টাঙ্গাইল প্রতিনিধি: রহমান উজ্জ্বল: ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এমন কিছু শাসক বা শাসক শাসকগোষ্ঠীর আগমন ঘটে, যাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব বা শাসন দন্ডটা অনেক ভারী হয়। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিশ্চিতভাবে এরকম একটি ভারি শাসন দন্ড বহন করা সরকার। এটা একদিকে যেমন তাদের জন্য সৌভাগ্যের অন্যদিকে দুর্ভাগ্যেরও হতে পারে। এদেশের এক মহাক্রান্তিকালে তারা দেশের শাসন দন্ড নিজেদের কাঁধে নিয়েছেন। এখানে সফল হলে ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস এবং তার সরকারের অনেকেই এ ভূখণ্ডের ইতিহাসে একেকজন কিংবদন্তিতে পরিণত হবেন। চিরদিন পূজনীয় থাকবেন। আর কোনো কারণে ব্যর্থ হলে তার উল্টোটাই ঘটবে। ঘৃণিত মীর জাফর, জগৎ শেঠদের মতো বিবেচিত হবেন তারা।
দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে একটি গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি। দুই মাসের মত হয়েছে এই সরকার শপথ নিয়েছে ।এখনো পুরোপুরি মূল্যায়ন করার সময় হয়নি তাদের। কিন্তু বিগত দুই মাসে তাদের কথাবার্তা বা কাজকর্ম দেখে বর্তমান সরকারকে পুরোপুরি সফল বলা যাবে না। দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সার্বিক আইন শৃংখলারও খুব বেশি উন্নতি দৃশ্যমান নয়।
কিন্ত দেশের এই ক্রান্তিকালে কারো কারো মধ্যে যেন একটু বেশি উৎসাহ বা তাড়াহুড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হঠাৎ করেই কেউ কেউ বিপ্লবী বা অতি বিপ্লবী হয়ে গেছে। যারা বিগত ১৬-১৭ টি বছর একটু কাশি দিতেও হিসাব করত – তারাও এখন ইচ্ছে হলেই আন্দোলন করছে। দেশ নিয়ে চিন্তা করছে না কেউ। আমরা যে চরম একটা বাজে সময় অতিক্রম করছি- এটা নিয়ে কেউ ভাবছে না। সবার মধ্যে একটা আমি বা আমরা ভাব চলে আসছে।
অথচ চারপাশে এখনো রক্তের দাগ শুকায়নি। নিহতদের কবরের মাটি শুকায়নি। আহতদের আর্ত চিৎকার বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে চারপাশে এখনো পরিবেশটা গুমোট ভারী হয়ে আছে। কান পাতলেই কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়।
আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, আমরা যারা কথা বলছি, তারা এই আন্দোলনের মূল স্টেক হোল্ডার নই ।আন্দোলনের মূল স্টেক হোল্ডার হলো, আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকারের পোষা বাহিনীর গুলিতে নিহত ও আহতরা এবং তাদের পরিবারগুলো ।আমরা হলাম বেনিফিশিয়ারি। আমরা হয়তো আন্দোলনে গেছি ,আন্দোলন করেছি কিন্তু কোন ক্ষতি হয় নাই। রক্ত ঝরে নাই। কিন্তু অর্জিত স্বাধীনতাটা উপভোগ করছি। মুক্ত দেশে স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছি।
স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তার পোষা বাহিনীর দ্বারা বাংলাদেশে একটা জেনোসাইড হয়েছে। প্রায় ৩৩ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। কেউ হাত -পা হারিয়েছে। কেউ চোখ হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়েছে। অনেকে আর্থিকভাবে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের ত্যাগের বিনিময়েই আমি আপনি নতুন করে বাংলাদেশের রং দেখতে পাচ্ছি। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। সংকোচহীন পথে-ঘাটে চলাফেরা করতে পারছি।
