২০২৪-এর ভয়াল দিনগুলো
![]()
রহমান উজ্জ্বল: বাংলাদেশে সংগঠিত ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে প্রচুর রক্ত ঝরেছে। মূলত বহুবছর ধরে চেপে বসা সাইক্লোপকে সরাতে জনগণ নিরন্তর সংগ্রাম করেছে ও রক্ত ঝরিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো ও জনতার সেই বইয়ে চলা রক্তস্রোতগুলো মিলিত হয়ে ২০২৪ সালে এদেশে ঘটে রক্তবন্যা। কোলের শিশু থেকে শুরু করে ছাত্র, তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ -নারী, কৃষক- শ্রমিক- কেউ বাদ যায়নি দানব স্বৈরাচারের হত্যাযজ্ঞ থেকে। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। কারফিউ ভেঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন এগিয়ে আসতে থাকে চারপাশ থেকে হাসিনার প্রাসাদের দিকে তার মাত্র কিছুক্ষণ আগে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। উন্নয়নের নাম করে দেশের ভেতর চলছিল এক অদৃশ্য দুর্ভিক্ষ। একদিকে ক্ষমতাভোগীদের বিলাসবহুল উন্নত জীবন। অন্যদিকে একদম ভিন্ন চিত্র। গরিব মানুষ ক্রমশ আরো গরিব হচ্ছিল। মধ্যবিত্তরা নিম্ন মধ্যবিত্তে পরিণত হচ্ছিল। দেশটা কার্যত বন্ধি ছিল এক অদৃশ্য কারাগারে।
বহু বছর ধরে চলে আসা রাজনৈতিক দল ও জনগণের আন্দোলন ঠিকানা খুঁজে পায় ২০২৪ সালে এসে। হামলা,মামলায় জর্জরিত জনগণ এ সময় পালিয়ে থাকার বদলে রাজপথকে বেছে নেয়। কোটা প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্রদের সাথে সংহতি জানিয়ে তাদের সাথে মিশে যায় জনগণ। সব শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণে রাজপথগুলো ভারী হয়ে উঠে। সারাদেশ প্রকম্পিত হতে থাকে জনতার স্লোগান স্লোগানে। ক্রমান্বয়ে কোটা আন্দোলন পরিণত হয় স্বৈরাচার পতনের এক দফার দাবিতে।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থান ইতিমধ্যেই জুলাই বিপ্লব নামে পরিচিত পেয়েছে। মূলত জুন মাসে শুরু হলেও জুলাইয়ের শেষ দিকে এবং আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আন্দোলন তীব্রতর আকার ধারণ করে। আগস্টের ৫ তারিখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে আন্দোলনে বিজয় আসে। অসংখ্য আত্মবিসর্জন এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের স্বৈরাশাসনের অবসান ঘটে।
জুলাই বিপ্লবের সূচনা হয় ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। শুরুতে কোটা আন্দোলন ছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবি নিয়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের কঠোর অবস্থান ও নিপীড়নের ফলে সব শ্রেণীর মানুষ একসময় আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়। প্রবল জনস্রোতে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তারা জাতিকে নিরাপত্তা দেয়া ও একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে ঘোষণা দিয়ে আশ্বস্ত করেন। পরবর্তীতে হাসিনা পতনের তিনদিন পর নোবেল বিজয়ী ড: মুহাম্মদ ইউনুসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের উল্লেখযোগ্য ঘটনার দিনপঞ্জি নিম্নে দেয়া হলো:-
জুন ৫- ১৯১৮ সালে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারি চাকরির নিয়োগ ব্যবস্থায় কোটা প্রথা বাতিল করে সরকার। ২০২৪ সালের ৫ জুন সরকার কর্তৃক জারি করা সার্কুলারকে অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। ঘোষণার পরপরই শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। সরকারের সুবিধাভোগী লোকেরা ৫৬% চাকরি সংরক্ষণ করার সুবিধা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে সারাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়।
স্বৈরাচার সরকার তার ব্যবহৃত সুপ্রিম কোর্টে আপিলের নাটক করলেও ছাত্রছাত্রীরা তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। বরং কোটা প্রথা বাতিলের জন্য নতুন একটি নির্বাহী আদেশের দাবি জানায় তারা।
৬ জুন – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করে এদিন।
এরপর ঈদুল আযহার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেলে আন্দোলনে কিছুটা ভাটা পড়ে।
১ জুলাই – ২৪ দিনের বিরতির পর শিক্ষার্থীরা কোটা প্রথা বাতিলের জন্য নির্বাহী আদেশের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের আরও কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করে। ৪ জুলাই পর্যন্ত সরকারকে দাবি পূরণের সময়সীমা বেধে দেয় আন্দোলনকারীরা।
