বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক:সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার ও মার্কিন-সমর্থিত সশস্ত্র কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের (এসডিএফ) সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় চলমান সংঘাতের মধ্যে গত সোমবার (১০ মার্চ) রাজধানী দামেস্কে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা ও এসডিএফ নেতা মাজলুম আবদি এই চুক্তি সই করেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন মতে, চুক্তিতে সিরিয়ার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি প্রশাসনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয় সরকারের সঙ্গে একীভূত করার কথা বলা হয়েছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ এই চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ও কুর্দি বিদ্রোহীদের মধ্যে চুক্তি সই
১৩ বছরের বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধের পর আহমেদ আল-শারার হায়াত তাহরির আল-শাম ও আরও কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সামরিক অভিযানের জেরে গত বছরের ডিসেম্বরে সিরিয়ার দীর্ঘদিনের শাসক বাশার আল-আসাদের পতন হয়। ক্ষমতাচ্যুত আসাদ দেশ ছেড়ে রাশিয়ায় পালিয়ে যান।
কিন্তু এরপরও সিরিয়ার পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়নি। অভ্যন্তরীণ সংঘাতের পাশাপাশি ইসরাইল নিয়মিত বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রেখেছে। এর মধ্যেই গত সপ্তাহ থেকে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
সাবেক আসাদ সরকারের অনুগত আলাউয়ি সম্প্রদায়ের ওপর ভয়াবহ নৃশংসতা চলছে। তাদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে লুটপাট চালানো হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে তাদের গণহারে হত্যা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। যার বেশিরভাগই আলাউয়ি সম্প্রদায়ের।
সিরিয়ার ধর্মীয় সংখ্যালঘু আলাউয়িরা সিরিয়ার পশ্চিমে উপকূলীয় প্রদেশ লাতাকিয়া ও তারতুসে বসবাস করেন। বাশার আল-আসাদ এই আলাউয়ি সম্প্রদায়ের ছিলেন। আসাদ সরকারের পতনের পর অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা। এই ঘটনা বর্তমান সরকারকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
আলাউয়ি সম্প্রদায়ের ওপর ওই নৃশংসতার খবর নিয়ে যখন তোলপাড় অবস্থা ঠিক তখন সশস্ত্র কুর্দি বাহিনী এসডিএফের সঙ্গে চুক্তি সই করার ঘোষণা দিল নতুন সরকার। এরপর সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে চুক্তির সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকা সব ধরনের বেসামরিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সিরিয়ার জাতীয় প্রশাসনের সঙ্গে একীভূত করা হবে, যার মধ্যে সীমান্ত পোস্ট, বিমানবন্দর এবং তেল ও গ্যাসক্ষেত্রও রয়েছে।’
চুক্তি সই হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট আল-শারা ও এসডিএফ নেতা মাজলুম আবদি করমর্দন করছেন- এমন একটি ছবি সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘কুর্দি সম্প্রদায় সিরিয়া রাষ্ট্রের অপরিহার্য অংশ এবং রাষ্ট্র থেকে তাদের নাগরিকত্ব ও সব ধরনের সাংবিধানিক অধিকার দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছে।’
বিবৃতিতে সিরিয়ায় সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ‘বিভাজন, ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা’ প্রত্যাখ্যান করার আহ্বানও জানানো হয়েছে। সরকারের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে মঙ্গলবার (১১ মার্চ) এসডিএফ প্রধান আবদি বলেন, ‘এই চুক্তি নতুন এক সিরিয়া গঠনের সত্যিকারের সুযোগ।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে আবদি আরও বলেন, ‘আমরা এমন একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা সিরিয়ার সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করবে এবং শান্তি ও মর্যাদার জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে।’
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলবে এই চুক্তি?
