চোখের জল বাঁধ মানে না যে-!!

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর কথা,-“ আমরা বোনের বাড়িতে পৌঁছালাম, একদিন দুইদিন করে সাত দিন সেখানে রইলাম। ছেলেমেয়েদের জন্য যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবুও তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি, দয়া মায়া করে লাভ কি? দেশ ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে। আব্বা আমাকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। আর রেনুও কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল আমাকে দিতে। আমি রেনুকে বললাম, এতদিন একলা ছিলে, এখন আরও দুজন তোমার দলে বেড়েছে। আমার দ্বারা তো কোনো আর্থিক সাহায্য পাবার আশা নাই। তোমাকেই চালাতে হবে। আব্বার কাছে তো সকল সময় তুমি চাইতে পারনা, সে আমি জানি। আর আব্বাই বা কোথায় এত টাকা পাবেন? আমার টাকার বেশি দরকার নাই। শীঘ্রই গ্রেপ্তার করে ফেলবে। পালিয়ে বেড়াতে আমি পারব না । তোমাদের সাথে কবে আর দেখা হয় তার ঠিক নাই। ঢাকায় এস না। ছেলেমেয়েদের কষ্ট হবে। মেজবোনের বাসাও জায়গা খুব কম। কোন আত্মীয়দের আমার জন্য কষ্ট হয় তা আমি চাই না। চিঠি লিখ, আমিও লিখব। রাতে রওনা করে এলাম, দিনের বেলায় এলে হাচিনা কাঁদবে। কামাল তো কিছু বোঝে না। রেনু আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় নিরবে চোখের পানি ফেলছিল। আমি ওকে বুঝতে চেষ্টা করলাম না, একটা চুমা দিয়ে বিদায় দিলাম। বলবার তো আমার কিছুই ছিল না।”

বলতে পারেন? এ ত্যাগ কি শুধুই বঙ্গবন্ধুর? এমন ত্যাগ যদি শুধুই বঙ্গবন্ধুর হয়, তবে পিতা শেখ লুৎফর রহমান, মাতা সাহেরা খাতুন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য নিজ সন্তানকে দূরে রাখতে, বিপদের মুখে ঠেলে দিতে কখনো কুণ্ঠাবোধ করেননি, এ কেমন ত্যাগ! স্ত্রী রেনু নিজ স্বামীকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, রছরের পর বছর না পাওয়ার বেদনাকে তুচ্ছ করে নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে স্বামীর কাজে সহযোগিতা করেছেন, দেশ ও দেশের মানুষের কথা ভেবে দিনের পর দিন করেছেন নিরব অশ্রু বিসর্জণ। এ তাঁর কেমন ধৈর্যশীলতা, মহানুভবতা, দেশমাতৃকাবোধ। বলতে পারেন, এটাও তাঁর কেমনত্যাগ?
সবশেষে শুধু এ টুকুই বলব- মহান নেতা, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। যার ছবিতে, ভাষণে, ভাস্কর্যে জুড়ায় আমার প্রাণ।।

লেখক: অসীম কুমার সরকার, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.