২ জুলাই – ঢাকায় শিক্ষার্থীরা এক ঘন্টার জন্য শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করে। তারা অন্তত ২০ মিনিট ধরে ঢাকা -আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে।
৩ জুলাই – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এদিন কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বর থেকে একটি মিছিল বের করে। শাহবাগে বিক্ষোভ করে দেড় ঘন্টা ধরে নগরীর ব্যস্ততম মোড়টি অবরোধ করে রাখে। আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করে এদিন।
৪ জুলাই – আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। যা কার্যত কোটা বাতিলের সার্কুলারকে অবৈধ ঘোষণা করে। ফলে সারাদেশে শিক্ষার্থীরা তাদের বিক্ষোভ আন্দোলন আরও তীব্র করে তোলে।
৫ জুলাই – সারাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রচারণা জোরদার করার জন্য ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘এর ব্যানারে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি দেয়। বিক্ষোভ, সমাবেশ এবং সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করে তারা। ৭ জুলাই থেকে ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি ৬ জুলাই প্রতিবাদ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়।
এই দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ,খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ,যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে অবস্থান ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে।
৬ জুলাই – শিক্ষার্থীরা ঢাকার শাহবাগ, নীলক্ষেত, হেয়ার রোড, মিন্টু রোড, বাংলা মোটর, সায়েন্স ল্যাব এবং ঢাকা- আরিচা ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ দেশের প্রধান প্রধান সড়কগুলো কয়েক ঘন্টার জন্য অবরোধ করে রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় ,ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সাইন্স ল্যাব মোড়, ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা নীলক্ষেত মোড়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা- আরিচা মহাসড়ক এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে।
৭ জুলাই – শিক্ষার্থীদের আন্দোলন- অবরোধে ঘন্টার পর ঘন্টা স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা মহানগরী। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সাথে সংহতি জানিয়ে সারাদেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা।
৮ জুলাই – এই দিন ঢাকার ১১ টি স্থানে অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। এছাড়া নয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তিনটি স্পটে রেলপথ অবরোধ করা হয়।
৯ জুলাই – বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশের সড়ক ও রেলপথের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবরোধ ঘোষণা করে। অন্যদিকে আইনি লড়াইয়ে আপিল করেন দুই শিক্ষার্থী।
১০ জুলাই – এদিন আপিল বিভাগ চার সপ্তাহের জন্য কোটা ব্যবস্থার ওপর স্থিতিস্থাবস্থা জারি করেন। অন্যদিকে সব গ্রেডে সরকারি নিয়োগে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবী জানায় শিক্ষার্থীরা।
১১ জুলাই – এক সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন – কোটা আন্দোলনের নামে আন্দোলনকারীরা পেশি শক্তি ব্যবহার করছে। যা অযৌক্তিক ও বেআইনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান বলেন- আন্দোলনকারীরা সীমা অতিক্রম করছে।
এদিনও শিক্ষার্থীরা রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড় এবং মহানগরীতে ঢোকার মুখে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নেয়। পুলিশের বাধার মুখেও সড়ক ,মহাসড়ক ও রেলপথে যান চলাচল ব্যাহত করে।
১২ জুলাই – বিকেল পাঁচটার দিকে জনগণ জড়ো হতে থাকে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগ হামলা চালায়। এ সময় ভিডিও ধারণকারী এক শিক্ষার্থীকে একটি হলে নিয়ে গিয়ে মারধর করে ছাত্রলীগ।
১৩ জুলাই – সাপ্তাহিক ছুটির দিন হলেও এদিন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বিক্ষোভ মিছিল করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে মিছিল করে শাহবাগ অবরোধ করে ছাত্রছাত্রীরা। রেলপথ অবরোধ করেও বিক্ষোভ করে তারা।
