নিজস্ব প্রতিবেদক:রাজশাহীতে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) সদ্য বিদায়ী নির্বাহী পরিচালক (ইডি) শফিকুল ইসলামের দায়ের করা একটি মামলা এখন প্রতিষ্ঠানটির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে, বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান ও কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মজিবুর রহমানসহ ১৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে।
এছাড়া অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরো ৫০-৬০ জনকে। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে হুসিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে, অবিলম্বে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। এই মামলায় কোনো আসামিকে গ্রেফতার ও হয়রানি করা যাবে না। অন্যথায় কর্মচারী ইউনিয়ন সহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে।
এতে করে বিএমডিএতে নতুন করে অস্থিরতা ও অচলাবস্থা সৃষ্টির আশংকা দেখা দিয়েছে।
এদিকে সদ্য বিদায়ী নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) শফিকুল ইসলামকে ক্ষমতা হারানো আ’লীগ সরকারের অনুগত একজন কর্মকর্তা আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ তুলে ধরেছেন কর্মচারী ইউনিয়ন সহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একইসঙ্গে দায়ের করা মামলাটিকে মিথ্যা দাবি করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন তারা।
বিএমডিএর একটি পক্ষ বলছে, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিএমডিএর ইডি শফিকুল ইসলামকে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক হিসেবে বদলির আদেশ হয়। কিন্তু রিলিজ অর্ডার না পাওয়ায় তিনি দফতর ছাড়তে পারছিলেন না। এরই মধ্যে ২৩ মার্চ দুপুরে একদল কর্মকর্তা-কর্মচারী বিএমডিএর ইডির দফতরে ঢুকে তারা শফিকুল ইসলামকে জোরপূর্বক দফতর ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। ঘটনার পর অতিরিক্ত সচিব শফিকুল ইসলাম কৃষি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। ২৫ মার্চ মামলা করেন নগরীর রাজপাড়া থানায়।
শফিকুল ইসলামের অভিযোগ, তিনি মন্ত্রণালয়ের রিলিজ স্লিপ না পাওয়ায় বিএমডিএ থেকে অবমুক্ত হতে পারছিলেন না। রিলিজ স্লিপ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে বিএমডিএতে দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার জন্য মৌখিক নির্দেশ দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম খানের নেতৃত্বে তার অনুসারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিএমডিএ ছেড়ে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করছিলেন। তিনি তাদের রিলিজ স্লিপ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তারা কোনো কথা শোনেননি।
তবে শফিকুল ইসলামের এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সদ্য বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, এ ধরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। মন্ত্রণালয় থেকে যথারীতি তাকে (শফিকুল ইসলাম) বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক হিসেবে বদলি করা হয়। কিন্তু এক মাস পূর্ণ হলেও রিলিজ স্লিপ না পাওয়ার অজুহাতে বিএমডিএতে অবস্থান করছিলেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে আগে থেকে অসন্তোষ চলে আসছিল।
জাহাঙ্গীর আলম খান আরো বলেন, ২৩ মার্চ তিনি (শফিকুল ইসলাম) আমার কাছে নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব হস্তান্তর করলে আমি তা গ্রহণ করি। দায়িত্ব অর্পণ ও গ্রহণ সংক্রান্ত তার এবং আমার স্বাক্ষর সম্বলিত অফিস আদেশও রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জোরপূর্বক দায়িত্ব ছাড়তে শফিকুল ইসলামকে বাধ্য করার অভিযোগ সঠিক নয়।
জাতীয় শ্রমিক দলের অন্তর্ভূক্ত কর্মচারী ইউনিয়নের (রেজি: নং রাজ: ২০৮৮) সভাপতি মজিবুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দোসরদের ষড়যন্ত্রের কারণে বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খানকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে তারা মানববন্ধনে কর্মসূচিও পালন করেন। তারা এই অবসরের আদেশকে অবৈধ উল্লেখ করে অবিলম্বে তা বাতিলের দাবি জানান। জাহাঙ্গীর আলম খান বিএমডিএর সেচ শাখার প্রধান ছিলেন।
মজিবুর রহমান আরো বলেন, রেশম বোর্ডে মহাপরিচালক হিসেবে না গিয়ে শফিকুল ইসলাম এক মাস ধরে বিএমডিএতেই অবস্থান করছিলেন। বদলির আদেশের পর তিনি আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে বিএমডিএর রাজশাহী জোনের প্রধান করে পদায়ন করেন। এতে ক্ষুব্ধ হন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এছাড়া শফিকুল ইসলামের গাড়ির ড্রাইভার আব্দুস সাত্তার জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্তভর্‚ক্ত কর্মচারী ইউনিয়নের (রেজি: নং রাজ: ১৫০০) সভাপতি। আর মো: জীবন এই ইউনিয়নের সেক্রেটারি। তারা আ’লীগের রাজনীতির সাথে প্রকাশ্যে জড়িত। আব্দুস সাত্তার ও জীবন সহ আরো অনেকে বিএমডিএতে আ’লীগের হয়ে এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে প্রকাশ্যে ভ‚মিকা রাখেন। এসব নিয়ে ইডি শফিকুল ইসলামকে অবহিত করা হলেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি।
