অব্যবস্থাপনা আর উন্নয়ন প্রকল্পের জটেই ডুবছে খুলনা মহানগরী

ফাইল ছবি
খুলনা ব্যুরো: টানা দুই দিনের মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিতে খুলনা নগরীর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। তবে এই জলাবদ্ধতার জন্য প্রকৃতি নয়, নগর পরিকল্পনার অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করছেন নগরবাসী ও বিশেষজ্ঞরা। কারণ একটাই—যে খাল দিয়ে পানি নামার কথা, সেই খালেই বাঁধ! আর এসব বাঁধ দেওয়া হয়েছে উন্নয়নের নামে সেতু, স্লুইসগেট ও সড়ক নির্মাণের জন্য।
নগরীর লবণচরা, বান্দাবাজার, মতিয়াখালী, শিপইয়ার্ড ও টুটপাড়া এলাকার পানি নিষ্কাশন হতো লবণচরা, ক্ষেত্রখালী ও মতিয়াখালী খাল দিয়ে। কিন্তু এক বছর ধরে এসব খালের মুখে বাঁধ দিয়ে সেতু ও স্লুইসগেট নির্মাণ করছে কেডিএ-নিয়োগপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহাবুব ব্রাদার্স। খালের মুখ বন্ধ, পানি যাবে কোথায়? ফলে সোমবার রাত থেকে হওয়া বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে এই সব এলাকাগুলো।
একই অবস্থা নিরালা, প্রান্তিক আবাসিক এলাকাতেও। নিরালা খাল প্রায় এক বছর ধরে ভরাট করে সেতু নির্মাণ করছে ডিয়েন কো লিমিটেড। পাইপ দিয়ে কিছু পানি যাওয়ার চেষ্টা করলেও সেটি সামান্যই। আর বাস্তহারা ও দেয়ানা চৌধুরী খালের মুখেও বাঁধ, আড়ংঘাটা সংযোগ সড়কের নামে।
এই অবস্থা শুধু কেডিএর প্রকল্পেই নয়। কেসিসি (খুলনা সিটি কর্পোরেশন) নিজেও ড্রেন ও কালভার্ট নির্মাণে কম বাঁধ দেয়নি। শহরের গুরুত্বপূর্ণ খানজাহান আলী রোডের ৪ নম্বর ড্রেনের এক কিলোমিটারে তিনটি বাঁধ দিয়ে রেখেছে। অস্থায়ী হলেও সময়মতো অপসারণ না করায় মঙ্গলবারের ৬৩ মিলিমিটার আর বুধবারের ৪৬ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই এসব ড্রেন থেকে পানি নামেনি।
সাধারণত বৃষ্টিতে নগরীর নিচু এলাকাগুলোয় পানি জমে। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম। মোল্লাপাড়া, মহিরবাড়ি খালপাড়, মুজগুন্নী, আড়ংঘাটা, নিরালা, শিপইয়ার্ড, বান্দাবাজার—শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত একই চিত্র: হাঁটুপানি, ডুবন্ত রাস্তাঘাট, বিপাকে অফিসগামী মানুষ ও শিক্ষার্থীরা।
বুধবার নগর ভবনের জিআইজেড মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত জরুরি সভায় জলাবদ্ধতা নিরসনে তিনটি ওয়ার্ডভিত্তিক মোবাইল টিম গঠন করা হয়। এর মধ্যে ১–১৫নং ওয়ার্ডে দায়িত্বে আছেন সহকারী প্রকৌশলী ওবায়দুল্লাহ খান। ২২, ২৩, ২৯নং ওয়ার্ডে উপসহকারী প্রকৌশলী অমিত কান্তি ঘোষ। ২৭, ২৮, ৩০, ৩১নং ওয়ার্ডে উপসহকারী প্রকৌশলী শেখ নজরুল ইসলাম।
সামগ্রিক সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ মো. মাসুদ করিম ও কনজারভেন্সি অফিসার মো. ওয়াহিদুজ্জামান খান।
প্রতিটি টিমকে যন্ত্রপাতিসহ উপস্থিত থেকে বাঁধ কেটে পানি চলাচল স্বাভাবিক করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আপডেট ও সুপারিশ জানাতে বলা হয়েছে।
কেসিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কোহিনুর জাহান বিটিসি নিউজকে বলেন, “অবিকল্পিতভাবে বাঁধ দেওয়ায় পানি নামতে দেরি হচ্ছে। মতিয়াখালী ও ক্ষেত্রখালী খালে স্কেভেটর দিয়ে মাটি ও আবর্জনা সরানোর কাজ শুরু হয়েছে।”
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লস্কার তাজুল ইসলাম সরেজমিনে পরিদর্শনের পর বিটিসি নিউজকে বলেন, “জলাবদ্ধতার মূল কারণ উন্নয়নকাজের বাঁধ। পাঁচটি বাঁধ অপসারণের জন্য কেডিএ চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছি।”
প্রধান প্রকৌশলী মশিউজ্জামান খান বিটিসি নিউজকে জানান, “আমরা কেসিসির তৈরি বাঁধগুলো অপসারণ করছি। ভারী বৃষ্টি হলে মোবাইল টিমগুলো মাঠে নামবে।”
খুলনার নাগরিকদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। “উন্নয়ন করতে গিয়ে যদি আমরা পানিতে ডুবে থাকি, তাহলে এই উন্নয়নের মূল্য কী?”—প্রশ্ন তুলেছেন নিরালা এলাকার বাসিন্দা ও শিক্ষক মো. হাফিজুর রহমান।
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, উন্নয়ন মানেই কাটা-ধরা নয়, বরং বিকল্প পথ রেখে এবং পরিবেশ বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হয়। খুলনা যেন সেই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর খুলনা ব্যুরো প্রধান মাশরুর মুর্শেদ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.