সন্ধ্যার পরে শিক্ষার্থীরা একটি সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে জানায়- পুলিশ মামলা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছে। পরের দিন রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
১৪ জুলাই – ওইদিন শিক্ষার্থীরা রাজধানীতে অবস্থান, বিক্ষোভ ও অবরোধসহ মিছিল করে । রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি পেশ করেন।
সন্ধ্যায় গণভবনে শেখ হাসিনা এক প্রেস ব্রিফিংয়ে -আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের সন্তান’ বলে উল্লেখ করে। যা মুহূর্তের মধ্যে প্রচন্ড বিতর্কের সৃষ্টি করে। চলমান আন্দোলনকে ভয়ানকভাবে উসকে দেয়।
শেখ হাসিনার বক্তব্যের জবাবে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় মধ্যরাতে বিক্ষোভ মিছিল করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব মহিলা হলের শিক্ষার্থীরা তালা ভেঙে এসময় মিছিলে যোগ দেয়।
এইদিন দুপুরবেলা ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করে। ছাত্রলীগের হামলায় ১৩ জন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আহত হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও বিক্ষোভ করে ১৪ তারিখে।
১৫ জুলাই – আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন- দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগই আন্দোলনকারীদের জবাব দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তারা উচিত জবাব দেবে’। ওবায়দুল কাদের ঘোষণার পর ছাত্রলীগ পাগলা কুকুরের মত আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। নির্বিচারে জখম করে অন্তত ৩০০ শতাধিক বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীকে। আটক করা হয় বেশ কয়েকজনকে।
এদিন সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ হেলমেট পড়ে ,জোর করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লোহার রড ও চাইনিজ কুড়াল নিয়ে প্রবেশ করে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ও তাদের সাথে আসা বিক্ষোভকারীদের উপর হাসপাতালের বাইরে ও ভেতরে পুনরায় হামলা করে। হাসপাতালের কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করে।
কয়েক ঘণ্টার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ছাত্রাবাস- ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল, ফজলুল হক মুসলিম হল এবং অমর একুশে হল থেকে ছাত্রলীগের গুণ্ডাদের বের করে দেয়।
এদিন সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলায় ছয় শিক্ষার্থী আহত হয়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র সমন্বয়ককে ডেকে নিয়ে তাকে লাঞ্ছিত ও মারধর করে ছাত্রলীগ। আন্দোলনকারীরা পরের দিন বিকেল তিনটায় দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের ডাক দেন।
১৬ জুলাই – শিক্ষার্থীরা ষোলই জুলাই দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভ করে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের লোকেরা ব্যাপক হামলা চালায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও রংপুরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সাথে ভয়ঙ্কর সংঘর্ষে এদিন কমপক্ষে ছয়জন শিক্ষার্থী নিহত হয়।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করার ভিডিও ফুটেজ মুহূর্তে দেশে ও বিদেশে ভাইরাল হয়ে যায়। এদিন অনবরত লড়াই করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দেয়। তারা ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ হলেরও নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।
সারাদিনের ঘটনা প্রবাহের প্রেক্ষিতে ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করে । এদিকে শিক্ষার্থীরা পরের দিন নিহতদের জন্য গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের ঘোষণা দেয়।