তিনি আরো বলেন, আ’লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রথমবারের মত মেয়র হওয়ার পরে (বর্তমানে অপসারিত ও পলাতক) তার একান্ত সচিবের দায়িত্বও পালন করেন শফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর আলম খান সেচ শাখাকে ঢেলে সাজিয়েছেন। তার বাধ্যতামূলক অবসর আমরা মানি না। অতি দ্রুত তার অবসরের আদেশ প্রত্যাহার না হলে ১৮ হাজার গভীর নলক‚পে অচলাবস্থা তৈরি হবে। সেচ বন্ধ হলে আবাদ থেমে যাবে। এতে করে কৃষি ক্ষেত্রে ক্ষতিকর ও বড় ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এদিকে মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) পৃথক তিনটি অফিস আদেশে পাঁচজন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন দফতরে বদলী ও পদায়ন করা হয়েছে। এরই মধ্যে এ নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির সচিব (ভারপ্রাপ্ত) এনামুল কাদির স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে তাদের এই বদলী ও পদায়ন করা হয়। তবে এনামুল কাদির বলছেন, অতিরিক্ত সচিব শফিকুল ইসলাম এখনো বিএমডিএর ইডি হিসেবে বহাল রয়েছেন। তাই তার আদেশেই এই বদলী ও পদায়ন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় এখনো তাকে রিলিজ অর্ডার দেয়নি। শফিকুল ইসলাম ইডি পদ থেকে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন এবং এ সংক্রান্ত কাগজে তার স্বাক্ষর রয়েছে- এমন এক প্রশ্নের জবাবে এনামুল কাদির বলেন, কাউকে জোর করে সরিয়ে দিলেই তো আর হয় না।
এদিকে সোমবার (৭ এপ্রিল) রাষ্ট্রপতির আদেশ ক্রমে এক প্রজ্ঞাপনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের (অতিরিরিক্ত সচিব) বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: তরিকুল ইসলামকে বিএমডিএর ইডি হিসেবে বদলীপূর্বক প্রেষণে পদায়ন করা হয়েছে। তবে নতুন ইডি হিসেবে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও শফিকুল ইসলামকে কেন রিলিজ অর্ডার দেওয়া হয়নি তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আবার শফিকুল ইসলাম ইডি পদ থেকে দায়িত্ব হস্তান্তর করছেন তার যথাযথ স্বাক্ষরও রয়েছে। তার পরও শফিকুল ইসলামের নির্দেশে বদলী পদায়ন করা হচ্ছে। এ অবস্থায় শফিকুল ইসলাম ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের গৃহীত পদক্ষেপ ধুম্রজাল সৃষ্টি করেছে। এসব নিয়ে নতুন করে বিএমডিএতে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্র বলছে, বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক শফিকুল ইসলামকে জোরপূর্বক দায়িত্ব হস্তান্তরে বাধ্য করার অভিযোগ উঠায় এরই মধ্যে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খানকে। এছাড়া ওই ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির আরো দুই প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
সাময়িক বরখাস্ত হওয়া দুই কর্মকর্তা হলেন, নির্বাহী প্রকৌশলী সেলিম রেজা ও সহকারী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ। ২৩ মার্চের ঘটনার পর নগরীর রাজপাড়া থানায় মামলা করেন বিএমডিএর তৎকালীন ইডি অতিরিক্ত সচিব শফিকুল ইসলাম। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি সেলিম ও আবুল কালাম আজাদ।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান, উপসহকারী প্রকৌশলী মেহেদী, সহকারী মেকানিক আপেল, মেহেদী হাসান, গুদামরক্ষক নুরুজ্জামান, কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মজিবুর রহমান, আব্দুল কাইয়ুম খান, ক্যাশিয়ার শফিকুল ইসলাম, গাড়িচালক শাহাবুল, তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী শমসের আলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম। অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছেন আরো ৫০ থেকে ৬০ জনকে।
রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফুল ইসলাম জানিয়েছেন, তদন্তসাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঘটনা তদন্তে কৃষি মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আহমেদ ফয়সল ইমামকে আহ্বায়ক ও উপসচিব মনিরুজ্জামানকে সদস্যসচিব করা হয়েছে।
কমিটির সদস্যের মধ্যে বিএমডিএর পরিচালনা বোর্ডের সদস্য সাইফুল ইসলাম হীরক ও জাফরুল্লাহ রয়েছেন।
কমিটিতে জেলা প্রশাসনের একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তাকে রাখতে বলা হয়েছে।
আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র বলছে, শফিকুল ইসলামের দায়ের করা মামলা, তার সময়ে আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানা সুবিধা দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরণের অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং শফিকুল ইসলাম উল্টো আওয়ামী বিরোধী ভিন্ন মতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোণঠাসা করে রাখেন। যদিও শফিকুল ইসলাম এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমডিএ চেয়ারম্যান ড. এম আছাদুজ্জামান বলেন, মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের পক্ষ থেকে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কেউই আইনের উর্ধ্বে নয়। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়েই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। তবে এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি ইফতেখার আলম (বিশাল) / রাজশাহী। #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.