রহমান উজ্জল: ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের কারণ হিসেবে নির্দিষ্ট কোন বিষয়কে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। বরং বহুদিন ধরে হাসিনার অনবরত দূঃশাসন ও নিষ্ঠুরতায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় দেশের নাগরিকদের। আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসতে থাকা জনগণ ছাত্রদের আন্দোলনের মাধ্যমে ঠিকানা খুঁজে পায়। পরে ছাত্র জনতার ঐক্যের সামনে হাসিনার কামান, বন্দুক, ট্যাংক- সবকিছুই খরকুটোর মতো উড়ে যায়। মুক্তির নেশায় উত্তাল ছাত্র-জনতা গণভবন আক্রমণ করে। বিশ্ব ইতিহাসের নিকৃষ্টতম মহিলা স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা তখন ভারতে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করে।
দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে মানুষ হাসিনার অঘোষিত বাকশাল কায়েম করার বিরুদ্ধে অনবরত লড়াই করতে থাকে। শেখ মুজিবের ভ্রান্ত দুঃশাসন, স্বজন প্রীতি, অহমিকা, বাকশাল গঠনের পর অবিসংবেদিত নেতা থেকে যেমন পরিবারসহ অনাকাঙ্খীত মৃত্যুর সম্মুখীন হয় তেমনি শেখ হাসিনাও তার অঘোষিত দ্বিতীয় বাকশাল দিয়ে এবং বিরামহীন অত্যাচারে দেশের মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলে। শেখ হাসিনার মিথ্যাচার ও অপশাসন কোন কোন ক্ষেত্রে শেখ মুজিবকেও ছাড়িয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর শেখ মুজিব অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় ৪০ হাজার মানুষ খুন করে। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে শেখ হাসিনাও ভিন্নমতের মানুষকে নিঃসংকোচে নিধন করেছে। শেখ মুজিব যেমন তার রক্ষী বাহিনী দিয়ে ভিন্ন মতের মানুষকে রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে যেত, তেমনি শেখ হাসিনার পালিত পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীগুলোও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে ও গুম করেছে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী, ঢাকা সিটির কাউন্সিলর শাহ আলমসহ এরকম অসংখ্য নেতা-কর্মি গুম খুনের শিকার হয়ে আজও নিখোঁজ।
সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে” রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ”। কিন্তু বিগত ১৬ বছরে বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনার উন্মত্ত আচরণের জন্য রাষ্ট্রকে আতঙ্কের চোখে দেখতো। শেখ হাসিনার মোক্ষম একটি অস্ত্র ছিল ,ভিন্ন মতের মানুষের ওপর মুক্তিযুদ্ধ ও চেতনা বিরোধী ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া। ফলে উন্নয়নের নামে দেশকে তলাবিহীন ঝুঁড়িতে পরিণত করলেও দেশের মানুষ রাস্তায় দাঁড়ানোর সাহস করেনি।
লোক দেখানো রাজনীতির বাইরে লুটপাট এবং প্রতিহিংসা চরিতার্থ করাই ছিল শেখ হাসিনার প্রধান কাজ ও উদ্দেশ্য। অর্বাচীন কিছু দলীয় নেতাকর্মী ও আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে রাজনীতি করা এবং বিরামহীন দেশের নাগরিকদের সাথে অন্যায় করে যাওয়া আওয়ামী লীগের ভেতরের ভালো লোকগুলো মেনে নিতে পারেনি । তারা মনে ক্ষোভ ও ব্যথিত হৃদয়ে চুপচাপ দূরে সরে যায়। ফলে চাটুকার দ্বারা পরিবেষ্ঠিত শেখ হাসিনা বুঝতেও পারেনি সেও তার বাপের মত একসময় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে অযোগ্য এবং লোকে যাকে ভাড় বা কাউয়া বলে ডাকতো সেই ওবায়দুল কাদের পরপর তিনবার দলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। দলের বয়োবৃদ্ধ,দেশপ্রেমিক ও যুক্তিবাদী অংশ দলের উগ্রবাদী ও তেলবাজদের কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। মানুষকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো, হত্যা করা কিংবা নানাভাবে নাজেহাল করা ছিল আওয়ামী যুবলীগ- ছাত্রলীগের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। তারা প্রায়ই ঘোষণা দিত- বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কারোর রাজনীতি করার অধিকার নাই। আন্দোলনকালীন সময়ে এই কাউয়া কাদের আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে ঘোষণা দেয়- আন্দোলনকারীদের দমানোর জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। দেশের নাগরিকরা ওবায়দুল কাদেরের এই ঘোষণা ভালোভাবে নেয়নি। ওবায়দুল কাদেরের ঘোষণার পর হিংস্র ছাত্র লীগ দাঁতাল শুয়ারের মতো আন্দোলনরত ছাত্র -জনতা ও নারীদের উপর হামলে পরে। সন্তানদের উপর এই আক্রমণ মেনে নিতে পারে নাই সাধারণ নাগরিকরা। সর্বত্র প্রতিবাদের বদলে শুরু হয় প্রতিরোধ। নিয়মতান্ত্রিক একটি আন্দোলন অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়ে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পরাজয় ও পলায়ন ঘটে।
আমরা শেখ হাসিনার পতনের কিছু মূল কারণ হিসেবে চিহ্নত বিষয়গুলো নিয়ে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করব –
(১) দুর্নীতি: কথায় আছে মাছের মাথায় পঁচন হলে বাকিটুকু পঁচতে আর সময় লাগে না। আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত শেখ হাসিনা ও তার পরিবার দেশের প্রতিটি সেক্টরকেই দুর্নীতিগ্রস্থ করেছে। মেঘা প্রজেক্টের নামে মেঘা দুর্নীতি শেখ হাসিনার অন্যতম কীর্তি। বহু প্রজেক্ট এর বাজেট শেখ হাসিনা নিজের হাতে দ্বিগুণ করেছে। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে দুর্নীতির অভিপ্রায়ে বহু কাজ শেখ হাসিনা ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে পাইয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতের বিতর্কিত আদানি গ্রুপের নাম উল্লেখযোগ্য। শুধুমাত্র রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকেই ৮ বিলিয়ন ডলার চুরি করেছে শেখ পরিবার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত কমিটির অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার হিসেবে ১৬ বছরে প্রায় ২৪০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছে আওয়ামী গোষ্ঠী। এভাবে ধারাবাহিকভাবে বিদেশে অর্থ পাচারের ফলে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে যায়।ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার অভাব দেখা দেয়। যার অনিবার্য পরিনিতি স্বরূপ দেশে মূল্যস্ফিতি ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি পায়।
( ২) লাগামহীন নিত্য পন্যের দাম: মূল্যস্ফীতির স্বাভাবিক পরিনিতি হল মুদ্রার মান কমে যাওয়া। বাজারে মুদ্রার মান কমে গেলে দ্রব্যমূল্যের দাম স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে যায়। অথচ দ্রব্যমূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আয় না বাড়ায় কখনো কখনো এটা মারাত্মক আকার ধারণ করে। যে কারণে কোন দেশে দেখা দিতে পারে দুর্ভিক্ষ পর্যন্ত। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অভাব দেখা দিলে শেখ হাসিনা ৪০ হাজার কোটি টাকার নোট ছাপিয়ে দেশের আভ্যন্তরীণ বাজারে ছেড়ে দেয়। যা দেশের মূল্যস্ফিতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সংকটকে আরও ঘনীভূত করে। দ্রব্যমূল্যের যাতাকলে পিষ্ট মানুষ হাসিনার পতনের সময় এজন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে এবং বিদ্রোহ করে। যা সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করে।
(৩) আইনশৃঙ্খলার অবনতি: স্বৈরাচার হাসিনা আমলে প্রশাসন, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ- এদের কথাই ছিল আইন। চাঁদাবাজি, ঘুষ- দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিল পুরো দেশ। কার্যকর কোন বিরোধীদল বা পক্ষ না থাকার কারণে এসব অর্থের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে নিজেদের মধ্যেই এরা খুন-জখমে লিপ্ত ছিল। মেধাবী নাগরিক ও যুব সমাজ গড়ার পরিবর্তে দেশে এ সময় দেশে পরিকল্পিতভাবে ব্যাপক নেশার বিস্তার ঘটানো হয়। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সীমান্ত অঞ্চলে গড়ে ওঠে ফেনসিডিল ,ইয়াবা, হিরোইনের মতো মারাত্মক সব প্রাণঘাতী নেশা দ্রব্যের কারখানা। এসব কারখানা থেকে অবাধে দেশের ভেতর প্রবেশ করত এসব নেশাদ্রব্য।