১৭ জুলাই- সকালের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সকল নেতাকর্মী পালিয়ে যায় ক্যাম্পাস থেকে। ক্যাম্পাসকে রাজনীতি মুক্ত ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা। ছাত্র- জনতা নিহতদের জন্য গায়েবানা জানাজা আদায় করা চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ছাত্রদের সমাবেশে হামলা করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাস বন্ধ করে ছাত্রদেরকে ছাত্রাবাস খালি করার নির্দেশ দেয়।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়। শেখ হাসিনা ছাত্রদের কোর্টের রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে বলেন এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দেয়। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা শেখ হাসিনার আশ্বাস গ্রহণ করেনি। বরং পরের দিন তারা সারাদেশে পরিবহন বন্ধ রাখার জন্য ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়।
১৮ জুলাই – সারাদেশে ‘শাট ডাউন’ কর্মসূচির প্রেক্ষিতে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য ৪৭ টা জেলায় ব্যাপক সহিংসতা ঘটে। শাট ডাউন কার্যকর করার জন্য দেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়। আওয়ামীলীগ ,পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী শর্ট গানসহ প্রাণঘাতি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রসহ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে। পুলিশ ,আওয়ামী লীগ ,ছাত্রলীগ ,যুবলীগের লোকজন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়। ১৮ জুলাই দেশজুড়ে কমপক্ষে ২৯ জনের শহীদ হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
আন্দোলনকারী ছাত্র জনতা এদিন বিটিভি ভবন, সেতু ভবন ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুরসহ হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। মেট্রো রেলও বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। সারা দেশের ৪৭ টি জেলায় বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ,গুলি, হামলা, পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে। দেশজুড়ে নিহতদের পাশাপাশি অন্তত ১৫০০ জন মানুষ আহত হয়। এদিন হাসিনার সরকার দেশে বিজিবি মোতায়েন করে।
১৯ জুলাই – ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার এদিন মধ্যরাতে কারফিউ জারি করে। দেশে সেনাবাহিনী মোতায়ন করা হয়। নরসিংদীর কারাগারে ভাঙচুর, লুণ্ঠন ও আসামি পলায়নের ঘটনা ঘটে। মেট্রো রেল স্টেশন, বিআরটিএ অফিসসহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দমন করার জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সব ধরনের জনসমাগম ও মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাট ডাউন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশে নজিরবিহীন সহিংসতায় গুলি, মৃত্যু ও আহতদের চিৎকারে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ কেঁপে ওঠে ।মিরপুর ও কাজীপাড়া মেট্রো স্টেশন হামলাসহ ব্যাপক ভাংচুর হয়।
এদিন শুধু ঢাকা মহানগরীতেই ৪৪ জন নিহত হয়। ঢাকার বাইরে মোট ৫৯ জন নিহত হয়। এছাড়া ছাত্রছাত্রী, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, পুলিশ, পথচারী, সাংবাদিকসহ- শত শত মানুষ আহত হয়। ১৯ জুলাই শুক্রবার থেকে ব্যাপক হারে অভিভাবকসহ দেশের নাগরিকরা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়। এদিন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মুখে কালো কাপড় বেঁধে বিক্ষোভ করে। দুপুর একটার দিকে ভৈরবে ছাত্র-জনতা থানা ঘেরাও করলে জনতার উপর ব্যাপক গুলি চালানো হয়। ভৈরবে গুলি বর্ষনের ঘটনায় শতাধিক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়।
মুক্তি পাগল ছাত্র- জনতা নরসিংদী জেলা কারাগারে ঢুকে ৯০০ বন্দিকে মুক্ত করে দেয়। আশিটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ১০০০ রাউন্ড গুলি লুট করে। এদিন সারাদেশের বিক্ষোভ- সংঘর্ষে ১০৩ জন নিহত হয়। রাতে কারফিউ জারি করা হলে দিনের বেলা সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। ইন্টারনেট পরিষেবা সারা দেশে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়
২০ জুলাই – সেনা মোতায়েনের মধ্যে কারফিউর প্রথম দিনে দেশে অন্তত ২৬ জন নিহত হয়। যাত্রাবাড়ী, উত্তরা ,বাড্ডা ও মিরপুর ছিল সংঘর্ষের মূল পয়েন্ট। সরকার পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়। এবং দুই দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। ২০ তারিখে বিএনপি, ছাত্রদল ও কোটা আন্দোলনের বেশ কিছু নেতাকর্মীদের আটক করা হয়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্ময়ক নাহিদ ইসলামকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়।