আমি মনে করি, প্রথম বাকশালী শাসন ব্যবস্থার চেয়েও দ্বিতীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থা ছিল আরো বেশি ভয়ংকর এবং দেশ বিরোধী। বিগত ১৬-১৭ টি বছর যাবত দেশের মানুষের কণ্ঠরোধ ও মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে অনেকটা খোলামেলা ও নিষ্ঠুরভাবে। অবৈধ ফ্যাসিজম টিকিয়ে রাখতে, দেশি-বিদেশি চক্রান্তে হাসিনা দেশের প্রতিটি বাহিনী ও সংস্থাকে নপুংসক লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করেছিল। হাসিনা তার অবৈধ ক্ষমতা ও দুর্নীতিকে পাকাপোক্ত করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসন ও সমাজের সর্বস্তরেই ঘুষ -দুর্নীতিকে অনেকটা হালাল করে দিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে দেশ থেকে পাচার হতে থাকে হাজার হাজার কোটি টাকা। দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করে বিদেশের ব্যাঙ্কগুলো ভরে ফেলে শেখ পরিবার ও তাদের ঘনিষ্ঠ সাহায্যকারীরা। ইউরোপ-আমেরিকায় গড়ে ওঠে বেগম পাড়ার মতো আবাসস্থল।
দ্বিতীয় বাকশালী আমলে শেখ পরিবার তাদের ফ্যাসিজম সুসংহত করতে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দেশের নাগরিকদের উপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছে। শেখ হাসিনা বিগত ১৬ বছর বেশ কয়েকটি গণহত্যার মত মধ্যযুগীয় বর্বরতা চালিয়েও পার পেয়ে গেছে তার পোষা বাহিনী ও বিদেশী প্রভুর অন্ধ সমর্থনে। হাজার হাজার বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হয় এ সময়টাতে। দেশের নাগরিকদের ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল বিচারালয়কে ব্যবহার করে লক্ষ্য লক্ষ্য বিরোধী মতের মানুষের নামে লক্ষ লক্ষ মামলা দিয়ে তাদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখা হয়। একদিকে ঘরছাড়া এই মানুষগুলোর পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া যাওয়ার আর কোনো জায়গা ছিল না। আর অন্যদিকে শেখ হাসিনা ও তার দোসরা হয়ে ওঠে এক একটি ছোট বড় সাইক্লোপ।
বাংলাদেশের ২০২৪- এর গণ অভ্যুত্থান দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের রাগ ক্ষোভ এবং হতাশারই বহিঃপ্রকাশ। বহুদিনের দমন- পীড়ন, গুম- হত্যা, মামলা -হামলা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ঘুষ -দুর্নীতি ,কথা না বলতে পারার অক্ষমতা, দ্রব্যমূলের ঊর্ধগতি, বিবর্ণ স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্ব,গণতন্ত্রহীনতা, অবারিত মিথ্যাচার- সবকিছু মিলিয়ে এদেশের মানুষের মনে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ তথা সরকারের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ও ঘৃণা আগ্নেয়গিরির রূপ ধারণ করে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনতা মাঠে নামার এবং টিকে থাকার যুতসই উপলক্ষ খুঁজে পায়। ছাত্রদের পাশাপাশি চারদিক থেকে লক্ষ লক্ষ গণমানুষ এই আন্দোলনে মিশে শরীক হতে থাকে। শহীদ আবু সাঈদ ও শহীদ ওয়াসিমের হত্যার পর সর্বহারা ছাত্র- জনতা যেন আরো বেশি একরোখা হয়ে তাতিয়ে উঠে। পর্যায়ক্রমে ৯ দফা পরিণত হয় এক দফায়। বাঁশের লাঠি ও গাছের ডাল নিয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে যায় প্রশিক্ষিত বাহিনীগুলোর আধুনিক অস্ত্রের বিপক্ষে। তাসের ঘরের মতো ভেসে যায় হাসিনা সরকারের লেজুরবৃত্তি করা বাহিনীগুলো। যার অনিবার্য পরিনিতি স্বরুপ শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও হাসিনার বিদেশে পলায়ন। বহু রক্তের বিনিময়ে এই ভূখণ্ডে ঘটে যায় আরো একটি গণঅভ্যুত্থান।
