লেখক: ড. মুহাম্মদ আব্দুল মুমীত: “ম্যালা দিন পরোত গাঁওত অ্যাসা মুনত খুশ ল্যাগিচ্চে। হামরা কাঁচু থাকতে বিয়্যান ব্যালা নিনোন থ্যাকা চ্যাতন হয়্যা আর বিছন্যাত শুয়্যা থ্যাকিনি। তফন ফিন্দ্যা গিল্যাপ গায়োত দিয়্যা ধরপর কর্যা দুয়ারের খিল খুল্যা সোজা গ্যাছি গাঙয়ের ঘাটত। হাউস কর্যা বিয়্যান ব্যালার বাতাস খ্যাছি; গাঙয়ে বিয়্যানের হাওয়ায় শরীলের ব্যামার স্যারা যায়। ছিপ বরশি দিয়্যা ম্যালাকটি মাছ ম্যারা অ্যানলে, মায়ে কাটাত কর্যা কডা মুড়ি আর কাঁসার গেলাসত খ্যাজুরের অস দিয়্যা কত, ম্যাল্যা হসে এক্ষন খ্যায়া পড়বার বস! হ্যামাকেরে গাঁওত পড়ার চ্যাংড়া-প্যাংড়া ম্যালাডি ছিল না, সেই তকনে পড়াত মুন লাগিচ্ছিল না। গাঁয়ের মানুষের তকুন ভাতের ম্যালা অভাব। দুপুর-ত্যাপুর তারা খাটত খিদ্যার কষ্টে দু’ডা খাওনের তকনে। গ্যারামে তখন ঘ্যাটা অ্যাছল না, গাড়িঅ্যাছল না; ক্ষ্যাতের অ্যাল দিয়্যা হ্যাঁটা ইসকলোত য্যাতে গোটা গাও ঘুপ্যা ভিজা সুপ-সুপ্যা হয়্যা য্যাত। পাড়াগাঁওত তখন কারেন অ্যাছল না। ইসকলোত থ্যাকা অ্যাসা খ্যায়া-দ্যায়া ঝাঁক্যাত কর্যা গরুর ঘাস ক্যাটা, স্যাঁজ লাগার আগেই হ্যারিক্যানের চিমনী মুছ্যা ফারসা না করলে অ্যাত্রিরে পড়া য্যাত না। বাড়িত থ্যাক্কা ইসকলের ঘ্যাটা মেলাডি, সেই তকনে পড়বার বস্যা দু’চোখ ঘুম্যা ঢল্যা পড়ত। গ্যারামে তখন টিবি, মোবাইল অ্যাছল না, অ্যাকাটডা এডিও চোখত পড়ত। মানুষগুল্যা গাছের তলাত আর বাঁশের চড়াটত বস্যা কামের উপারে গপ্প-গুজব করত, আর হ্যাসা হ্যাসা কুটিকুটি হত; বুঝবার জু নাই তারকে প্যাটোত ভাত নাই! কারও বিপদ বা ব্যামার হলে গ্যারামের ব্যাবাকটি মিল্যা দুঃক ভাগ কর্যা লিত।”
গ্রামের সেই স্মৃতি বিজড়িত চেনা জানা ও হারানো দিনের হাসি আর মিলে না। অথচ আজ ? সেকালের ‘গ্যারাম’ এখন আর গ্রামে খোঁজে পাওয়ার উপায় নেই। মানুষেরা এখন কথা বলে শুদ্ধ বাংলায় প্রমিত উচ্চারণে। গরু ও লাঙ্গল দিয়ে হাল-চাষের পরিবর্তে এসেছে হরেক রকমের যন্ত্র। রাতের নিভৃত পল্লীতে এখন আর জোনাকির আলো দেখার সুযোগ নেই; সেই জায়গা দখলে নিয়েছে বৈদ্যুতিক বাতির ঝলক। আগের মতো এখন কারও বাড়িতে কেউ আগুন অথবা নিত্য প্রয়োজনীয় কোন দ্রব্য হঠাৎ প্রয়োজনে চাইতে আসে না। গভীর রজনীতে অচেনা দূর হতে হৃদয় গ্রাহী বাঁশির উতালা সুর মনকে আর অনুরণিত করে না। মাঝ রাতে দাঁড় বেঁয়ে কষা নৌকার মাঝি মাল্লাদের আচমকা চিৎকারে এখন আর ঘুম ভাঙ্গে না। বাঁশের সাঁকোর স্থলে সেতুর সুবাদে, দু’পাড়ের মানুষেরা আর পারা পারের জন্য নৌকার অপেক্ষায় বসে থাকে না। মায়েদের গবর দিয়ে ক্যাড়া বা নোন্দা বানানোর স্পটে পাড়ার সবাই মিলে গল্পের যে আসর বসত, তা আর চোখে পড়ে না। মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে বাজার; মাঝরাত পর্যন্ত