আওয়ামী শাসনের শেষ দিকে প্রতিটি পাড়ায়- মহল্লায় পর্যন্ত আওয়ামী দলীয় কয়েকটি করে গ্রুপ থাকতো। তাদের অস্ত্র প্রদর্শন, কোপাকুপি, খুনখারাবিতে -তটস্থ থাকতো দেশের সাধারণ নাগরিকরা। আর যেকোনো ধরনের মামলা হলেই খুঁজে খুঁজে বিএনপি নেতাকর্মীদের আসামি করা হতো। একদিকে সরকার দলীয় লোকদের খুনখারাবি, সন্ত্রাস, আইন না মানার প্রবণতা আর অন্যদিকে প্রশাসনের মামলা বাণিজ্য -সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা কাঠামো একদম ভেঙে পড়ে।
(৪) উন্নয়নের বুলি ও মিথ্যাচার: ইতিহাস বলে- যে কোন যুগে, যেকোন দেশে স্বৈরশাসকের প্রধান বয়ান হল- উন্নয়নের নামে ফিরিস্তি করা। উন্নয়নের নামে এরা ক্রমাগত মিথ্যাচার করে যায় জনগণের সাথে। আর অবাধে চলতে থাকে লুটপাট। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ও তার লেজুর বৃত্তি করা দোসররা উন্নয়নের গান গাইতে গাইতে জনগণের কান ঝালাপালা করে ফেলে। এ সময় সরকারের পা চাটা মিডিয়াগুলো সরকারের চেয়েও যেন বেশি উৎসাহী ছিল সরকারের গুণ- কীর্তন করতে। একই কথা বারবার শুনতে শুনতে দেশের মানুষ প্রচন্ড রকম বিরক্ত হয়।
(৫) আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস: আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় বাকশাল আমলে শিশু লীগ থেকে শুরু করে শত শত লীগের আয়োজন দেখা যায়। দেশ ও নাগরিকরা কার্যত একটি দলের নেতাকর্মীদের ইচ্ছাধীন হয়ে পড়ে। এ সময় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ হয়ে পড়ে অপ্রতিরোদ্ধ ও লাগামহীন। ইচ্ছা হলেই তারা খুন-খারাবি ও মারামারির মতো কাজে লিপ্ত হতো। আর এখানে তাদের সহযোগিতা করতো সরকারের সাথে আতাত করা বিভিন্ন বাহিনী। এ সময় বুয়েটের ছাত্র আবরারসহ অসংখ্য মেধাবী ছাত্র ও নাগরিক তাদের কাছে গুম-হত্যার শিকার হয়। এছাড়া কিছু হলেই দেয়া হতো মামলা। লক্ষ লক্ষ মামলা দিয়ে নাজেহাল করা হয় ভিন্ন দল বা মতের মানুষকে। এ সময় দেশব্যাপী নাগরিকরা আতঙ্কিত থাকতো সরকারি দল ও প্রশাসনের ভয়ে।
(৬) গণতন্ত্রহীনতা: গণতন্ত্রহীনতা ও প্রায় দুই দশক ধরে ভোট দিতে না পারা দেশের নাগরিক ও তরুণ জেনারেশনের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ নাগরিকরা এ সময় কয়েকটি হাস্যকর, প্রহসনের নির্বাচন লক্ষ্য করে। জাতীয় পর্যায় থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত ভোটারবিহীন নির্বাচন দেখতে দেখতে নাগরিক সমাজ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। চরম ফ্যাসিস্ট শাসকের অধীনে এসব দেখে ব্যথিত হওয়া ছাড়া নাগরিকদের আর কিছু করার ছিল না তখন।
(৭) আমলাতান্ত্রিক জটিলতা: স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামালকে চিত্রিত করতে হলে সে সময়কার সরকারি কর্মকর্তা -কর্মচারীদের ভূমিকা নিয়েও বলতে হবে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা বন্দুক ও গোলাবারুদ নিয়ে এ সময় পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মচারীরাও এ সময় লোভ ও সীমাহীন দুর্নীতির কারণে নির্লজ্জভাবে একটি অবৈধ সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়। দেশের সমস্ত মানুষের বিপরীতে গিয়ে আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের আতাত ভিতরে ভিতরে দেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। সরকারি লোকদের দৌরাত্ম্য এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, ক্ষেত্র বিশেষে সরকারি কর্মকর্তারা মন্ত্রী-এমপিদের পর্যন্ত তোয়াক্কা করত না। কারণ জনবিচ্ছিন্ন সরকারকে টিকিয়েই রেখেছিল প্রশাসনের বন্দুকের নল।
(৮) দলীয়করণ: দলীয়করণ বিষয়টি অবৈধ বাকশালী আমলে মহামারির মতো ছড়িয়ে যায়। এ সময় মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে জেলা- উপজেলা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বেছে বেছে পরিক্ষিত আওয়ামী সমর্থকদের নিয়োগ দেয়া হতো। যমুনা সেতুর নাম বদলে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু সেতু। ঢাকা জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পাল্টে দেয়া হয় হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এভাবেই চলে আওয়ামী লীগের প্রতিহিংসা ও দলীয়করণের রাজনীতি। পাড়া, মহল্লার ক্লাব থেকে শুরু করে পাবলিক টয়লেট-শৌচাগারে পর্যন্ত শেখ মুজিবের নাম বসানোর হিড়িক পড়ে যায়। যা দেশের নেটিজেনদের মধ্যে হাস্যরসের সৃষ্টি করে।