আমি পূর্বেই বলেছি ,২০২৪ এর এই বিপ্লবের মূল স্টেক হোল্ডার হলো আন্দোলনে নিহত ,আহত মানুষগুলো ও তাদের পরিবার। অন্ধ হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর কষ্ট , হাত-পা হারানো মানুষগুলোর কষ্ট , সন্তান হারানো মানুষগুলোর কষ্ট -আমরা বেনিফিশিয়ারিরা কখনোই বুঝতে পারব না। এখনো শহীদের কবরের মাটি শুকায়নি। এখনো আহতরা হাসপাতালে কাতড়াচ্ছে। অথচ আমি ,আমরা আমাদের বিষয়টা এখনই সমালোচিত হচ্ছে। বারবার ইতিহাস ভুলে যাওয়া জাতি হিসেবে খুব দ্রুতই হয়ত আমরা ভুলে যাব -নিজেকে বিসর্জন দেয়া মানুষগুলোর কথা। অথচ কথা ছিল অন্যরকম। কথা ছিল বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার।
শুরুতে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন ছিল ছাত্র সমাজের একটা নিজস্ব আন্দোলন। অন্যায্য কোটা বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল ছাত্র সমাজ। তারা এটা করেছিল মূলত ভবিষ্যতে একটা ভালো চাকরির জন্য। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর যখন সরকারের পেটোয়া বাহিনী, ছাত্রলীগ,যুবলীগ -ব্যাপক নির্যাতন করে রক্তপাত ঘটায় তখনই গর্জে উঠে ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক থেকে শুরু করে দেশের সচেতন মহল, এমনকি রিকশাচালক, কৃষক ,শ্রমিক এমনকি ঘরের গৃহিণীরা পর্যন্ত। এখানে অবশ্যই বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে মাদ্রাসার ছাত্র, আলেম-ওলামা ও বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কথা। জনগণের দাবি আর ছাত্রদের দাবি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ৯ দফা হয়ে যায় এক দফা।
জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে ছাত্র- জনতার আন্দোলনে প্রচন্ড রুদ্র রূপ ধারণ করে। আন্দোলনের শুরু থেকে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলো সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের সাথে মিশে ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত সময়ে এসে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলোকে নির্দেশ দেয়, যে কোন মূল্যে ছাত্রদের মনোবল জাগিয়ে রাখার। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা যাতে আক্রমণের শিকার না হয় -এ বিষয়টাও খেয়াল রাখতে বলা হয়। পাশাপাশি দলীয় স্লোগান, ব্যানার, ফেস্টুন -এগুলো ব্যবহার করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়। আপাতত সফল একটি বিপ্লবের বিজয়ে পিনাকী ভট্টাচার্য, ইলিয়াস হোসেন, ডাক্তার জাহেদ, শাহেদ আলম রওনক হাসানসহ বেশ কিছু অ্যাক্টিভেস্টের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তারা তাদের বিভিন্ন লেখা ও ভিডিও দ্বারা অসাধারণভাবে ছাত্র -ছাত্রী ও সংগঠনগুলিকে আন্দোলনের পক্ষে মোবিলাইজ করেছিলেন। এ আন্দোলনে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করতে হবে আমাদের প্রবাসী ভাই- বোন রেমিটেন্স যোদ্ধাদের কথা। সময়মতো রেমিটেন্স পাঠানো বন্ধ করে ফ্যাসিস্ট সরকারকে কঠিন অর্থনৈতিক চাপে ফেলে দিয়েছিল তারা। যা সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করে।
