খুলনা ব্যুরো:ঘূর্ণিঝড় রেমাল’র তাণ্ডবে লন্ডভন্ড উপকূলীয় জেলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল।ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সুন্দরবন।মারা হরিনসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী। ৬১ কিলোমিটার বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয়েছে বিভিন্ন অঞ্চল। প্লাবিত হয়েছে হাজার হাজার একর ঘের ও পুকুর। মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে ২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার।
প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ে ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট তছনছ হয়েছে, ভেঙে পড়েছে গাছ-পালা। বিদ্যুৎ বিহীন হয়ে পড়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৪০ লাখ গ্রাহক। গ্রামের পর গ্রামে পানিবন্দি রয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের বিধ্বংসী আঘাত, জলোচ্ছ্বাস এবং জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বিভিন্ন জনপদ। ভেসে গেছে ৩ হাজার ৬০০ পুকুর এবং ৯ হাজার ১১৫ টি ঘেরের মাছ, চিংড়ি, কাকড়া, পোনা। এতে ক্ষতি হয়েছে ২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার মৎস্য সম্পদের।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে খুলনার ৯টি উপজেলার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া ও রূপসা এই ছয়টি উপজেলার ৩৮টি ইউনিয়নের মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ঝড়ের তান্ডবে জেলায় ওই ছয়টি উপজেলার ৩৫৫ দশমিক ৩০ হেক্টর জমির ৩ হাজার ৬০০টি পুকুর এবং ১০ হাজার ২২৩ দশমিক ৭৫ হেক্টর জমির ৯ হাজার ১১৫টি ঘের ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সেইসঙ্গে ১ হাজার ৫৯০ হেক্টর জমির ১ হাজার ৩৫৬টি কাকড়া/কুচিয়া খামার ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এবারের ঝড়ে মোট ক্ষতি হয়েছে ২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার মৎস্য সম্পদ। যারমধ্যে ৬৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা মূল্যের ৩ হাজার ৭৮ মেট্রিকটন মাছ, ১১৪ কোটি ৬৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ২ হাজার ৫৬৪ মেট্রিকটন চিংড়ি, ২০ কোটি ৫৭ হাজার টাকা মূল্যের ৬৩৬ মেট্রিকটন পোনা, ১৮ কোটি ৬৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ১০২ দশমিক ২০ মেট্রিকটন কাকড়া/কুচিয়া, ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা মূল্যের ২৭০ মেট্রিকটন পিএল, ২০ লাখ টাকা মূল্যের ২০টি নৌকা/ট্রলার/জলযান এবং ১৬ কোটি ১১ লাখ টাকার অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বিটিসি নিউজকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে খুলনায় মৎস্য চাষীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করেছি। এতে ২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার সাদা মাছ, চিংড়ি, পোনা, কাকড়া ও অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সুন্দরবনের। বনের বিভিন্ন স্থানে মিলছে বন্যপ্রাণীর মরদেহ। মঙ্গলবার (২৮ মে) দুপুর পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী বনের বিভিন্ন স্থান থেকে ২৬ টি হরিণের মৃতদেহ পাওয়া গেছে এবং জীবিত অবস্থায় প্রায় ১৭ টি হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন বিভাগের ২৫টি টহল ফাঁড়ি। লবণপানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে প্রায় সকল মিঠা পানির পুকুর।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বিটিসি নিউজকে বলেন, সাধারণত জলোচ্ছ্বাস হলে বন্য প্রাণীরা উঁচু স্থান ও গাছে আশ্রয় নেয়। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বনের ভেতর অধিক উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। ফলে বনের উঁচু স্থান তলিয়ে যাওয়ায় প্রাণীদের আশ্রয় নিতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। অধিক জ্বলোচ্ছ্বাসের ফলে নিরাপদ আশ্রয়ে না যেতে পেরে হরিণগুলোর মৃত্যু হতেপারে।
সুন্দরবন বিভাগের খুলনাঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বিটিসি নিউজকে বলেন, মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী সুন্দরবনের কটকা ও দুবলা এলাকাসহ বনের বিভিন্ন স্থান থেকে মোট ২৬ টি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া আহত অবস্থায় আরও ১৭টি হরিণ উদ্ধার করে বনরক্ষীরা। তবে হরিণের পাশাপাশি আরও বন্যপ্রাণী মারা যেতে পারে। সেসব মৃত প্রাণীর খোঁজে বনরক্ষীরা তৎপর রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বন বিভাগের টহল অফিসগুলোতে টিনের চালা, জানালা-দরজা, সোলার প্যানেল, ওয়ারলেস সিস্টেম ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। পূর্ব বন বিভাগের কটকা অভয়ারণ্যের অফিস ঘাটের জেটি ও মিঠা পানির পুকুর সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দুবলা, কটকা, কচিখালি, বগিসহ বিভিন্ন বন অফিসসহ ২৫টি টহল ফাঁড়ির রান্নাঘরসহ অবকাঠামোর টিনের চালা উড়িয়ে নিয়ে গেছে।