( ৯) আওয়ামী লীগের ভারত প্রেম: আওয়ামী লীগের ভারত প্রেম সর্বজন স্বীকৃত একটি বিষয়। রাষ্ট্র টু রাষ্ট্র সম্পর্ক না রেখে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারত রাষ্ট্র টু আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বেশি উৎসাহী। এক্ষেত্রে ভারতের প্রতিটি দলের দৃষ্টিভঙ্গিই প্রায় একই রকম। মোদীর হিন্দুত্ববাদ ও পুরনো চাণক্য নীতি এ দেশের জনগণ গ্রহণ না করলেও ভারত সেদিকে কর্ণপাত করেনি। বরং যেকোনো মূল্যে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা এবং তা জায়েজ করার জন্য বিশ্বব্যাপী দুতিয়ালী করাই ছিল এ সময়ের বাংলাদেশ সম্পর্কিত ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতি। পক্ষান্তরে মসনদের বিনিময়ে ভারতের যে কোন আবদার রক্ষার্থে শেখ হাসিনা ও তার সরকার সদা প্রস্তুত ছিল। এ সম্পর্কে শেখ হাসিনা নিজেই একবার বলেছিল- “ভারতকে দিয়ে যা দিয়েছি, তা সারা জীবন মনে রাখতে হবে”।
(১০) নদীর পানির সঠিক হিস্যা না পাওয়া: বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহমান আন্তর্জাতিক নদীগুলোর সঠিক পানির হিস্যা আদায় করতে না পারা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারের জন্যই ব্যর্থতার। এসব নিয়ে আওয়ামী লীগ কখনোই আন্তর্জাতিক কোন ফোরামে কথা বলে নাই, উল্টা ভারত- বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেও এ নিয়ে কথা বলার হিম্মত রাখেনি। পানির সঠিক হিস্যা না পাওয়ায় বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো শুকিয়ে দেশের মরুকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে। দেশের মানুষ এটাকে পার্শ্ববর্তী দেশের সুপরিকল্পিত চক্রান্ত হিসেবেই জানে। আবার বর্ষা মৌসুমে ভারত নির্মিত বাঁধগুলো ছেড়ে দিয়ে ভাটির বাংলাদেশকে ডুবিয়ে দেয়ার বিষয়টা বিশ্বব্যাপি নিন্দিত হলেও ভারত এ ব্যাপারে কখনো কর্ণপাত করেনি।
(১১) গণহত্যা: স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার পোষা বাহিনীর নিষ্ঠুরতা একটা সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে- মানুষ হত্যা করতেও তাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না। শেখ হাসিনার আমলে চারটি বড় গণহত্যার মাধ্যমে দেশের কয়েক হাজার মানুষকে নিহত এবং প্রায় দুই লক্ষ মানুষকে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। হাসিনা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের দ্বারা সংঘটিত নিষ্ঠুর গণহত্যা গুলোর মধ্যে অন্যতম – হলো বিডিআর হেড কোয়ার্টারে ৫৭ জন দেশ প্রেমিক, চৌকস, তরুণ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে পুড়িয়ে অথবা নির্মমভাবে হত্যা, বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামের জমায়েতকে কেন্দ্র করে ঢাকা শাপলা চত্বরে রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে গুলি করে আলেম-ওলামাদের হত্যা, মাওলানা সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায়কে কেন্দ্র করে প্রায় দুইশত মানুষকে হত্যা, এবং ২০২৪ এর জুলাই আগস্ট গণহত্যা। ২০২৪ সালের গণহত্যায় প্রায় দুই হাজার মানুষ নিহত এবং প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ গুরুতরভাবে আহত হয়। শেষ পর্যন্ত দিশেহারা শেখ হাসিনা প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে যায়।
( ১২) সীমান্ত হত্যা: ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা করা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ওপাশ থেকে পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারলেও হাসিনা সরকারের নিষ্ক্রিয়তা জাতিকে বিক্ষুব্ধ ও ভারাক্রান্ত করে তুলে বারবার।