আন্দোলনের মুহূর্তে খুব কাছ থেকে দেখেছি, একটি ছাত্র আন্দোলন কিভাবে একটি গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। শেষ পর্যন্ত এখানে আর কোন বিভেদ ছিল না। কোন ধর্ম -বর্ণ ,গোষ্ঠীর আন্দোলন ছিল না। বরং তা হয়ে উঠেছিল সার্বজনীন। সমাজের সব শ্রেণীর, সব ধর্মের, সব বয়সের নারী -পুরুষ ধীরে ধীরে সম্পৃক্ত হয়েছিল এই আন্দোলনে। গড়ে উঠেছিল এক অদৃশ্য আত্মীয়তার বন্ধন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রথম দিকে এদেশের মানুষের মনে উচ্ছাস আর আশার আলো খেলা করেছিল ।কিন্তু মানুষ ধীরে ধীরে হতাশ হতে থাকে স্বৈরাচারের রেখে যাওয়া আমলা ও তাদের দোসরদের দিয়ে দেশ চালানোর প্রচেষ্টা দেখে। সমাজে ,রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে আওয়ামী আমলা ,এজেন্ট এবং ছাত্রলীগ, যুবলীগ, গুন্ডা -পান্ডাদের পুনরায় পুনর্বাসিত হতে দেখে। এদেশের জন মানুষ পুনরায় হতাশ বোধ করে এসব দেখে। কোটা আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হওয়া বিজয়টাকে কিছু কিছু ছাত্রনেতা বা সমন্বয়কের প্রচেষ্টা বা বক্তব্য দেখে মনে হয়, বিগত ১৭ বছর ধরে অসংখ্য খুন- গুম, হামলা- মামলার মধ্য দিয়ে বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীরা যে বৃহত আন্দোলনের সুতিকাগার তৈরী করে রেখেছিল- এটা তারা বেমালুম ভুলে যায়। আন্দোলনে অংশ নেয়া অভিভাবক, কৃষক, শ্রমিক, মজুর,সবার কথা ভুলে যাওয়া পূর্বের মতোই অন্যায় হবে।
আন্দোলনে অংশ নিয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করা মানুষগুলোর জরুরি চিকিৎসার বিষয়টিতে তাদের তড়িৎ কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। তার বদলে ঘরে- ঘরে, সংগঠনে- সংগঠনে, প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে গণহারে উৎপাদিত হচ্ছে সমন্বয়কের দল। প্রচন্ড সম্ভাবনা নিয়ে যে বিপ্লবে বিজয় অর্জিত হয় তা নিয়ে সাধারণ মানুষ কিছুটা হতাশ বৈকি। কিছু ছাত্র বা সমন্বয়ক নামধারীদের কারণে বিপ্লব পরবর্তি কর্মকান্ড মোটেও কাম্য ছিল না।
ইতিহাসের বিকৃতি দল- মত বা জাতির জন্য কখনোই মঙ্গলজনক নয়। এদেশে আমরা যা দেখতে পাই ৭১ পরবর্তী সময়ে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী চাটুকারেরা এমনভাবে ব্যক্তি পুজা ও দলপূজা শুরু করে যে আশাহত মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা বিস্মিত হয়। অস্ত্রধারী আওয়ামী পান্ডারা মানুষের গরু ছাগল থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ক পর্যন্ত লুটতরাজ শুরু করে ।শেখ মুজিব, তার আত্মীয়-স্বজন ও তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্নীতি দুঃশাসনে দেশ চরম দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়। শেখ মুজিব ক্রমশ নিজেকে রাজা ভাবতে শুরু করে। বাকশাল গঠন করে দেশের প্রতিটি নাগরিকের কন্ঠ রোধ করা হয়। তার পোষা মুজিব বাহিনী, রক্ষী বাহিনী প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। মানুষকে যাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় তাদের অনেকেই ছিল বিভিন্ন ফ্রন্টে সরাসরি যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধা এবং শেখ মুজিবের দুঃশাসনের প্রতিবাদকারী। এ সময় আওয়ামী লীগের তাজউদ্দীনসহ ভালো লোকগুলি নিজেদেরকে শেখ মুজিবের কাছ থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরিয়ে নেয়। মুজিব ক্রমান্বয়ে একজন নিঃসঙ্গ শেরপায় পরিণত হয়। কিন্তু নিজের অহমিকা, দম্ভ এবং চাটুকারদের প্রভাবে শেখ মুজিব কোন কিছুকেই পাত্তা দিতেন না ।