তারা এখন টিভির সামনে বসে গোটা বিশের নির্যাস আহরণ করতে শিখেছে। সাংসারিক জীবনে হাতপাখা এবং কুয়োর জায়গা অনেক আগেই কেড়ে নিয়েছে ইলেকট্রিক পাখা আর মটর। গরম ও পিঁপড়ার ভয়ে রাতের অবশিষ্ট ভাত বা তরকারি গরম করে শিকায় রাখার যে শৈল্পিক সৃষ্টি তা এখন দখল করেছে ফ্রিজ আর ওভেন। কৈশরে খেলাধুলার রোমাঞ্চকর আনন্দ যেন হরণ করেছে মোবাইল আর টিভি। মানুষের পায়ে হেঁটে আর যাতায়াত করতে হয় না। অভাবের লেশ নেই কারও আননে- সবাই স্বচ্ছল, সক্ষম। মানুষ স্বাবলম্বি হয়েছে; একে অন্যের সাথে সুখ-দুঃখ বা কাজের ভার ভাগাভাগি করার মিথালী যেন এখন ঝিমিয়ে পড়তে শুরু করেছে। সেই সাদা মাটা মানুষ গুলো আজ যন্ত্র দিয়ে লাভ-ক্ষতির হিসেব মিলাতে শিখেছে। শহুরে জীবনের চমকে মানুষ গুলো আজ আস্বাদন করতে শিখেছে কিভাবে জীবনকে উপভোগ করতে হয়। চঞ্চল, তৎপর এক অজানা তাড়না যেন তাদেরকে প্রতিনিয়ত অস্থির আর ব্যস্ত করে রেখেছে কল্পনাতীত ভাবে। কি অবাক! গ্রামের সেই সহজ সরল প্রাকৃতিক মানুষ গুলো আজ কত অচিন! কত অচেনা! এত কিছুর পরেও গোটা গ্রাম খুঁজলে কারও মুখে সেদিনের সেই হাসির লেশমাত্র পাওয়ার সুযোগ নেই!
ফেলে আসা স্মৃতির পাতায় ভর করে ভাবনা গুলো যখন মোহগ্রস্থ আর ব্যাকুল করে তুলছিল, আচমকা খুদের মায়েরআবেগঘন জিজ্ঞাসায় অবাক হলাম। তুমি নাকি ডাক্তার হইছো? কয়েক দিন থেকেই আমার খুুবজ¦র, বুক জ¦ালা, সোজা হয়ে দাঁড়ালে গাও-মাথা ঘুরে আসে, খাাবার রুচি নেই ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি বিনয়ের সাথে বললাম, আমি তো ডাক্তারি পড়িনি। কড়া জবাব তার:গেরামের সবাই যে বলাবলি করছে- তুমি নাকি মস্ত বড় ডাক্তার! তাকেকোনমতে বুঝিয়ে বিদায় দিয়ে ভাবলাম, সম্ভবত তারা ‘ডক্টর’ কে ‘ডাক্তার’ ধরে নিয়েছে। সূর্যকরের সোনালিআভাএক্ষণে লাল হতে শুরু করেছে, যার আলোক ছটা বিলের অথৈয় পানিতে পড়ে রংধনু রঙের মোহনিয়ায় সবুজ বৃক্ষ পল্লবেরওপর এক অপার্থিব সৌন্দর্যের আধার তৈরি করছে। এক ঝাঁক সাদা বক সারি বেঁধে সেই সোনা ঝরা রোদ্দুরের মিষ্টি পরশে ডানা মেলে পাড়ি জমাচ্ছে অজানার উদ্দেশ্যে। একটা মাছ রাঙ্গা অকস্মাৎ এক পুঁটি মাছ ধরে উড়ে গিয়ে বসছেকদম গাছের ডগায়। পাশের ঝিলে সবুর চাচার জালে আটকে পড়া এক ঢোঁরা সাপেরতান্ডব কি বেহাল দশায় না করেছে মাছ গুলোর! কুমড়া ফুলের কচি লতায় প্রজাপ্রতি আর ঘাস ফড়িং যখন ব্যস্ত মায়াবী খুনসুটিতে; ডোবার অপরিচ্ছন্ন জলে হাসুর মা’র উচ্ছল হাঁসের দলের প্রণয়লীলার মত্ততায় প্যাঁক-প্যাঁক শব্দেআকাশ বাতাস যেন মুখরিত করে তুলছে। বর্ষার আকাশে উদাসী কালো মেঘের লুকোচুরি দেখতে দেখতে অবচেতন মনে প্রাণভরে হাসতে চেষ্টা করলাম, হায়! হারানো দিনের সেই হাসি যেন হাসতে পারলাম না কিছুতেই।।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.