২১ জুলাই – সুপ্রিম কোর্ট কোটা মামলায় রায় প্রদান করে। ৭% কোটা রেখে ৯৩% সরকারি চাকরি মেধার ভিত্তিতে আবেদনকারীদের জন্য অবমুক্ত করা হয়। এদিন বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ৫৬ জন সমন্বয়কের পক্ষ থেকে সংবাদকর্মীদের কাছে একটি লিখিত বিবৃতি পাঠানো হয়। বিবৃতিতে দেশজুড়ে কমপ্লিট শাটডাউনকে আরো জোরালো করার আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে আরো বলা হয়- আন্দোলনে ৩০০ জনেরও বেশি ছাত্র জনতা নিহত হয়েছে। শুধুমাত্র আদালতের আদেশ ব্যবহার করে সরকার হত্যার দায় এড়াতে পারে না। বিবৃতিতে বলা হয়- পুলিশ কিছু মূল সংগঠককে তুলে নিয়ে গেছে এবং তাদেরকে দিয়ে বিবৃতি দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের চলমান সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বৃটেন উদ্বেগ প্রকাশ করে। সেই প্রেক্ষিতে তিন বাহিনী প্রধান শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে যায়। দেশজুড়ে কারফিউ চলতে থাকে। এদিনও সারাদেশে সাতজন নিহত হয়।
২২ জুলাই- স্বৈরাচার শেখ হাসিনা এদিন বিএনপি -জামায়াতকে হুঁশিয়ারি দেন এবং পরিনিতি ভোগ করার কথা বলেন। সেনাপ্রধান দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পাওয়ার আশা ব্যক্ত করেন। বিএনপি -জামায়াতসহ সরকার বিরোধী ছাত্রদের ধরপাকর অব্যাহত থাকে।ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী কোটা সংক্রান্ত আদালতের প্রজ্ঞাপনে অনুমোদন দেয়। এ দিন বিক্ষোভ- সংঘর্ষে দেশজুড়ে আরও ১৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
২৩ জুলাই – সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য দেখে সরকার কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সার্কুলার জারি করলেও চার সংগঠক তা প্রত্যাখ্যান করে। কারফিউর মধ্যেও বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী ও আন্দোলনরত ছাত্রদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত থাকে। সীমিত আকারে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করা হয়।
২৪ জুলাই – আন্ত:জেলা বাস ও লঞ্চ চলাচল আংশিকভাবে চালু এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু করার কথা বলা হয়। সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ ,আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশিদকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা তুলে নিয়ে গেলে পাঁচদিন পর এইদিন তাদের পাওয়া যায়। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তারা জানান দেয় -নিখোঁজ থাকাকালীন চোখ বেঁধে তাদের অত্যাচার করা হয়েছে।
২৫ জুলাই – জাতীয় পার্টির একাংশের নেতা ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থসহ আরো ডজনখানেক নেতাকে আটক করা হয়। সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ,আমেরিকা ও কানাডা বাংলাদেশে সংঘটিত ক্র্যাক ডাউন বন্ধ করার আহ্বান জানায়। সেনা মোতায়েনের পর এদিন প্রথম শেখ হাসিনার জনসম্মুখে উপস্থিত হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রো রেল স্টেশন পরিদর্শন করে।
এদিনও চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহতদের মধ্যে তিনজন ছাত্র মৃত্যুবরণ করে। শুক্রবার ও শনিবার ৯ ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়। এ দিন অ্যামনেস্টি এক বিবৃতিতে বলে- বাংলাদেশে পুলিশ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করছে। সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম এক বিবৃতিতে জানায় -কোটা নিয়ে যেহেতু সংসদে কোন আইন পাস হয়নি ,তাই বিষয়টির চূড়ান্ত সমাধানও হয়নি।
২৬ জুলাই – সারাদেশে ব্লক রেইড শুরু করে শেখ হাসিনার পেটোয়া বাহিনী। পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ৩ সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে যায়। দেশে ৫৫৫টি মামলায় ৬২৬৪ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। দ্বিতীয় দিনের মত জনসম্মুখে হাজির হয়ে শেখ হাসিনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করে। জাতিসংঘ পুনরায় ক্র্যাক ডাউন বন্ধ এবং ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করার আহ্বান জানায় ।ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আবু বাকের এবং হাসনাত আবদুল্লাকে তাদের হেফাজতে নেয়। গত ১১ দিনে মোট ৯১২১ জন ছাত্র -জনতাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এর মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই গ্রেপ্তার করা হয় ২৫৩৬ জনকে।