ফলে যুদ্ধের ময়দানে একটাও গুলি না ফুটানো মুজিব নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের একক কৃতিত্বের সর্বেসর্বা ভাবতে শুরু করে ।ফলে পরিনিতি যা হবার তাই হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সেনা অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব ও তার পরিবারের সদস্যদের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে প্রথম বাকশালি কিম্ভুত শাসনব্যবস্থার।
পরবর্তী প্রায় ৫ দশকের রাজনীতিতেও আওয়ামী লীগ তাদের পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে বের হতে পারেনি। নানারকম অসংখ্য ন্যারোটিভ ও মিথলজি তৈরি করে তারা শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র স্টেক হোল্ডার বানানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। শেখ হাসিনা তার বাপের পথ অনুসরণ করেই শাসন কার্য চালানো শুরু করে। তার অঘোষিত দ্বিতীয় বাকশালী শাসন আমলে মানুষকে নিষ্ঠুর ভাবে কথা বলার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখে মুজিব শাসনের মতই। শেখ হাসিনা আমলে শুরু হয় লাগামহীন দুর্নীতি। উন্নয়নের নাম করে দেশের সব টাকা বিদেশে পাচার হতে থাকে। কেউ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের বিরোধীতা করলেই তাকে রাজাকার, সাম্প্রদায়িক, চেতনাহীন কিংবা মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হতো। নগ্নভাবে নাগরিকদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্কের একটা ট্রমা তৈরি হয়। মানুষ সারাক্ষণ ভয়ে চুপসে থাকে। কার ওপর কোন দিক দিয়ে ঘড়গ নেমে আসে। যে কারণে মানুষ সীমাহীন দুর্নীতি,কয়েকটা গণহত্যা, অসীম মিথ্যাচার, গণতন্ত্রহীনতা, দুর্নীতি, হাজার হাজার খুন-গুম, লক্ষ লক্ষ মামলা -হামলা ,দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় মূল্য বৃদ্ধির পরও সবকিছু মুখ বুজে সয়ে যেত। সেই পুরনো রক্ষীবাহিনী, মুজিব বাহিনীর মতো পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের ভয়ে তটস্থ থাকতো জনগণ।
অপার সম্ভাবনাময় জুলাই বিপ্লব কোনভাবেই কারো একার বিষয় না। এই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়া প্রতিটি মানুষ ,দল এবং মতের প্রতিনিধিদের প্রাপ্য সম্মান ও কৃতিত্বটা দেয়া উচিত। সাধারণ ছাত্র -ছাত্রী এবং সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ না নিলে আন্দোলন বিষয়ভিত্তিক কোটা আন্দোলন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়ে এক দফায় পরিণত হতো না। বিপ্লব গাছের কোন পাঁকা ফল নয় যে টুস পেরে খেয়ে ফেলার মত বিষয়। বরং বিগত ১৬-১৭টি বছর ধরে রাজনৈতিক দলগুলো বিপ্লবের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। প্রতিবাদ প্রতিরোধ করেছে। প্রাণ দিয়েছে।