সিরিয়ার স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি প্রশাসনের সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে কাজ করে এসডিএফ। সিরিয়ার উত্তর ও পূর্বের বিশাল অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ কুর্দি প্রশাসনের হাতে। দেশটির বেশির ভাগ তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে।
এসডিএফ-এর নেতৃত্ব কুর্দি জাতীয়তাবাদী দল কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে)-এর সঙ্গে জড়িত। পিকেকে ১৯৮৪ সাল থেকে প্রায় ৪০ বছর ধরে একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন করে আসছে। তবে গত মাসেই তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়াই ছেড়ে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছে গোষ্ঠীটি।
অন্যদিকে এসডিএফ বহু বছর ধরে সিরিয়ায় তুরস্ক-সমর্থিত সিরীয় যোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। নতুন চুক্তির মধ্যদিয়ে সেই সংঘাতের অবসান হওয়ার পথ সুগম হলো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট শারার নেতৃত্বে সিরিয়ার নতুন সরকার দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অকার্যকর করে দিতে এবং পুরো দেশের ওপর জাতীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান। এই চুক্তির মধ্যদিয়ে সেই লক্ষ্যে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন আল-শারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সিরিয়ার নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ও কুর্দি এসডিএফের মধ্যে নতুন চুক্তি দেশটির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এর মধ্যদিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির বহুল কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীল ফিরতে পারে এবং এর রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে নতুন রূপ দিতে পারে।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, চুক্তির সাফল্য নির্ভর করছে সবগুলো পক্ষের মধ্যে এর কার্যকর বাস্তবায়ন, সহযোগিতা ও সমঝোতার ওপর। দামেস্কভিত্তিক সিরীয় বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ নাদের আল-ওমারি বলেন, ‘এই চুক্তি সিরিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতা বজায় রাখার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা বিভাজন বিষয়ক উদ্বেগ কমিয়ে আনবে।’
লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ ও উভয় পক্ষের প্রকৃত প্রতিশ্রুতির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে আল-ওমারি বলেন, ‘সিরিয়ার ভূখণ্ড একীভূত করার জন্য এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে এর বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা, সহযোগিতা ও পারস্পরিক ছাড় প্রয়োজন।’
দামেস্কভিত্তিক ন্যাশন বিল্ডিং মুভমেন্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা আনাস জুদেহ বলেন, চুক্তিটি ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’। সিরিয়ার জাতীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এসডিএফের রাজনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরে একে একটা ‘গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ’ বলেও অভিহিত করেছেন এই বিশ্লেষক।
জুদেহ বলেন, ‘এসডিএফ তার বেশিরভাগ লক্ষ্যই অর্জন করেছে।’ তবে তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘বাস্তব ফলাফল চুক্তির প্রকৃত প্রভাব নির্ধারণ করবে, কারণ ‘বিশদ বিবরণের মধ্যে শয়তান লুকিয়ে আছে।’
দুই পক্ষের যৌথ বিবৃতি অনুসারে, এই চুক্তিতে চলতি বছরের শেষ নাগাদ চুক্তিটি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের জন্য নির্বাহী কমিটি গঠনের রূপরেখা দেয়া হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, বিশেষ করে সিরিয়ার সেনাবাহিনীতে এসডিএফ বাহিনীর একীভূতকরণের ক্ষেত্রে এখনও বাধা রয়ে গেছে।
এসডিএফ বাহিনী ভেঙে দেয়া, উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় একটি বিশেষায়িত ব্রিগেড তৈরি করা, অথবা বিদ্যমান সেনা ইউনিটে এর যোদ্ধাদের একীভূত করার মতো বিষয়গুলো এখনও আলোচনাধীন রয়েছে।
জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র মঙ্গলবার বলেছেন, উপকূলীয় অঞ্চলে সহিংসতার মধ্যে হওয়া এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘ। সিরিয়া বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত গেইর পেডারসেন এক বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করে বলেন, এই চুক্তিটি নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব ২২৫৪-এর মূল নীতিগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি বৃহত্তর, বিশ্বাসযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক রূপান্তর প্রক্রিয়াকে সমর্থন করতে এবং তা বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারে, যা একটি নতুন সংবিধান এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সুগম করবে।
যুক্তরাষ্ট্র, তুর্কি ও অন্যান্য আঞ্চলিক অংশীদারসহ গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সিরিয়ার এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার আহ্বান জানিয়ে পেডারসেন আরও বলেন, ‘দেশব্যাপী যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা এবং সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রকৃত সমঝোতা নিশ্চিত করার বিষয়ও এই চুক্তির মধ্যে রয়েছে।’
তুরস্ক এরই মধ্যে এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান এই চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক’ অভিহিত করে বলেছেন, ‘এর (চুক্তির) পূর্ণ বাস্তবায়ন দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অবদান রাখবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এসডিএফ ‘আগেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাই আমরা এখানে অভিপ্রায় প্রকাশের চেয়ে বাস্তবায়নের দিকেই নজর দিচ্ছি।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চুক্তিটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে অন্যান্য গোষ্টীগুলোকে, বিশেষ করে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে, একই পথে চলতে উৎসাহিত করতে পারে, যা সিরিয়ার রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করবে। “একটি আল-ওমারি বলেন, ‘এর সফল বাস্তবায়ন সিরিয়ার বৃহত্তর পরিস্থিতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আনবে।’ #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.