এদিন ঢাকায় ১৪ টি পশ্চিমা দেশের কূটনৈতিক মিশন এক যৌথ বিবৃতি দেয়। যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যায় কাজের জবাবদিহি করতে বলা হয়। শেখ হাসিনা আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যান। এবং বলেন -দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করার জন্যই এই সহিংসতা চালানো হচ্ছে।
২৮ জুলাই – কোটা আন্দোলনের নারী সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে ডিবি হেফাজতে নেয়া হয়। ডিবি হেফাজতের ৬ সমন্বয়কারীকে দিয়ে একটি লিখিত বিবৃতির ভিডিও দেখানো হয়। যাতে দেখানো হয় -তারা সব ধরনের কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিচ্ছেন। তবে অন্যান্য সমন্বয়করা দাবী করেন -ভিডিও বার্তার বক্তব্য সমন্বয়কারীদের আসল অবস্থান নয়। এটা তাদের পড়তে বাধ্য করা হয়েছে। শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ২০০টির বেশি মামলায় ২ লক্ষাধিক মানুষকে আসামি করা হয়। এইদিন সরকার প্রথমবারের মতো নিহতদের সংখ্যা ১৪৭ বলে ঘোষণা দেয়।
২৯ জুলাই – সরকার ছাত্র নেতাদের মুক্তির আল্টিমেটাম উপেক্ষা করলে দেশের জনগণ ও ছাত্ররা দেশজুড়ে পুনরায় বড় আকারের বিক্ষোভ শুরু করে। ঢাকায় ২৮২২ জন শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ। জামাত শিবিরকে নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয় সরকার। কোটা আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ককে সাথে নিয়ে খাওয়ার ভিডিও শেয়ার করায় ডিবি পুলিশকে তিরস্কার করে হাইকোর্ট।
সারা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ‘ নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষক সমাবেশ ‘ এই ব্যানারে শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবি ও তাদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে অনুষ্ঠিত সমাবেশে শিক্ষকরা চলমান গণহত্যাকে ‘জুলাই গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে পরের দিন মঙ্গলবার শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। শিক্ষার্থী ও জনতা – সরকার ঘোষিত শোক দিবস প্রত্যাখ্যান করে পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
৩০ জুলাই- ছাত্ররা সরকার ঘোষিত শোক দিবস প্রত্যাখ্যান করে। আন্দোলনের সাথে সংহতি জানিয়ে জনগণ তাদের ফেসবুকের প্রোফাইল লাল করে দেয়। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে।
এদিন পুলিশের বাধার মুখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকরা মৌন মিছিল করে। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সমাবেশ করে। অভিভাবকরা সন্তানদের মৃত্যুর প্রতিবাদ জানায়। দেশে বিপুল প্রাণহানির জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। সরকার জানায় -বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য বিদেশী সহায়তা নেয়া হবে। সরকারি শোক প্রত্যাখ্যান করে মানুষ বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। অবাধে পুলিশ ধড়পাকড় করতে থাকে।
৩১ জুলাই – গণ গ্রেপ্তার, হামলা -মামলা, হত্যা গুম ,জুলুমের বিরুদ্ধে ছাত্র- নাগরিকরা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ নামে প্রতিবাদ শুরু করে। এদিন সুনির্দিষ্ট নয়টি দাবির পক্ষে দেশব্যাপী আদালত প্রাঙ্গণ, ক্যাম্পাসসমূহ ও রাস্তায় দুপুর বারোটা থেকে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। সকাল ১১ টা ২০ মিনিটে সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করে। দুপুর একটার পরে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের দিকে মিছিল করে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির কাছে পুলিশ মিছিলে বাধা প্রদান করে। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয় এসময়। এর প্রতিক্রিয়ায় ছাত্ররা দোয়েল চত্বরে জড়ো হয়। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি সমর্থিত সাদা প্যানেলের শিক্ষকরা ছাত্রদের সাথে যোগ দে ।