নির্যাতিত হয়েছে। এখন তাদের ভুলে গেলে বা তাদের অবদান অস্বীকার করলে তো হবে না। ৭১ পরবর্তী সময় মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত ক্রেডিট যেমন শেখ মুজিবের ঝুড়িতে তুলে দেয়ার প্রতিযোগিতা চলছিল, আমরা বর্তমান ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে তার কিছুটা নমুনা দেখতে পাচ্ছি। আমি বা আমরা এটা করেছি- ওটা করেছি, নানান জায়গায় এ ধরনের একটা প্রচেষ্টা দৃশ্যমান। যা কোনোভাবেই একটি মহান বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের জন্য মঙ্গলজনক নয়। ৭১ পরবর্তী আওয়ামীদের মত কারোরই একক ক্রেডিট দাবি করা উচিত না। সবাইকে মানতে হবে, এই আন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থানে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছাত্র, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি ছাত্র,মাদ্রাসার ছাত্র, আলেম -ওলামা, সাধারণ জনতা, অজানা সব শ্রমিক,হকার, বেকার, তরুণ, যুবক, রিক্সা চালক, ক্ষুদ্র দোকানদার, গৃহিণী ,ছিন্নমূল মানুষ,অভিভাবকসহ সবারই অবদান ছিল।
যারা সংগ্রামে- বিপ্লবে ছিলেন, তাদের আমিত্ব ও গোষ্ঠীতত্ব থেকে বের হতে হবে। ঘরে ঘরে সমন্বয় তৈরি হওয়া, কৃতিত্বের নানান তত্ত্ব- তথ্য,নেতৃত্ব ও নেতৃত্বের জন্য মরিয়া কিছু আচরণ ও কান্ডকারখানা এখনই যথেষ্ট হাসির খোরাক হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একাত্তরের মত ২৪ এর অভ্যুত্থানও ম্লান হয়ে বিবর্ণ হবে। ৯ দফাকে এক দফায় পরিণত হতে সবচেয়ে বেশি সাহস যুগিয়েছে এদেশের সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে মা -বোনেরা রাস্তায় নেমে আসার পর আন্দোলনের মোড় ঘুরে যায়। বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশের খবর গুরুত্বের সাথে আসতে থাকে। ফলে বিশ্বব্যাপী স্বৈরাচার হাসিনা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। দেশব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ করেও আর শেষ রক্ষা হয়নি। লজ্জাজনক ভাবে পরাজিত হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যায় বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা নারী স্বৈরশাসক।
নাগরিকদের সচেতনভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের পরে এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনার আমলে বিশেষ করে দ্বিতীয় বাকশালি আমলে পুনরায় ব্যাক্তি পুজা এবং এক ব্যক্তি দ্বারা একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল এটা আর হতে দেয়া যাবে না। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মিথ্যাচারের যেসব ন্যারোটিভ ও মিথলজি তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধকে কুক্ষিগত করার যে প্রয়াস বারবার লক্ষ্য করা যায় – তা বিপ্লবী ছাত্র জনতাকে রুখে দিতে হবে। বিগত ১৬ বছরে রাষ্ট্রে চেতনার নামে যে আতঙ্কের ট্রমা তৈরি করা হয়েছিল তা যেন আর কোনভাবেই ফিরে না আসতে পারে এটা দেখভাল করার দায়িত্ব প্রতিটি নাগরিকের। মুক্তিযুদ্ধের মত ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানেও আমি এবং আমিত্ব তো ঠেকানো না গেলে এই মহান বিপ্লবের ত্যাগ ও সম্ভাবনা ম্লান ও ফিকে হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। বিপ্লবে অংশ নেয়া প্রতিটি অংশীজন ও রাজনৈতিক দলকে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে বিপ্লবকে হৃদয়ে ধারণ ও লালন করতে হবে স্ব স্ব আচরণ ও কাজে। নইলে অনিবার্যভাবেই বিপ্লবের আবেদন কমতে থাকবে। কিংবা প্রতি বিপ্লবে ভেসে যাবে এতগুলো প্রাণের আত্মত্যাগ। অতএব সাবধান।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি লুৎফর রহমান উজ্জল। #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.