১৩) পররাষ্ট্রনীতির দুর্বলতা: ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ছিল ভারত নির্ভর। অত্যাচারী শেখ হাসিনা মসনদ হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে ভারতের ইশারা ছাড়া কিছু বলতো না বা করতো না। বছরের পর বছর ধরে এরকম দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি এ দেশের জনগণ কখনোই মন থেকে মানতে পারেনি।
১৪) হাসিনার মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন: শেখ হাসিনা তার পিতা শেখ মুজিবকে একজন ভালো- মন্দ মানুষের বদলে দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। দেশজুড়ে ৪/৫ হাজার কোটি টাকার ভাস্কর্য ও মূরাল বানিয়েছে। শেখ মুজিবকে জনতার মাথার উপর জাতির পিতা হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। দেশের নাগরিক ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বিষয়টা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি।
১৫ ) প্রবাসে বসে তারেক রহমানের দিকনির্দেশনা: বিএনপির এক্টিভ চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশে অবস্থান করলেও তার লড়াই জারি রেখেছিলেন। বিদেশের মাটিতে বসেই তিনি জাতীয়তাবাদী শক্তিকে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে আরো মজবুত করেছিলেন। একদিকে জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক শক্তিগুলো ঐক্য করেছিল অন্যদিকে হাসিনা ছিল অন্ধত্ব ও অহমিকা নিয়ে। ফলে জনতার সাথে সরকার বা আওয়ামী লীগের সখ্যতার বদলে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
১৬) বিএনপি বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর অবদান: বিগত ১৬ বছর বা তার বেশি সময় ধরে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল-বিএনপি ও সমমনা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করে রেখেছিল। যা হাসিনা পতনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
১৭) হাসিনার পা চাটা ও চাটুকারদের ভূমিকা: হাসিনার এমন লজ্জাজনক পরাজয় ও পলায়নে তার পদলেহনকারী তেলবাজ ,চাটুকাররা কম দায়ী নয়। তারা অনবরত কাঠের চশমা পরিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে হাসিনার পক্ষ থেকে। যা হাসিনার জন্য কখনোই মঙ্গলজনক ছিল না।
১৮) অসুস্থ খালেদা জিয়াকে বন্দি রাখা: অসুস্থ খালেদা জিয়া একা একা চলতে ফিরতে অক্ষম। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পরিত্যাক্ত কারাগারে বন্দি রাখাটা কারো কারো জন্য দম বন্ধ করার মত একটা বিষয় ছিল ।মানুষ প্রচন্ড দুঃখ পেয়েছিল। হাসিনার প্রতি জমা হয়েছিল আরো বেশি ঘৃণা।
১৯) নারী ও শিশু নির্যাতন: স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার ১৬ বছরে আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতির সাথে ব্যাপক হারে ধর্ষিত হয় বৃদ্ধা ও শিশুরা। ১০০ বছরের বৃদ্ধ থেকে তিন বছরের শিশু কেউই এ সময় এসব অপরাধ থেকে রক্ষা পায়নি।আর ছাত্রলীগের পান্ডাদের একজন তো ছিল ধর্ষণের গুরুদেব। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ বিদ্যা চর্চা কেন্দ্রে ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালন উৎসব করতেও দেখা যায় ছাত্রলীগকে। জাতির জন্য লজ্জাজনক হলেও অন্ধ নিষ্ঠুর ছাত্রলীগ কেক কেটে সেটা পালন করে।
২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত শেখ হাসিনা বা তার লোকজন জনগণের উপর এত এত জুলুম, অত্যাচার করেছে যে -শেখ হাসিনার পতনের কারণ হিসেবে আরও অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনাকে অত্যন্ত চতুরভাবে শেখ হাসিনা ধ্বংস করেছে। নিজ দল ছাড়া অন্য দলের মানুষের প্রতি ন্যূনতম সম্মানবোধ ছিল না আওয়ামী লীগের। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় পাত্তা পায়নি আওয়ামী লীগ বা সরকারের কাছে। মূলত শেখ হাসিনা, তার আত্মীয়-স্বজন, কাছের মানুষজন ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা, ব্যবহার এমন পর্যায়ে পৌঁছে ছিল যে- জনগণের দিকে তারা ফিরেও তাকায়নি। ফলে ইতিহাসের অনেক স্বৈরশাসকের মতো জনরোষেই তাকে ক্ষমতার মসনদ থেকে বিদায় নিয়ে পালিয়ে যেতে হয়। পালিয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিতে হয়। #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.