সকাল ১১ টা নাগাদ বিক্ষোভকারীরা চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গনে একত্রিত হতে শুরু করে। পুলিশি ব্যারিকেড সত্বেও শত শত বিক্ষোভকারী আদালত চত্বরে প্রবেশ করে। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা এ সময় ছাত্রদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে । বিক্ষোভের অংশ হিসেবে ঢাকার রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ চলাকালে পাঁচ শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। ১৩ দিন বন্ধ থাকার পর এদিন ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো খুলে দেয়া হয়।
১ আগস্ট- সরকার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ দলের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির ও দলের সহযোগী সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। জাতিসংঘ সহিংসতা নিয়ে তদন্তে একটি স্বাধীন ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং’ দল পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। আন্দোলনের ছয় সংগঠককে পুলিশি হেফাজত থেকে মুক্তি দেয়া হয়। এদিন শিক্ষার্থীরা নিহতদের জন্য গণ মিছিল ও প্রার্থনার আয়োজন করে। পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে।
২ আগস্ট- নাগরিকদের হত্যার প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিল ছাত্র-জনতার ঐক্য। হাজার হাজার মানুষ বিচারের জন্য মিছিল করে আন্দোলনে যোগ দেয়। রাজধানীসহ দেশে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের হামলায় আরো দুজন নিহত হন। বিক্ষোভকারী নাগরিকরা ৩ আগস্ট সারাদেশে বিক্ষোভ এবং ৪ আগস্ট থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়।
এদিন আবারও সাত ঘন্টার জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় ফেসবুক। ডিবি হেফাজতে নেয়া ছয় সমন্বয়ক বলেন- ডিবি অফিসে আন্দোলন প্রত্যাহার এর বিবৃতি তারা স্বেচ্ছায় দেননি।
জাতিসংঘের শিশু ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনিসেফ) বাংলাদেশের চলমান আন্দোলনকে ঘিরে কমপক্ষে ৩২ শিশু নিহতের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে।
৩ আগস্ট – কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেন – তাদের পক্ষ থেকে সরকারের সাথে আলোচনার কোন পরিকল্পনা নেই । শেখ হাসিনা আলোচনার প্রস্তাব দিলে শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তারা হাসিনার পদত্যাগ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন নেতৃত্বে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের দাবিতে লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি দেন।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে প্রধান সমন্বয়কদের একজন নাহিদ ইসলাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত অসংখ্য জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করে। এদিন সকাল থেকেই রাজশাহীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা স্লোগান সহকারে মিছিল করে রুয়েটের সামনে জড়ো হয়। শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফার দাবিতে রাজপথে নেমে আসে তারা।
চট্টগ্রামে শিক্ষা মন্ত্রী নওফেলের বাসায় ছাত্র-জনতা হামলা করে। তার বাড়ির সামনে পার্ক করা কিছু গাড়ি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর আগে চট্টগ্রাম -১০ আসনের সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চুর কার্যালয়েও হামলা করা হয়। আরেকটি ঘটনায় গাজীপুর জেলার শ্রীপুরে আন্দোলনরত একজন শিক্ষার্থীকে হত্যা করে পুলিশ। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও কোটা আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সিলেটে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র- জনতার সংঘর্ষ অন্তত শতাধিক মানুষ আহত হয়।
দুপুর দেড়টার দিকে কুমিল্লাতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা- আন্দোলনরত জনমানুষের উপর আগ্নেয়াস্ত্র ও নানারকম দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। তাদের হামলায় বহু মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়। তাৎক্ষণিকভাবে মোট ৩০ জনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