সুন্দরবনের ৮০টি মিঠাপানির উৎস পুকুরে ৮-১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে লোনা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বনকর্মীদের পাশাপাশি প্রাণীরাও সুপেয় পানির সংকটে পড়েছে।
সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশন এর চেয়ারম্যান ডা.শেখ ফরিদুল ইসলাম বিটিসি নিউজকে বলেন, বন্যপ্রাণী শাবক ছয় ঘন্টার বেশি পানিতে থাকতে পারে না। দীর্ঘ সময় জলোচ্ছ্বাসে কি পরিমাণ বন্যপ্রাণী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটা আমরা জানতে পারবো না।
তিনি আরো বলেন, ঝড়-জলচ্ছাস ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে বন্য প্রাণিদের রক্ষার জন্য সুন্দরবনের অভ্যন্তরে আরও উচু টিলা করা প্রয়োজন।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে উপকূলের তিন জেলায় ৬১ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু এলাকায় পুরোপুরি এবং কিছু এলাকায় আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঁধ। এতে বাঁধসংলগ্ন নিচু এলাকা উপচে লোকালয়ে নোনা পানি প্রবেশ করেছে। শত শত গ্রামে চিংড়ির ঘেরসহ ফসলি জমিতে নোনা পানি প্রবেশ করেছে। অসংখ্য ঘেরের চিংড়ি ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) খুলনার প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা বিটিসি নিউজকে জানান, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় মোট ৬১ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি স্থানে নদীর বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। খুলনার দাকোপ উপজেলার দুই স্থানে বাঁধ ভেঙেছে।
একটি তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বটবুনিয়ার ঢাকি নদীর ডান তীরে। এখানে অন্তত ২০ মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। একই উপজেলার পানখালী-খলসি এলাকার পশুর নদের ভাঙনে সেখানকার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাইকগাছার কামিনীবাসিয়া পুরনো পুলিশ ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ খুব দুর্বল ছিল। আবার বাঁধ নিচু হওয়ায় জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। স্থানীয়রা বলছে, পাইকগাছা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ছয়টি ইউনিয়নের ২১টি স্থানে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহেরা নাজনীন জানান, উপজেলায় প্রায় দেড় লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২১টি স্থানে বাঁধ ভেঙেছে।
বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার বলাইবুনিয়া ইউনিয়নের শ্রেণিখালী-দৈবজ্ঞহাটিতে পানগুছি নদীর ভাঙনে বাঁধ ভেঙেছে। বাগেরহাট সদরের দড়াটানা নদীর ভাঙনে বাঁধ ভেঙেছে। এ ছাড়া সাতক্ষীরা সার্কেলভুক্ত খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশীর হরিহরপুরে শাখবাড়ী নদীর ভাঙন এবং পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের ভদ্রা নদীর ভাঙনে বাঁধ ভেঙেছে।
বাঁধের ভাঙনে খুলনার কয়রা উপজেলার অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ভেসে গেছে শতাধিক চিংড়ির ঘের, ভেঙে গেছে কয়েক শ কাঁচা ঘরবাড়ি ও দোকানপাট। এ ছাড়া রাতজুড়ে ভারি বৃষ্টি ও ঝড়ের তাণ্ডবে উপজেলার বিপুলসংখ্যক গাছপালা উপড়ে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, গত রবিবার রাতে জোয়ারের পানির প্রচণ্ড চাপে মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের সিংহেরকোনা, মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বেলাল গাজীর বাড়ির সামনের বাঁধ ভেঙে গেছে।
মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বিটিসি নিউজকে জানান, গত রবিবার রাতের জোয়ারে ইউনিয়নের দশহালিয়া এলাকায় প্রায় ৫০ মিটার বাঁধ ভেঙে কপোতাক্ষ নদের পানি প্রবেশ করেছে। এতে দুটি গ্রাম ও কয়েক শ চিংড়িঘের তলিয়ে গেছে।
মহেশ্বরীপুর ইউপি চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারি বিটিসি নিউজকে বলেন, ইউনিয়নের সিংহেরকোনা এলাকায় বাঁধ ভেঙে গেছে। এ ছাড়া নয়ানি এলাকার বাঁধের নিচু জায়গা ছাপিয়ে সারা রাত পানি ঢুকেছে। এতে সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ঝড়ের তাণ্ডবে ও ভারি বৃষ্টিতে কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে এলাকাবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আছের আলী বিটিসি নিউজকে জানান, তাঁর ইউনিয়নের মাটিয়াভাঙ্গা এলাকায় রবিবার রাতের জোয়ারে বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। এতে পাঁচ-সাতটি গ্রামে নোনা পানি ঢুকেছে। এ ছাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় নিচু বাঁধ ছাপিয়ে এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে।
কয়রার ইউএনও এ বি এম তারিক উজ জামান বিটিসি নিউজকে বলেন, ‘কয়েকটি স্থানে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে খবর পেয়েছি। ভারি বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়ায় গাছপালা ও মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর খুলনা ব্যুরো প্রধান এইচ এম আলাউদ্দিন এবং মাশরুর মুর্শেদ। #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.