বগুড়ায় আন্দোলনরত ছাত্র- জনতার সাথে পুলিশ ও আওয়ামী গুণ্ডাদের সংঘর্ষ হয়। বিকেল চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত প্রায় একটানা সংঘর্ষ চলে। বগুড়া নগরীর বিভিন্ন এলাকা একেবারে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ৫০ জনের অধিক মানুষ ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ লীগের আক্রমণে আহত হয়।
৪ আগস্ট- ফ্যাসিস্ট পতনের আগের এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিশেষ দিন হিসেবে চিহ্নিত হবে। এদিন বাংলাদেশের পথে- প্রান্তরে বহু তাজা প্রাণ ঝরে যায়। এদিন সারাদেশে ১৪ জন পুলিশের সদস্য নিহত হয়। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের একটি থানাতেই গণপিটুনিতে তেরোজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়। আন্দোলনরত ছাত্র- জনতা দেশের রাজপথগুলোর দখল নেয়। দেশজুড়ে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। সরকার পুনরায় ইন্টারনেট বন্ধ করে এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য পারফিউ ঘোষণা করে। ৪ তারিখেও ফ্যাসিস্ট হাসিনা আন্দোলনকারীদের নাশকতাকারী, ধ্বংসযজ্ঞের সাথে জড়িত এবং সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করে। বিক্ষুব্ধ নাগরিকরা শেখ হাসিনার কথাবার্তা প্রত্যাখ্যান করে তাকে আহবান জানায়। এদিন অর্থাৎ ৪ আগস্ট ছাত্রনেতারা ‘ ঢাকায় পদযাত্রা’ একদিন এগিয়ে এনে পাঁচ তারিখে করার ঘোষণা দেয়। এটা অবশ্যই আন্দোলনের ইতিহাসে অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট। সেনাবাহিনী ও পুলিশ নাগরিকদের কারফিউ না ভাঙতে বা আইন লঙ্ঘন না করার আহ্বান জানায়। চার তারিখে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাথে অন্যান্য সাবেক শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে আন্দোলনের সাথে সংহতি জানান এবং হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানান।
বর্তমান সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান বলেন- বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী সর্বদা জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে।
৫ আগস্ট – চার তারিখে রাতে দেশের মানুষ মূলত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। তখনও অজানা আশঙ্কায় দিশেহারা অসংখ্য আহত,ক্লান্ত মানুষ। নিহতদের বাধ্য হয়ে গোপনে দাফন করতে হচ্ছে। উৎকণ্টার রাত পেরিয়ে আস্তে আস্তে ভোর হয়।
নাগরিকদের ক্রোধ – ক্ষোভ এবং দানব শাসককে পরাজিত করার তীব্র স্পৃহা তাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে আসে সকাল হতে হতেই। ঢাকার আশেপাশের গ্রামগুলোতে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে কারফিউ অমান্য করে মানুষ ঢাকা শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বিকেল তিনটের পরে ছাত্র জনতা ফ্যাসিস্ট হাসিনার স্বপ্নের বাসভবন গণভবন আক্রমণ করে। যা হাসিনা এক টাকা প্রতিটি মূল্যে ক্রয় করেছিল। জনগণের আক্রমণের মাত্র ৪৫ মিনিট আগে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা সামরিক উড়োজাহাজে করে ভারতে পালিয়ে যায়। নাগরিকরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। দেশজুড়ে শুরু হয় আনন্দ উৎসব।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে আলাপ করেন। তারা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে একমত হন। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীন সন্ধ্যায় বঙ্গ ভবনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। টেলিভিশন ভাষণে দেশবাসীকে ধৈর্য ধারণ করে শান্ত থাকার আহ্বান জানান।
একাত্তরের পর জাতি একসঙ্গে এত আত্মহতি দেখেনি। দানব সরকারের বন্দুকের নলের সামনে প্রাণ হারায় কোলের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ কিংবা মহিলারা পর্যন্ত। ক্ষমতার মোহে মাত্র কয়েকদিনের ভেতর প্রায় দুই হাজার মানুষকে হত্যা করে শেখ হাসিনা , লুটেরা আওয়ামীলীগ ও তাদের অনুগত পুলিশ। প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে চিরতরে পঙ্গু করে দেয় তারা। অবশেষে দীর্ঘ দিনে এর পরাজয়ের রুদ্ধশ্বাসের পর এদেশের নাগরিকরা ২০২৪ সালের ৫ ই আগস্ট চিৎকার করতে থাকে তাদের বিজয়ের আনন্দে। #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.